আসিফ আরসালান

গত বৃহস্পতিবার ঠিক করেছিলাম যে, আজ ৫ অক্টোবর রবিবার জুলাই সনদের বাস্তবায়ন নিয়ে সৃষ্ট বিএনপি এবং জামায়াতের মতভিন্নতার ওপর লিখবো। এখনো সেটাই করবো। তবে এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে পূজা মন্ডপে ড. ইউনূসের মূর্তি বানানো নিয়ে একটি চরম গর্হিত কাজ করা হয়েছে। সেটা নিয়েই প্রথমে আলোচনা করবো।

বেশ কয়েকদিনের বিরতির পর ঐকমত্য কমিশন আজ থেকে আবার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে বৈঠকে বসছে। মাঝখানে বিরতি দেওয়ার দুটো কারণ ছিলো। একটি হলো, রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করার সুযোগ দেওয়া। দ্বিতীয় কারণ হলো, প্রধান উপদেষ্টা ৬ জন রাজনীতিবিদকে নিয়ে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেওয়ার জন্য আমেরিকা গিয়েছিলেন। ১লা অক্টোবর তিনি সদলবলে দেশে ফিরেছেন। আজ ৫ তারিখ থেকে আবার বৈঠক বসবে। কিন্তু এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরসহ তিনটি স্থানে পূজা মণ্ডপে যেসব প্রতিমা গড়া হয়েছিলো সেগুলোতে পূজার উদ্যোক্তারা অথবা মূর্তি গড়ার কারিগররা চরম বাংলাদেশ বিরোধিতার নগ্ন প্রকাশ ঘটিয়েছেন। বাংলাদেশ যদি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ না হতো তাহলে এতদিনে সেটি নিয়ে একটি দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড ঘটে যেতো।

ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরের খাগড়ার মণ্ডপে যেসব মূর্তি বানানো হয়েছে সেখানে অসুরের মুখাবয়বের স্থলে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মুখ বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ঐসব পাঁড় হিন্দু সাম্প্রদায়িকগোষ্ঠী ড. ইউনূসের মতো একজন বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিকে হিন্দু দেব দেবীর পৌরাণিক কাহিনীর অসুর রূপে দেখিয়েছে। ‘বিডি নিউজ ২৪. ডট কমের’ রিপোর্ট মোতাবেক, ঐ মূর্তির কারিগর এবং উদ্যোক্তারা নাকি বলতে চেয়েছেন যে, তারা ড. ইউনূসকে ‘মিন’ করেননি। তারা আসলে শত্রু বিনাশের প্রতীক দেখাতে চেয়েছেন। সেই কৈশোর থেকেই দুর্গাপূজার প্রতিমা দেখে এসেছি। বগুড়া থেকে ঢাকা। মাঝখানে অন্তত ৫০ বছরেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে। সব সময় দেখেছি, মূর্তিতে দেবী দুর্গার হাতে একটি বল্লম। ঐ বল্লম বিদ্ধ হয়েছে অসুরের বুকে। বিগত ৫৫ বছরে অসুরের ছবি একটাই দেখেছি। হয়তো কারিগরদের নির্মাণ কৌশলে অসুরের চেহারার সামান্য এদিক ওদিক হতো। কিন্তু তাই বলে কোনো দেশের কোনো রাজনৈতিক নেতা বা কোনো রাষ্ট্রনায়কের মূর্তি বানানো হয়নি।

এ কথা তো আমার বুদ্ধি বয়স থেকে শুনে আসছি যে, হিন্দুদের দেবী দুর্গা হলেন দুর্গতিনাশীনি। মানুষের সমস্ত দুর্ভোগ ও দুর্গতির কারণ হিন্দু পুরাণ মতে মহিশাসুর। দেবী দুর্গ মহিশাসুরকে বধ করার জন্য স্বর্গ থেকে মর্তে আগমন করেন। অতঃপর মহিশাসুরকে বধ করে মানুষের দুর্গতি নাশ করে বিজয়া দশমীতে আবার তিনি স্বর্গে ফিরে যান। এগুলো হিন্দু ধর্মের বিশ্বাস। আমাদের ১৮ কোটি জনগণের মধ্যে ৮ শতাংশ হিন্দু (সর্বশেষ আদম শুমারি মতে)। হিন্দুরা তাদের সে বিশ্বাস নিয়ে প্রতিবছর সাড়ম্বরে ১০ দিবসব্যাপী শারদীয় দুর্গোৎসব পালন করেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর এবারই প্রথম হিন্দু ভাইরা দুর্গপূজা পালন করলেন অত্যন্ত নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে এবং কোনোরকম দুর্ঘটনা ছাড়াই। পূজার আগে চারদিকে ভারতীয় এবং আওয়ামী দালালরা দাবানলের মতো গুজব ছড়িয়ে দেয় যে, এবারের দুর্গ পূজায় একটি বিরাট সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটে যাবে। আর সে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সুযোগে ড. ইউনূসের সরকারকে হটিয়ে দেওয়া হবে। তার জায়গায় স্থলাভিষিক্ত হবে ২০০৭ সালের ১/১১ এর মতো ভারতের আজ্ঞাবাহী সেনা নিয়ন্ত্রিত একটি সরকার। আসলে যারা গুজব ছড়িয়েছিলো তারাই তক্তা উল্টে দেওয়ার জন্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর চক্রান্ত করেছিলো।

সরকারের গোয়েন্দা বাহিনীর কাছে ভারতীয় মদদপুষ্ট এ চক্রান্তের খবর ছিলো। সরকারের পুলিশ বাহিনী অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় ডিউটি করেছে। সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। সারাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জামায়াত কর্মীদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিলো, তারা যেনো পূজা মন্ডপ সর্বক্ষণ তাদের নজরে রাখেন। কোনো অঘটন ঘটার আগেই জামায়াত কর্মীরা যেনো সেটি রুখে দেন। আল্লাহর কাছে লাখো শুকরিয়া, শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে এবার বাংলাদেশের ৩০ হাজারেরও বেশি পূজা মণ্ডপের কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।

পশ্চিমবঙ্গে দুর্গ প্রতিমার মণ্ডপে মহিশাসুরের স্থলে ড. ইউনূসের মূর্তি বানানো ছিলো ঐ বৃহত্তর চক্রান্তেরই একটি অংশ। ওরা ভেবেছিলো, ড. ইউনূসকে এরকম প্রকাশ্যে অপমান করলে বাংলাদেশের মানুষ ক্ষেপে উঠবেন এবং পূজা মণ্ডপগুলোতে অঘটন ঘটাবেন। সে সুযোগে ভারত তার অসৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে নেমে পড়বে। বাংলাদেশের মানুষ অনেক পোড় খাওয়া মানুষ। জুলাই বিপ্লব তাদেরকে আরো বেশি করে পরিপক্ক করেছে। ভারতীয় দালাল আওয়ামী লীগের ফাঁদে তারা পা দেয় নি। সারাদেশে এখন বইছে শান্তি এবং স্বস্তির নিশ্বাস।

পর্বটি এখানেই শেষ করছি। কিন্তু শেষ করার আগে তথাকথিত প্রগতিবাদীদের মুখোশ উন্মোচন করা দরকার। এতদিন পর্যন্ত ওরা ওদের ভাষায় ইসলামী মৌলবাদ বিশেষ করে, জামায়াতে ইসলামীকে হিন্দুদের শত্রুরূপে চিহ্নিত করে রেখেছিলো। এবার পশ্চিমবঙ্গে যখন ড. ইউনূসকে মহিশাসুরের মূর্তিতে হাজির করা হলো তখন ঐ সব প্রগতিবাদীদের মুখে গোমাই আঁটা ছিলো কেনো? কেনো তারা এমন চরম সাম্প্রদায়িকতার নিন্দা করেননি? এবার কেনো তারা ছিলেন স্পিকটি নট? তাদের এ রহস্যময় নীরবতা প্রমাণ করে যে, ওরা আসলে প্রগতিবাদী নয়। সাম্প্রদায়িকতার নাটের গুরু হলো ঐ তথাকথিত প্রগতিবাদীরাই।

এবার আসছি জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে। প্রথমেই আমাদের জানা দরকার যে, জুলাই সনদকে কেনো আইনী ভিত্তি বা সাংগঠনিক স্বীকৃতি দিতে হবে? সংস্কার কমিশনের কাছে বিএনপি যে লিখিত বক্তব্য দিয়েছে তা নিম্নরূপঃ- ‘প্রস্তাবিত জুলাই জাতীয় সনদের পরিচ্ছেদ ২ (সংস্কার কমিশন গঠন) এ সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে গঠিত হয়েছে। এমতাবস্থায়, ঐতিহাসিক জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা (Constitutional

continuity) ক্ষুণ্ন হয়নি। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা চলমান থাকা অবস্থায় প্রস্তাবিত জুলাই জাতীয় সনদকে Constitutional Instrument হিসেবে মর্যাদা দানের চেষ্টা আইনি ও সাংবিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে অসম্ভব, অসঙ্গত ও অগ্রহণযোগ্য। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সংবিধানের অধীনে গঠিত কোনো সরকার রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যমান সংবিধানের স্থলে নতুন কোনো সংবিধান ব্যবস্থা প্রবর্তন করলে, সেটি বিপ্লব নয়, বরং ক্যু হিসাবে গণ্য হবে।”

এখান থেকে একটি বিষয় দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যায় যে, বিএনপি ড. ইউনূস সরকারকে গণঅভ্যুত্থান বা বিপ্লব উদ্ভূত সরকার বলে মনে করে না। তারা এটাকে বর্তমান সংবিধানের ধারাবাহিকতায় আরেকটি সরকার বলে মনে করে। আসলে অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে? তারা এ বিষয়টির প্রতি চোখ বন্ধ করে রাখে যে, ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব ’৭২ সালের সংবিধান মেনে হয়নি। জাতীয় সংসদ ’৭২-এর সংবিধান মোতাবেক ভেঙে দেওয়া হয় নি। সুপ্রীম কোর্টের সমস্ত বিচারককে সংবিধান মোতাবেক তাড়িয়ে দেওয়া হয় নি। সংবিধান মোতাবেক এগুলোর কিছুই করা যেতো না।

গত ৫ অগাস্ট মানিক মিয়া এভিনিউতে ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করলেন সেটি কোন সংবিধান মোতাবেক করা হয়েছে? ’৭২-এর সংবিধানে তো একটি ঘোষণাপত্র রয়েছেই। সে ঘোষণাপত্র বিএনপি মানছে । তাহলে সংবিধান কিভাবে মানা যায়? বিএনপির দাবি মোতাবেক সংবিধান মানলে তো যেদিন জাতীয় সংসদ বাতিল করা হয়েছে সেদিন অর্থাৎ ৬ অগাস্ট থেকে পরবর্তী ৩ মাসের মধ্যেই নির্বাচন করা ম্যান্ডেটরি ছিলো। তা কি করা হয়েছে? জাতীয় সংসদ ভাঙ্গার দেড় বছর পর কিভাবে কোন আইনে নির্বাচন হচ্ছে?

এসব প্রশ্নের কারণে ইউনূস সরকার বেআইনি হয়ে যায় না। গণঅভ্যুত্থান বা বিপ্লব হলো সংবিধানের ওপরে সংবিধান। অর্থাৎ, যেটা আগেও বলেছি, সেটি হলো জার্মান ভাষায় Grundnorm বা Basic norm মোতাবেক ইউনূস সরকার গঠিত হয়েছে। এই Basic norm এর উদ্গাতা হলেন অস্ট্রিয়ান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও দার্শনিক হ্যানস কেলসেন। কেলসেন আইনকে একটি বাধ্যতামূলক নিয়মের শ্রেণী বিন্যাস হিসাবে দেখিয়েছেন, যা একটি মৌলিক নিয়ম Grundnorm থেকে শুরু করে একটি পিরামিডের মতো কাঠামো তৈরি করে, যেখানে প্রতিটি নিয়ম তার ওপরের নিয়ম থেকে বৈধতা লাভ করে।

হ্যানস কেলসেনের তত্বের সোজা অর্থ হলো, জনগণের ইচ্ছাই হলো রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ। জনগণের ইচ্ছা বা অভিপ্রায়ের ওপরে কোনো আইন নেই। যতোই আপনি সংবিধানের দোহাই দেন না কেনো, সে সংবিধানও জনগণের অভিপ্রায়ের অধীন। জুলাই বিপ্লব হলো সে জনঅভিপ্রায়ের মূর্ত প্রকাশ।

জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া খুব সহজ। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যেভাবে সংবিধানে ৫ম সংশোধনী অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন সে একই প্রক্রিয়ায় জুলাই সনদ সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করা যায়। ৫ম সংশোধনীতে শুধুমাত্র বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকেই অপসারণ করা হয়নি, গণভোটেরও অন্তর্ভুক্তি সেখানে ছিলো।

সে একই প্রক্রিয়ায় যদি এখন জুলাই সনদকে প্রভিশনাল সাংবিধানিক ফরমান হিসাবে জারি করা হয় তাহলে সেটি বৈধতা পায়। এ বৈধতাকে আরো পোক্ত করার জন্য নির্বাচনের আগেই ঐ ফরমানের ওপর একটি রেফারেন্ডাম বা গণভোটের আয়োজন করা যায়। গণভোটে ঐ প্রভিশনাল সাংবিধানিক ফরমান অনুমোদিত হলে পরবর্তী পার্লামেন্ট কর্তৃক আর র‌্যাটিফিকেশনের প্রয়োজন হয় না। এমন পদক্ষেপ নিলে নির্বাচনে বিএনপি জিতুক বা জামায়াত জিতুক, জুলাই সনদকে আর উল্টানোর সাধ্য কারো থাকবে না।

বিএনপির সালাহ উদ্দিন সাহেব বলেছেন যে, প্রভিশনাল সাংবিধানিক অর্ডার দিয়ে জুলাই সনদ জারি করলে নাকি দেশে দুইটি সংবিধান চালু হয়ে যায়। এ সম্পর্কে এমন কোনো শব্দ প্রয়োগ করতে চাচ্ছি না যেটাতে বিএনপির সাংবিধানিক নলেজের দৈন্য প্রকাশ পায়।

শুধুমাত্র একটি কথা দিয়ে আজকের আলোচনা শেষ করতে চাই। যদি জুলাই ঘোষণাপত্র এবং জুলাই সনদকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া না হয় তাহলে আজ হোক আর ২০ বছর পরে হোক, বিপ্লবের নায়কবৃন্দ এবং অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্যবৃন্দকে আদালতের কাঠগড়ায় উঠতে হবে এবং সংবিধান ভঙ্গ করার দায়ে দণ্ড পেতে হবে।

জামায়াতে ইসলামী বিষয়টি বোঝে। তারা জুলাই বিপ্লবকে Own করে, অর্থাৎ তারা জুলাই বিপ্লবকে ধারণ করে। তাই তাদের পক্ষে ইলেকশনের আগেই জুলাই সনদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে কোনো আপস করা সম্ভব নয়। এ বিষয়টি যদি বিএনপি হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারে তাহলে মুহূর্তের মধ্যেই বর্তমানে সৃষ্ট জুলাই সনদ বিষয়ক জটিলতা দূর হয়ে যাবে। বিষয়টিকে বিএনপি অথবা অন্তর্বর্তী সরকারের হালকাভাবে দেখা উচিত হবে না।

Email:[email protected]