রাফায়েল আহমেদ শামীম
বাংলাদেশের কৃষক আজ এক নিঃশব্দ সংগ্রামের মুখোমুখি। যারা দেশের মাটি উর্বর করে, যে কৃষকের ঘামেই গড়ে ওঠে জাতির খাদ্যনিরাপত্তা, সে কৃষকই আজ রাষ্ট্রীয় অবহেলার সবচেয়ে নির্মম শিকার। শহরের শিক্ষিত দুর্নীতিবাজেরা বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে, বিদেশে অর্থ পাচার করছে, প্রভাবশালী রাজনীতি করছে, অন্যদিকে মাঠের কৃষক ফসল বাঁচানোর জন্য হাহাকার করছে। সার সংকট এখন কেবল বাজারের সমস্যা নয়; এটি এক গভীর নৈতিক বিপর্যয়ের প্রকাশ, যেখানে রাষ্ট্রের দায়িত্ববোধ হারিয়ে গেছে, প্রশাসনিক কাঠামো ভেঙে পড়েছে। আর মানুষের বিবেক নিঃশেষ হয়েছে। সার সংকটের ভয়াবহতা বোঝা যায় যখন দেখা যায়, সরকারি নির্ধারিত ইউরিয়া সারের দাম ৮০০ টাকা হলেও কৃষককে দিতে হচ্ছে ১,১০০ টাকা পর্যন্ত। ডিলার ও পরিবেশকরা সরকারি রসিদ দেখিয়ে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করছে, অথচ প্রশাসন নির্বিকার। মাঠে ফসলের মৌসুমে কৃষক লাইনে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে সার পাচ্ছে না, অন্যদিকে সে সার রাতের অন্ধকারে পাচার হচ্ছে অন্য জেলায় বা সীমান্তের ওপারে। এক ভয়ংকর বাণিজ্যিক চক্র রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে গড়ে উঠেছে, যেখানে কৃষকের ঘামই পুঁজিপতিদের মুনাফার মূলধন। এ সংকট কেবল অর্থনৈতিক নয়; এটি প্রশাসনিক ভাঙনের প্রতিফলন। কৃষি অধিদপ্তরের তদারকি ব্যবস্থার ভেতর এখন এমন এক অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, যেখানে মাঠ পর্যায়ের তথ্য রাজধানীতে পৌঁছানোর আগেই বিকৃত হয়ে যায়। জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারা অনেক সময় নিজেদের দায়িত্ব থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন, ডিলারদের সঙ্গে আঁতাত করেন, সরকারি নীতিকে কাগজে আটকে রাখেন। মাঠে বাস্তবতা এক, রিপোর্টে লেখা হয় আরেক। সরকার হয়তো ভাবছে সার সংকট নেই, অথচ কৃষক বলছে, নির্ধারিত দামে সার পাওয়া যাচ্ছে না। এ প্রশাসনিক উদাসীনতা শুধু দুর্বলতা নয়, এটি এক ধরনের অজ্ঞাত ষড়যন্ত্র, যা কৃষকের মেরুদণ্ড ভাঙার সমান।
বাংলাদেশের কৃষি আজ এমন এক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যেখানে উৎপাদন ব্যবস্থার মূল ভিত্তিÑসারÑহয়ে উঠেছে দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীদের রাজনৈতিক অস্ত্র। রাষ্ট্রের উন্নয়ন বাজেট যতই বাড়ুক, মাঠে কৃষকের সমস্যার সমাধান হচ্ছে না, বরং প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এটি প্রমাণ করে, উন্নয়নের প্রবাহ উপরের দিকে ঘুরছে, নিচের দিকে নয়। কৃষক আজ নিজ ভূমিতেই প্রবাসী। তার শ্রমের মূল্য শহরের বাজারে নির্ধারিত হয়, তার উৎপাদনের উপকরণ ব্যবসায়ীদের গুদামে বন্দি থাকে। একদিকে সরকার প্রচার করছে কৃষি বিপ্লব, অন্যদিকে কৃষক নিজের ফসলের জন্য ঋণের বোঝা টানছে। এ বাস্তবতা রাষ্ট্রের জন্য এক পরম ব্যর্থতা। যে রাষ্ট্র নিজের কৃষককে সুরক্ষা দিতে পারে না, সে রাষ্ট্রের উন্নয়ন টেকসই হতে পারে না। কৃষি একটি মৌলিক নিরাপত্তা খাতÑখাদ্যের নিরাপত্তা মানেই রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা। কিন্তু আজকের সার সংকট দেখিয়ে দিচ্ছে, আমরা কৃষিকে উন্নয়নের মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছি। এই বিচ্ছিন্নতা কেবল নীতিগত নয়, এটি মানসিক।
শহরের শিক্ষিত মানুষরা কৃষকের পরিশ্রমকে তুচ্ছ জ্ঞান করে, অথচ তাদের জীবন সে পরিশ্রমের উপরই টিকে আছে। এ মানসিক দাসত্ব না ভাঙলে কৃষি কখনো পুনরুজ্জীবিত হবে না। এখন দেখা যাচ্ছে, সার বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে এক অদৃশ্য সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটে রয়েছে স্থানীয় রাজনীতিক, প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, কিছু প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং পরিবেশক চক্র। তারা কৃত্রিমভাবে সংকট তৈরি করে দাম বাড়ায়, সরকারকে ভুল তথ্য দেয়, তারপর আবার নিজেরাই সমাধানের নামে নতুন বরাদ্দ নেয়। এটি একধরনের কর্পোরেট নৈরাজ্য, যেখানে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়াই ব্যবসায়ীদের স্বার্থে বন্দি। কৃষক এখানে কেবল এক ব্যবহার্য চরিত্র, যার শ্রমের ফল অন্যের ভোগের উপকরণ। রাষ্ট্রের নীতিতে যতবার কৃষির নাম উচ্চারিত হয়, ততবারই প্রকৃত কৃষকের কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হয়ে যায়। আমরা এমন এক প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে আছি যেখানে দায়িত্বশীলদের কাছে মাঠের তথ্য কেবল পরিসংখ্যান। একজন কর্মকর্তা হয়তো রিপোর্টে লিখে ফেলেনÑ ‘দেশে সার সংকট নেই’; কিন্তু সে রিপোর্টের পেছনে লুকিয়ে থাকে হাজারো কৃষকের কান্না, শত শত জমির অনাবাদি পড়ে থাকা, খাদ্য উৎপাদনের হ্রাস। সার পেতে না পেরে কৃষকরা ঋণ নিচ্ছেন, অনেকে জমি বিক্রি করছেন, কেউ কেউ শহরে গিয়ে দিনমজুরের কাজ করছেন। কৃষি ছেড়ে মানুষ অন্য পেশায় ঝুঁকছে, কারণ কৃষি আর লাভজনক নয়। অথচ আমরা বারবার শুনিÑ ‘বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ’। এ বাক্যটি এখন এক নিষ্ঠুর ব্যঙ্গ ছাড়া আর কিছু নয়।
অর্থনীতির নিয়ম অনুযায়ী, উৎপাদনের মূল উপকরণ যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তবে উৎপাদনই ভেঙে পড়ে। সার হলো সে মূল উপকরণ যার অভাবে ফসলের ফলন কমে যায়, কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যায়, আর শেষ পর্যন্ত ভোক্তাও ভোগে। সার সংকটের প্রভাব কেবল কৃষকের মাঠে সীমাবদ্ধ নয়, এটি পুরো অর্থনীতিকে নাড়িয়ে দেয়। খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে, মুদ্রাস্ফীতি বাড়ে, সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হয়। রাষ্ট্র তখন এ সংকট ঠেকাতে আমদানির পথে হাঁটে, কিন্তু তাতে বৈদেশিক মুদ্রার উপর চাপ পড়ে। ফলে সার সংকট এক ধরনের অর্থনৈতিক শৃঙ্খলাবদ্ধ বিপর্যয়ে রূপ নেয়, যার প্রভাব সমাজের প্রতিটি স্তরে পড়ে। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাবও এখানে উপেক্ষা করা যায় না। বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম বেড়ে গেলে বাংলাদেশের সার উৎপাদন ব্যয় কিছুটা বাড়ে বটে, কিন্তু সে বৃদ্ধিকে এখানে অতিমাত্রায় দেখানো হয়। কিছু প্রভাবশালী আমদানিকারক ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠী সরকারকে ভুল তথ্য দিয়ে কৃত্রিম ঘাটতি দেখায়, যাতে তারা উচ্চমূল্যে সার আমদানি করে লাভ করতে পারে। এ কারসাজি কেবল অর্থনৈতিক নয়, এটি নীতিগত বিশ্বাসঘাতকতা। সরকারেরও উচিত ছিল তথ্য যাচাইয়ের জন্য স্বতন্ত্র মনিটরিং ইউনিট তৈরি করা, যাতে আমদানি ও বিতরণ উভয় পর্যায়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়। কিন্তু বাস্তবে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই। ফলে ব্যবসায়ীরা দাপটের সঙ্গে সার বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে, আর সরকার কেবল প্রশাসনিক নির্দেশনায় আটকে আছে। রাষ্ট্র যদি সত্যিই কৃষিকে বাঁচাতে চায়, তাহলে প্রথম কাজ হওয়া উচিত বাজারে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করা। মাঠ পর্যায়ে সার বিতরণে ডিজিটাল মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে, যাতে প্রতিটি বস্তার গতিপথ জানা যায়। যে ডিলার বা পরিবেশক নির্ধারিত দামের বেশি নেয়, তার লাইসেন্স বাতিল করতে হবে, আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। কৃষকের কাছে সরাসরি বিক্রির একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবেÑযেমন কৃষক কার্ডের মাধ্যমে নির্দিষ্ট পরিমাণ সার সরবরাহ। এতে মধ্যস্বত্বভোগীর আধিপত্য কমবে। কিন্তু সমস্যা কেবল প্রশাসনিক বা প্রযুক্তিগত নয়; এটি মানসিক ও নৈতিক। আজকের সমাজে কৃষককে আমরা সম্মান দিই মুখে, কিন্তু বাস্তবে তাকে অবজ্ঞা করি। শহরের শিক্ষিত মানুষরা কৃষকের পরিশ্রমকে তুচ্ছ জ্ঞান করে, অথচ তাদের জীবন সে পরিশ্রমের উপরই টিকে আছে। এ সামাজিক নৈতিকতার বিপর্যয়ই রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার মূল। যতক্ষণ না আমরা কৃষকের প্রতি মানবিক দায়িত্ববোধ জাগ্রত করতে পারি, ততক্ষণ এই সংকটের কোনো টেকসই সমাধান হবে না। অসাধু ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ ব্যবসায়ীরাই রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ফলে সরকার চাইলে ও চাইলেও তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারে না। এ অবস্থাকে বলা যায় রাষ্ট্রীয় পরাজয়Ñযেখানে প্রশাসন বাণিজ্যের কাছে নত হয়ে যায়, যেখানে কৃষক হয়ে ওঠে এক নিঃশব্দ শিকার।
আমরা প্রায়ই বলি, ‘কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে।’ কিন্তু বাস্তবে আমরা কৃষককে বাঁচতে দিই না। ভর্তুকির নাম করে সরকারি প্রকল্পে হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হয়, কিন্তু সেই টাকার একাংশও কৃষকের ঘরে পৌঁছায় না। উন্নয়নের কাগজে আমাদের কৃষি খাতকে নিয়ে অনেক সাফল্যের গল্প লেখা হয়, কিন্তু বাস্তবে কৃষক সেই গল্পের বাইরে। তার জীবনে উন্নয়ন মানে বাড়তি ঋণ, বেড়ে যাওয়া খরচ, আর সংকটে নিমজ্জিত ভবিষ্যৎ। সার সংকট তাই কেবল একটি মৌসুমি সমস্যা নয়, এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থাগত রোগ। এটি সেই রোগ, যেখানে দায়িত্বশীলরা নির্বিকার, আর ভুক্তভোগী নীরব। রাষ্ট্র যদি এখনই না জাগে, তবে এই সংকট কৃষিকে এমন এক বিন্দুতে নিয়ে যাবে, যেখান থেকে ফিরে আসা অসম্ভব। কৃষক উৎপাদনে অনুপ্রেরণা হারাবে, জমি অনাবাদি হবে, গ্রামীণ অর্থনীতি ভেঙে পড়বে, খাদ্যের দাম আকাশচুম্বী হবে-অবশেষে পুরো রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি কাঁপবে।
এ সংকটের সমাধান প্রযুক্তিতে নয়, নৈতিকতায়। রাষ্ট্রকে সিদ্ধান্ত নিতে হবেÑসে কৃষককেন্দ্রিক হবে, নাকি সিন্ডিকেটকেন্দ্রিক। কৃষকের ঘামকে মর্যাদা না দিলে, কোনো উন্নয়ন টেকসই হবে না। কৃষক শুধু উৎপাদক নয়, সে জাতির জীবনধারক। তাকে অবজ্ঞা করা মানে নিজের শিকড় কেটে ফেলা। আজ সময় এসেছে সরকারের, প্রশাসনের ও সমাজের একত্রে বিবেক জাগ্রত করার। কৃষকের ঘামকে মর্যাদা দাও, সারের বাজারে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনো, অসাধু ব্যবসায়ীদের দমন করো, মাঠে সরবরাহ নিশ্চিত করো। কারণ, যদি কৃষক মরে যায়, রাষ্ট্র টিকে থাকবে না। সার সংকটের সমাধান মানে শুধু কৃষি রক্ষা নয়. এটি রাষ্ট্রের আত্মা রক্ষার লড়াই।
লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক