আসিফ আরসালান
বিএনপির রাজনৈতিক আদর্শ ইদানিং অনেকের কাছে বোধগম্য হচ্ছে না। তারা নিজেরাই বলে বেড়াচ্ছে যে, আগামী ইলেকশনে তারা ক্ষমতায় যাবে। এব্যাপারে আমাদের কোনো মন্তব্য নেই। কারণ হাসিনা সরকারের ১৫ বছর এবং ফখরুদ্দিন মঈন উদ্দিনের ২ বছর - মোট ১৭ বছর জনগণ ভোট দিতে পারেনি। এর মধ্যে দেশে একটি বিপ্লব ঘটে গেলো। এ বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছেন একেবারে টগবগে তাজা তরুণরা। এ তরুণ ভোটারদের সংখ্যা আনুমানিক ৩ কোটি ৭৫ লক্ষ। এছাড়া ১৭ বছর আগে যারা ভোটার ছিলেন তারা সকলেই ৪৫ বছরের ঊর্ধ্বে। তারাও ভোট দেবেন। তাদের সংখ্যা আনুমানিক ৪ কোটি। এভাবে ২ প্রজন্মের প্রায় ৮ কোটি ভোটার কাকে ভোট দেবেন সেটি বলা মুশকিল। কারণ এ ১৭ বছরে তাদের মন মানসিকতার কী রূপান্তর ঘটেছে সেটি কারো পক্ষে বলা মুশকিল। এ মন-মানসিকতা বোঝা যাবে আসন্ন নির্বাচনের বিস্তারিত ফলাফল ঘোষণার পর। তবুও বিএনপির দাবি অনুযায়ী তারা যদি ক্ষমতায় যায় তাহলে তাদের রাজনীতি কোন ধরনে হবে? এ প্রশ্নটি আজ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
কারণ সম্প্রতি তারেক রহমান, মির্জা ফখরুল, সালাহ উদ্দিন আহমেদ এবং মির্জা আব্বাস এমন কিছু উক্তি করেছেন যেগুলো শুনে অনেক মানুষ মন্তব্য করেছেন যে বিএনপি নেতাদের কন্ঠে আওয়ামী লীগের বয়ান শোনা যাচ্ছে।
গত ২১ অগাস্ট হিন্দু সম্প্রদায়ের জনাষ্টমী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করতে গিয়ে মির্জা ফখরুল বলেছেন,আজকে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদদের কথা বার বার স্মরণ করতে চাই। এজন্য চাই যে, ১৯৭১ সাল আমাকে একটা স্বাধীন দেশ দিয়েছিলো, ভূখণ্ড দিয়েছিলো, আমাকে একটা স্বাধীন সত্ত্বা দিয়েছিলো এবং সেজন্য আজকে আমার অস্তিত্ব আছে, আমি টিকে আছি। আজকে একটা প্রচ্ছন্ন প্রচেষ্টা আছে একাত্তরকে ভুলিয়ে দেয়ার। এটার বিরুদ্ধে কিন্তু আমাদেরকে সমস্ত বাংলাদেশের নাগরিককে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। মির্জা ফখরুল বলেন, আজকে একটা নতুন করে কথা উঠছে। ষড়যন্ত্র চলছে যে আপনার বাংলাদেশে এখানে এক ধরনের উগ্রবাদ মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠছে। এ উগ্রবাদকে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে দেওয়া যাবে না। তাহলে আমাদের বাংলাদেশের যে আত্মা, যে সোল সে অস্তিত্ব আমাদের রক্ষা পাবে না। এ কথাটা আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে।
এ ফখরুল সাহেবই কয়েক দিন আগে বলেছেন যে, বাংলাদেশে দক্ষিণপন্থী মতবাদ মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠছে। দক্ষিণপন্থী মতবাদ বলতে ফখরুল সাহেব কোন দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করছেন? একটু আগেই তিনি উগ্রবাদের কথা বলেছেন। এসব পরিভাষা তো ব্যবহার করে ভারতীয়রা। উগ্রবাদী বা দক্ষিণপন্থী বলতে তারা বোঝায় প্রধানত ইসলামপন্থীদেরকে। আগে উগ্রবাদী এবং দক্ষিণপন্থী বলতে ভারতীয় এবং আওয়ামী লীগাররা বোঝাতো বিএনপি-জামায়াতকে। আজ রাজনৈতিক দৃশ্যপটে আওয়ামী লীগ নেই। এখন দেশের প্রধান ২টি রাজনৈতিক শক্তি হলো বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী। এ ২টি বড় রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে দেশের সামগ্রিক রাজনীতির মেরুকরণ ঘটছে। বিএনপির নেতৃত্বে যেসব ছোট ছোট দল আছে তারা বাম দিকে হেলে পড়েছে। এছাড়া সিপিবি এবং বাসদের সাথে বিএনপি কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছে। এদেরকে নিয়ে আগামী নির্বাচনের তারা একটি নির্বাচনী মোর্চা গঠন করবে, এমন কথাও গণমাধ্যমে আসছে।
কয়েক মাস আগে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত প্রধান তারেক রহমান বলেছিলেন, বিএনপির রাজনীতি সেক্যুলার ধর্মী। এব্যাপারে দক্ষিণপন্থী বলে পরিচিত একটি বাংলা জাতীয় দৈনিকে বিশাল উপসম্পাদকীয় নিবন্ধ ছাপা হয়েছিলো। ঐ নিবন্ধে স্পষ্ট বলা হয়েছিলো যে, আর যাই হোক, শহীদ জিয়াউর রহমান এবং বেগম খালেদা জিয়ার রাজনীতি সেক্যুলার ছিলো না। এরপর সেক্যুলারিজমের কথাটা ওরা বলা বন্ধ করেছেন। কিন্তু এ মাত্র কয়েকদিন আগে জনাব তারেক রহমান দেশকে মৌলবাদের উত্থান সম্পর্কে সতর্ক করেছেন।
তারেক রহমানের এ মৌলবাদ সম্পর্কিত উক্তির তীব্র প্রতিবাদ করেছেন আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। তারেক রহমানের নাম তিনি করেননি। কিন্তু তিনি দ্ব্যার্থহীন ভাষায় বলেছেন, আপনারা আর যাই বলুন, ‘মৌলবাদ’ এ শব্দটি বার বার বলবেন না। এ শব্দটি ভারত বিরোধীদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ এবং ভারত হামেশাই উচ্চারণ করে। আসলে তারা সরাসরি পবিত্র ইসলামকে আক্রমণ না করে মৌলবাদ শব্দটিকে আক্রমণ করে। অনেকটা ঝি কে মেরে বৌ কে হুশিয়ার করার একটি কৌশল।
মাহমুদুর রহমান আরো বলেন, আপনারা মৌলবাদ বলতে যদি সাম্প্রদায়িকতা বোঝান তাহলে সেটি সরাসরি বলুন। আমরাও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। জুলাই বিপ্লবের মধ্যে এবং অব্যবহিত পর এ মুসলমানরাই, বিশেষ করে এদেশের আলেম-ওলামা এবং মাদরাসার ছাত্ররা বুক দিয়ে হিন্দু ভাইদেরকে আগলে রেখেছে। আর যদি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কথা বলতে হয় তাহলে সর্বাগ্রে বলুন তো, সাম্প্রদায়িক নাম নিয়ে কি কোনো সংগঠন কাজ করতে পারে? ‘হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ’ নামক সংগঠনটি কিভাবে এ নামে কাজ করতে পারে? এ নামটি তো বলে দিচ্ছে যে, তারা পাঁড় সাম্প্রদায়িক। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান কার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে? এ তিন ধর্মীয় সম্প্রদায় ছাড়া বাংলাদেশে আর অবশিষ্ট রইলো তো মাত্র মুসলমানরা। তাহলে কি ঐ ঐক্য পরিষদ গঠিত হয়েছে মুসলমানদের বিরুদ্ধে? বিএনপি বা সিপিবি বা বাসদ এর কী জবাব দেবেন? মৌলবাদের বিরোধিতা করবেন, সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা করবেন আর হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ সম্পর্কে ঠোঁট সেলাই করে রাখবে-এমন স্ববিরোধিতা তো রাজনীতিতে চলে না।
উগ্রবাদ, মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি নিয়ে আরো কিছু লিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এর মধ্যে দেখলাম ২টি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। একটি হলো সুখরঞ্জন বালির মামলা। আর দ্বিতীয়টি হলো বাংলাদেশে গনহত্যা সম্পর্কে জাতিসংঘের রিপোর্ট এবং জুলাই আন্দোলন সম্পর্কে হাইকোর্টের দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য।
আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধের মামলার সাক্ষী সুখরঞ্জন বালি তার অপহরণের ঘটনায় ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের কাছে শেখ হাসিনাসহ ৩২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছেন। অভিযুক্তদের মধ্যে অন্যতম হলেন, সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ, সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা, তৎকালীন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম।
এছাড়া এ অপহরণের ঘটনায় যেসব পুলিশ সদস্য জড়িত ছিলো তাদের নামও উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১২ সালে ট্রাইব্যুনালে আল্লামা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে এসেছিলেন সুখরঞ্জন বালি। তিনি প্রসিকিউশনের পক্ষের সাক্ষী ছিলেন। তাই সেদিন তাকে ট্রাইব্যুনালের গেট থেকে অপহরণ করা হয়। দুই মাস ১৩ দিন একটি অন্ধকার রুমে তাকে আটক রাখা হয়।
পরবর্তীতে ভারতের কলকাতায় বিএসএফের মাধ্যমে তাকে পাচার করা হয়। সেখানে তিনি পাঁচ বছর জেল খাটেন। এরপর দেশে ফিরে আসেন। অপহরণের ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি দাবি করেন সুখরঞ্জন বালি। তার অভিযোগ গ্রহণ করে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম যথাযথ তদন্তের ব্যবস্থা গ্রহণ করার নির্দেশ দেন।
দ্বিতীয় ঘটনা হলো, গত বছরের জুলাই গণঅভ্যুত্থান চলাকালে মানবাধিকার লঙ্ঘন সংক্রান্ত জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়ের তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদনকে ‘ঐতিহাসিক দলিল’ হিসেবে ঘোষণার জন্য সরকারকে আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
একইসঙ্গে, ঐ প্রতিবেদনকে ‘জুলাই বিপ্লব-২০২৪’ হিসেবে গেজেট প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত, যেন এটি ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করা যায়। আইন মন্ত্রণালয়কে আগামী ৩ মাসের মধ্যে এ বিষয়ে অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছেন হাইকোর্ট। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. তানভীর আহমেদের করা একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বৃহস্পতিবার বিচারপতি ফাহমিদা কাদের ও বিচারপতি সৈয়দ জাহেদ মনসুরের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
জুলাই আন্দোলনে হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার আদেশ চেয়ে গত বছরের ১৩ আগস্ট এ রিট করা হয়েছিল। পরে ১৫ আগস্ট হাইকোর্ট ‘ফ্যাসিবাদী শাসন টিকিয়ে রাখা’ এবং নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের হত্যার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারের উদাসীনতা ও নিষ্ক্রিয়তা প্রশ্নে একটি রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্ট বেঞ্চ। জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয়ের তথ্যানুসন্ধান গত বছরের ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
পরে রিট আবেদনকারী এ বছরের মে মাসে ওই প্রতিবেদন সংযুক্ত করে আদালতে সম্পূরক আবেদন জমা দেন। সম্পূরক আবেদনের জবাবে, চলতি বছরের ১৪ মে হাইকোর্ট আরেকটি রুল জারি করে কেন ঐ প্রতিবেদনকে ‘ঐতিহাসিক দলি’ হিসেবে ঘোষণা করা হবে না, তার ব্যাখ্যা চেয়ে একটি রুল জারি করেন।
রুলের ওপর শুনানি শেষে হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ রায় ঘোষণা করেন। রিট আবেদনকারী অ্যাডভোকেট তানভীর আহমেদ নিজেই আবেদনের শুনানি করেন। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ শফিকুর রহমান ও তানিম খান এবং সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল একরামুল কবির।
সুখরঞ্জন বালির মামলা যদি সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয় তাহলে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসবে। আল্লামা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর বিপক্ষে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য তাকে আদালতে আনা হয়েছিলো। কিন্তু যখন পুলিশ এবং আওয়ামী লীগ জানতে পারে যে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সুখরঞ্জন বালি আল্লামা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দেবেন তখন তাকে আর আদালতে না নিয়ে গায়েব করা হয়। প্রথমে বহুদিন গুম থাকা এবং তারপর পশ্চিমবঙ্গের একটি কারাগারে তার হদিস পান ড. কামাল হোসেনের জামাই ব্যারিস্টার সারা হোসেনের স্বামী ডেভিড বার্গম্যান। আল্লামা সাঈদীর মামলাতেই বিচারপতি নিজাম উদ্দিন স্কাইপি কেলেঙ্কারিতে জড়িত হয়েছিলেন। বেলজিয়াম থেকে তার জন্য রায় লেখা হয়েছিলো। যেটি তিনি ঢাকার আদালতে শুধু পাঠ করতেন। এসব বিষয় নিয়ে আমি বিস্তারিত লিখবো। আজকে স্থান সংকুলান হচ্ছে না।
আমি সব সময় লিখে আসছি, জুলাই আন্দোলন গণঅভ্যুত্থান ছিলো না। এটি ছিলো বিপ্লব। ৬৯ এবং ৯০ এর দুর্বার গনআন্দোলন ছিলো গণঅভ্যুত্থান, বিপ্লব নয়। কেনো এটি অভ্যুত্থান নয়, বিপ্লব ছিলো সে বিষয়টিও আমি বারান্তরে সবিস্তার আলোচনার ইচ্ছা রাখি।