প্রফেসর আর. কে. শাব্বীর আহমদ

অপরূপ মুখাবয়ব ও দৈহিক সৌন্দর্যের দিক থেকে যিনি ছিলেন চাঁদের চেয়েও সুন্দর, চরিত্র মাধুর্যে যিনি ছিলেন তরতাজা ফুটন্ত গোলাপের চেয়েও সৌরভময়, যার চেহারার ঔজ্জ্বল্য চাঁদের আলো নিষ্প্রভ, তিনি হলেন মানবতার বন্ধু রাসুলে আকরাম মুহাম্মাদ (সা:)।

হযরত জাবের বিন সামুরা (রা.) বলেন : “আমি একবার জ্যোৎস্না রাতে রাসূল (সা.) কে দেখেছিলাম। তিনি লাল পোশাকে আবৃত ছিলেন। আমি একবার চাঁদের দিকে আর একবার তাঁর দিকে তাকাচ্ছিলাম। অবশেষে আমি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চাঁদের চেয়েও সুন্দর।”

আল্লাহ তা’আলা এমন অসাধারণ অপূর্ব সৌন্দর্যের অধিকারী মানুষটিকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন রাসুল হিসেবে, মানুষের মুক্তিদূত হিসেবে, মানুষের দুনিয়া আখেরাতের কল্যাণকামী নেতা হিসেবে। একমাত্র মানুষকে আল্লাহ তা’আলা সৃজন করেছেন সুন্দর অবয়ব ও সুন্দর চরিত্র মাধুর্য দিয়ে। আল্লাহ তাআলার ঘোষণা : “ আমি মানুষকে সর্বোত্তম সৌন্দর্যময় আকৃতিতে সৃষ্টি করেছি।” -সূরা আত তীন, আয়াত-৪

এ আয়াতের প্রকৃষ্ট প্রমাণ হিসেবে আল্লাহ তা’আলা রাসূল মুহাম্মদ (সা:)কে অপূর্ব সুন্দর দেহাবয়ব ও উন্নত চরিত্র-মাধুর্যে অভিষিক্ত করেছেন। রাসূল (সা:)-এর চরিত্র-মাধুর্য সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা নিজেই সনদ পেশ করেছেন এ ভাষায় : “নিশ্চয়ই আপনি সর্বোচ্চ সুন্দর চরিত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত।” -সূরা আল কালাম, আয়াত-৪

দৈহিক সৌন্দর্য ও চরিত্র মাধুর্যের দিক থেকে রাসূল মুহাম্মদ (সা:) ছিলেন অতুলনীয় ও অনুসরণযোগ্য একজন মহামানব।

রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দৈহিক সৌন্দর্য : “আনাস ইবনে মালিক (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা:) খুব দীর্ঘ ছিলেন না, আবার খাটোও ছিলেন না। তিনি ধবধবে সাদা কিংবা বাদামী বর্ণেরও ছিলেন না। তাঁর চুল একেবারে কোঁকড়ানো ছিল না, আবার একদম সোজাও ছিল না। ৪০ বছর বয়সে আল্লাহ তা’আলা তাকে নবুওয়াত দান করেন। এরপর মক্কায় ১০ বছর এবং মদিনায় ১০ বছর কাটান। আল্লাহ তা’আলা ৬০ বছর বয়সে তাঁকে ওফাত দান করেন। ওফাতকালে তাঁর মাথা ও দাড়ির ২০টি চুলও সাদা ছিল না।” সহীহ বুখারী, হা/৫৯০০; সহীহ মুসলিম, হা/৬২৩৫; মুয়াত্তা মালেক, হা/১৬৩৯; ইবনে মাজাহ, হা/১৩৫৪৩; মুসনাদুল বাযযার, হা/৬১৮৯; শারহুস সুন্নাহ, হা/৩৭৩৫; সহীহ ইবনে হিব্বান, হা/৬৩৮৭।

রাসূল (সা:) যে চাঁদের চেয়েও সুন্দর ছিলেন তাঁর সম্পর্কে সাহাবাগণের অভিমত, “আমরা এমন সুদর্শন মানুষ আর দেখিনি। আমরা তাঁর মুখ থেকে আলো বিকীর্ণ হতে দেখেছি।” (আলমাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২২৫)

“রাসূলুল্লাহ (সা:) থেকে সুদর্শন কাউকে আমি দেখিনি। মনে হতো যেন সূর্য ঝিকমিক করছে।” - আবু হোরায়রা (রা.)।

রাসূল (সা.)-এর মুখমণ্ডল ও চোখ : রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর মুখমণ্ডল ছিল সুন্দর ও আকর্ষণীয়। তাঁর চোখ ছিল কালো, পলক ছিল লম্বা ও চিকন। অর্থাৎ, তাঁর দিকে তাকালে মনে হত তিনি উভয় চোখে সুরমা লাগিয়েছেন। অথচ রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর চোখে সুরমা লাগানো থাকত না।

রাসূল (সা.)-এর নাক : রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর নাসিকা ঈষৎ লম্বাটে, একটু উঁচু এবং সূচারু তীক্ষè ছিল। (ইবনে আসাকের)। অর্থাৎ লম্বাটে গড়ন, মাঝখানে খানিকটা উঁচু, চিকন ও নাকের অগ্রভাগ তীক্ষ্ণ, যা নাসিকার সৌন্দর্যের একটি মাপকাঠি বলে বিবেচিত।

রাসূল (সা.) এর গাল : রাসূলুল্লাহ (সা:) এর গণ্ডদেশ ছিল পরিদৃষ্ট ও প্রস্ফুটিত। আম্মার ইবন ইয়াসির রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা:) তাঁর ডানে ও বামে এমনভাবে সালাম ফিরাতেন যে, তাঁর দু গালের শুভ্রতা দেখা যেতো। (ইবনে মাজাহ)

রাসূল (সা.)-এর গাত্রবর্ণ : আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর শরীরের রং এর বর্ণনা দিয়েছেন, তিনি বলেন, তাঁর শরীরের রং ছিল উজ্জ্বল, বিকশিত। ধবধবে সাদাও নয় কিংবা গাঢ় তামাটে বর্ণেরও নয়। (সহীহ বুখারী) অর্থাৎ উজ্জ্বল রঙ (“আযহারুল লাউন” যা লালিমা মিশ্রিত শ্বেত বর্ণ), ধবধবে সাদাও নয় কিংবা কৃষ্ণ বর্ণেরও নয়।

রাসূল (সা.)-এর দাঁড়ি : রাসূলুল্লাহ (সা:) এর দাঁড়ি ছিল কালো ও অতিশয় ঘন। তাঁর “দাঁড়ি খুব ঘন ছিলো”। (সহীহ মুসলিম)

আনাস ইবন মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন তার ইন্তেকাল হয় তখন মাথা ও দাঁড়িতে কুড়িটি চুলও সাদা ছিল না। (সহীহ বুখারী)

রাসূল (সা.)-এর চুল : রাসূলুল্লাহ (সা:) এর চুল ছিল মধ্যম ধরনের, অতিশয় কোঁকড়ানও ছিল না,আর সম্পূর্ণ সোজাও ছিল না। (সহীহ বুখারী) আল-বারা ইবনে আজেব রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসুল (সা:) প্রশস্ত কাঁধের অধিকারী ছিলেন, তাঁর চুল ছিল কানের লতি পর্যন্ত, আমি তাঁকে লাল চাদর পরিহিত অবস্থায় দেখেছি, তাঁর চেয়ে সুন্দর কোন কিছু আর কখনও দেখিনি। (শামায়েলে তিরমিযি)

রাসূলুল্লাহ (সা.) এর হাসি : কা’ব ইবন মালিক (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর হাসির বর্ণনা দিয়েছেন, তিনি বলেন, তাঁর মুচকি হাসিময় চেহারা খুশী ও আনন্দে ঝলমল করতো। মনে হতো যেন চাঁদের একটি টুকরো। তাঁর চেহারা মুবারকের এ অবস্থা থেকে আমরা তা বুঝতে সক্ষম হতাম তিনি ছিলেন স্মিত সহাস্য বদন, কতো মায়াবী, কতো দরদপূর্ণ একজন নবী, একজন মানুষ। (সহীহ বুখারী)।

রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য : রাসুল (সা.) অত্যন্ত বিনয়ী ও অমায়িক ব্যবহারের অধিকারী ও ক্ষমাশীল ছিলেন। সবসময় সত্য কথা বলতেন এবং ন্যায়বিচার করতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সহনশীল, সংযমী ও আত্মনিয়ন্ত্রিত। তিনি ছিলেন পরিপূর্ণ মানবিক গুণে সমন্বিত এক অসাধারণ মানুষ। ধৈর্যশীলতা, দয়াদ্র চিত্ততা, সংবেদনশীলতা, পরহিত ব্রততা, উদারতা ও ক্ষমাশীলতার মত হাজারো মানবিক গুণের সমাবেশে একজন আদর্শ অনুকরণীয় মহামানব ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা:)। তিনি ছিলেন ওয়াদা পালনকারী ও দায়িত্বশীল। সতত ন্যায় ও ইনসাফের ওপর প্রতিষ্ঠিত ।

রাসূল (সা:)-এর অন্যতম গুণাবলীর মধ্যে একটি হল লজ্জা। এ সম্পর্কে আবু সাঈদ আল-খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: অন্ত:পুরে পর্দায় থাকা বালিকার চেয়েও তিনি বেশী লজ্জা করতেন। তবে তিনি যদি কোন কিছু অপছন্দ করতেন তা আমরা তার মুখমণ্ডল থেকেই বুঝতে পারতাম।

মানবজাতির ইতিহাস অনুসন্ধানে দেখা যায়, অনেক গুণে গুণান্বিত মানুষদের মধ্যেও কোনো না কোনো মানবিক ত্রুটি লক্ষ করা গেছে। কিন্তু রাসুল মুহাম্মদ সা. ছিলেন মানবিকতার সর্বগুণে বিভুষিত এমন এক ব্যক্তিত্ব যার ক্ষেত্রে মুহূর্তকালের জন্যও কোনো বিষয়ে সামান্যতম ত্রুটি লক্ষ্য করা যায়নি। প্রাসঙ্গিকভাবে লক্ষণীয় বিষয় যে, শত্রুদের শত্রুতা, ভ্রষ্ট লোকদের ভ্রষ্টতা যতই বৃদ্ধি পেতো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সহনশক্তি ও ধৈর্য্যশীলতা ততোধিক বৃদ্ধি পেতো।

আয়েশা (রা.) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা:) ব্যক্তিগতভাবে তাঁর প্রতি কোনো অন্যায়ের প্রতিশোধ গ্রহণ করতে না। কিন্তু আল্লাহ- দ্রোহিতামূলক কোনো কাজ বা কথার তড়িৎ প্রতিশোধ নিতেন শুধু আল্লাহর উদ্দেশ্যে। তিনি সব সময় ক্রোধ ও প্রতিহিংসা পরায়ণতার ঊর্ধ্বে থাকতেন। (সহিহ বুখারী প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা-৫০৩)

রাসূলুল্লাহ (সা:) রাষ্ট্র ও জনপদে সর্বোচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েও সব শ্রেণি- পেশার মানুষের সাথে উদারনৈতিক যোগাযোগ অক্ষুণ্ন রাখতেন। সমাজের উঁচু নিচু ব্যক্তি মানুষের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক বজায় রাখতেন। তিনি ক্ষমাশীলতার অনন্য নজির স্থাপন করেছেন মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র তথা গোটা আরব বিশ্বের একজন রাষ্ট্রনায়ক হয়েও এবং মক্কা বিজয়ের দিনেও তার প্রাণের শত্রুদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার মধ্য দিয়ে।

জনবিচ্ছিন্নতা গর্ব ও অহংবোধ তার মধ্যে ছিল না। তিনি যে ভাতৃত্ববোধে কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিলেন তার অনিবার্যতা ছিল মানুষ বর্ণ-বৈষম্যহীনভাবে গভীর পারস্পরিক বন্ধনে আবদ্ধ থাকবে। অধুনা পাশ্চাত্য সভ্যতায় যে এলিগরি ভাবনার স্বার্থপরতা ও জনবিচ্ছিন্নতার সংস্কৃতি লালিত হচ্ছে রাসূলের যোগাযোগ ও আচরণসংস্কৃতি ছিল এর থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, মানবিক।

রাসূল মোহাম্মদ (সা:)-এর শিষ্টাচার ছিল ছোট বড় যার সাথে দেখা হতো প্রথমেই সালাম ও কুশল বিনিময় করতেন নিজ বাড়িতে প্রবেশকালে এবং বের হওয়ার কালে পরিবার-পরিজনদের সালাম প্রদান করতেন। বৈঠকাদিতে সাহাবাগণ তার সম্মান প্রদর্শনে উঠে দাঁড়ানোকে তিনি অপছন্দ করতেন। কারো ঘাড় না ডিঙিয়ে বৈঠকের এক পাশেই তিনি বসে পড়তেন। হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা:) বলেন, “আল্লাহর একজন সাধারন বান্দা যেভাবে উঠাবসা করে আমিও সেভাবেই উঠাবসা করি।”

রাসূল (সা:) যথেষ্ট গুরুত্বসহ রোগী দেখতে যেতেন মাথার কাছে বসে রোগীর অবস্থা জিজ্ঞেস করতেন। ললাটে ও শিরায় হাত রাখতেন। রোগীর জন্য উপকারী খাবার এনে দিতেন। সান্ত্বনা দিয়ে বলতেন চিন্তার কোন কারণ নেই আল্লাহ চাহেন তো অচিরেই তুমি রোগ মুক্ত হবে। তিনি এমন মানবদরদী ছিলেন যে রোগাক্রান্ত মুনাফিক নেতা, আব্দুল্লাহ বিন উবাইকে দেখতে গিয়েও সমবেদনা প্রকাশ করেছেন। কেউ মারা গেলে সাথে সাথে চলে যেতেন। মৃত ব্যক্তি মুসলিম ও ঋণমুক্ত থাকলে নিজেই জানাজা পড়াতেন এবং মৃতের গুনাহ খাতা মা’ফির জন্য দো’আ করতেন। রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন, “তোমাদের মধ্যে উত্তম সে, যে তার পরিবারের কাছে উত্তম। আমি আমার পরিবারের কাছে উত্তম।” - সুনানে তিরমিজি ৩৮৯৫, সুনানে ইবনে মাজাহ ১৯৭৭

নিজ স্ত্রীগণের সাথে উত্তম আচরণের দিক থেকে রাসূলুল্লাহ (সা:) অতুলনীয় দৃষ্টান্ত ছিলেন। স্ত্রী সন্তানাদি, নাতি নাতনিদের সাথে তার আচরণ যেমন ছিল অমায়িক ও দরদী, তেমনি সাহাবাগণের সাথেও তিনি এমন মানবিক আচরণ ও ভদ্রোচিত বাকরীতি প্রয়োগ করতেন, যার প্রভাব কারো মেধা ও মগজে পৌঁছার আগেই হৃদয় গহীনে পৌঁছে যেতো। সাহাবাগণও রাসূল (সা:) কে প্রাণ উজাড় করে ভালবাসতেন। সৈন্যদের সাথেও রাসূলের আচরণ ছিল উত্তম ও নসিহাপূর্ণ। রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর আচার-আচরণের এসব অনন্য বৈশিষ্ট্য তাঁর নবুওয়্যতের সত্যতার প্রমাণ বহন করে।

সমাপনীতে বলা যায়, যারা দা’ঈ ইলাল্লাহ হিসেবে আল্লাহর দ্বীন প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কাজে আত্মনিবেদিত হতে চান, তাঁদেরকে রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর অনুপম সুন্দর, পুতপবিত্র চরিত্র অর্জন করে রাসূল (সা:)-এর মতো প্রাঞ্জল ও হৃদয়গ্রাহী ভাষা ও আচরণে মানব সমাজের কাছে নিজেদেরকে উপস্থাপন করতে হবে। মানব দরদী হয়ে, মানুষের মন জয় করে ইসলামের সুমহান জীবন ব্যবস্থায় একটি মানবিক পৃথিবী গড়ে তুলতে হবে, যাতে করে আমাদের বর্তমান ও আগামী প্রজন্ম নিরাপদে ও নৈতিকতায় ঋদ্ধ একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে বেঁচে থাকতে পারে।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক।