এইচ এম জোবায়ের
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ছাত্রসমাজ সবসময় একটি অগ্রণী ও নির্ধারক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ, সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন থেকে গণতান্ত্রিক আন্দোলন- প্রতিটি বাঁকবদলে ছাত্রসমাজের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। এ কারণেই ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলো কখনও কেবল বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজকেন্দ্রিক প্রতিযোগিতা নয়; বরং তা জাতীয় রাজনীতির দিকনির্দেশক সূচক হিসেবেই বিবেচিত হয়। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে শিবির সমর্থিত প্যানেলের বড় সাফল্য প্রমাণ করেছে যে, শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিনের প্রচলিত ছাত্র রাজনীতির প্রতি আস্থা হারাচ্ছে। সামনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে- এ ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলো কি আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের ফলাফলেও প্রভাব ফেলবে? এ সংক্রান্ত বিষয়েই আজকের আলোচনা।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছাত্র রাজনীতির ভূমিকা সবসময়ই ছিল কেন্দ্রীভূত ও প্রভাবশালী। ছাত্রসমাজ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে বাঙালির ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলন পাকিস্তানি শাসনব্যবস্থার ভিত কাঁপিয়ে দেয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রনেতারাই ছিলেন আন্দোলনের অগ্রভাগে। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানে সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদের পতন ঘটিয়ে ছাত্রসমাজ আবারও ইতিহাস রচনা করে। এ ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, ছাত্র রাজনীতি কেবল ক্যাম্পাসে সীমাবদ্ধ নয়, বরং জাতীয় রাজনীতির প্রবাহ নির্ধারণে তা একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক।
ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে ইসলামপন্থী জোটের ব্যাপক সাফল্য শিক্ষাঙ্গনে একটি নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি করেছে। যেখানে দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল ক্যাম্পাস রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করেছে, সেখানে শিক্ষার্থীরা এবার বিকল্প শক্তি হিসেবে শিবিরকে বেছে নিয়েছে। শিক্ষার্থীদের এমন বৈপ্লবিক সিদ্ধান্তের পেছনে রয়েছে প্রচলিত সংগঠনগুলোর প্রতি আস্থাহীনতার কারণ। সহিংসতা, মাদক, টেন্ডারবাজি ও দলীয় স্বার্থসিদ্ধির রাজনীতিতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিরক্ত হয়ে উঠেছে। এখানে শিবিরকে তারা ব্যতিক্রম দেখেছে। শিবির তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে গ্রন্থাগার উন্নয়ন, আবাসন সমস্যা সমাধান, পরিবহন সুবিধা, পরীক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরেছে, যা সরাসরি শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত। পাশাপাশি শিবির দীর্ঘদিন ধরে একটি আদর্শভিত্তিক ও শৃঙ্খলাবদ্ধ সংগঠন হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছাতে তাদের নিরলস পরিশ্রম, গণসংযোগ ও ক্যাম্পাসে ইতিবাচক উপস্থিতি তাদের বিজয়ে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলো জাতীয় রাজনীতি এবং নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে কি-না? মোটা দাগে বলা যায়- অবশ্যই ফেলবে এবং জেন-জি হবে আগামী নির্বাচনের নীরব গেম-চেঞ্জার। বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন প্রজন্ম দ্রুত শক্তি সঞ্চয় করছে তারা- জেনারেশন জি বা জেন-জি। সাধারণভাবে ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে জন্ম নেওয়া এই প্রজন্ম এখন ভোটার তালিকায় দৃশ্যমান এক বিশাল অংশ। আগামী জাতীয় নির্বাচনে তারা কেবল সংখ্যায় নয়, চিন্তায় ও প্রবণতায়ও প্রথাগত রাজনৈতিক সমীকরণ বদলে দেওয়ার সম্ভাবনা রাখে। সংখ্যার শক্তি বড় ব্যাপার। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, নতুন ভোটারদের একটি বড় অংশই তরুণ, যাদের অধিকাংশ জেন-জি প্রজন্মভুক্ত। এই গোষ্ঠী একদিকে প্রথমবারের মতো ব্যালটের মাধ্যমে রাজনৈতিক মতামত প্রকাশ করতে যাচ্ছে, অন্যদিকে তাদের ভোট অনেক আসনে ফলাফল নির্ধারণে “ডিসাইসিভ” হয়ে উঠতে পারে। প্রচলিত রাজনীতির সঙ্গে জেন-জি’র দূরত্ব স্পষ্ট।
তারা দুর্নীতি, সহিংসতা, স্বজনপ্রীতি বা অতিরিক্ত দলীয় আনুগত্যকে অপছন্দ করে। চাকরি, দক্ষতা উন্নয়ন, স্টার্টআপ, জলবায়ু পরিবর্তন, সামাজিক ন্যায়বিচার কিংবা মানসিক স্বাস্থ্য- এসব প্রশ্ন তাদের রাজনৈতিক ভাবনার কেন্দ্রে অবস্থান করছে। এ প্রজন্ম মূলত ডিজিটাল-নির্ভর। তাদের রাজনৈতিক চেতনা গড়ে উঠছে ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক, ইনস্টাগ্রাম কিংবা এক্স-এর (টুইটার) মতো প্ল্যাটফর্মে। প্রচলিত প্রচারণার তুলনায় ভাইরাল ভিডিও, মেম বা অনলাইন ক্যাম্পেইনের প্রভাব তাদের কাছে বেশি কার্যকর। এর ফলে রাজনৈতিক দলগুলোকে বাধ্য হয়ে ডিজিটাল কৌশলে বিনিয়োগ বাড়াতে হচ্ছে। যদি জেন-জি সক্রিয়ভাবে ভোট দিতে বের হয়, তবে তারা বহু আসনে প্রচলিত সমীকরণ ভেঙে দিতে পারে। নির্বাচনে জয়ী হতে হলে প্রচলিত দলগুলোকে তরুণদের অগ্রাধিকারমূলক বিষয়গুলোকে নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কারণ বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প পেলে জেন-জি মূলধারার বাইরে নতুন নেতৃত্ব বা স্বতন্ত্র প্রার্থীকে সমর্থন করতে পারে। এ প্রজন্ম বাবা-মায়ের ‘ভোটিং ট্র্যাডিশন’ অন্ধভাবে অনুসরণ করবে না, ফলে ঐতিহ্যগত ভোটব্যাংক ভেঙে পড়তে পারে।
বর্তমানে দেশের ভোটার তালিকায় তরুণদের সংখ্যা প্রায় ৩ কোটির বেশি। এই তরুণদের বড় অংশই বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী। তারা যদি ক্যাম্পাস রাজনীতিতে ইসলামী ছাত্র শিবিরকে সমর্থন করে, তবে জাতীয় নির্বাচনেও সেই প্রভাব প্রতিফলিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। ডাকসু-জাকসু’র ফলাফল দেখিয়ে দিয়েছে যে প্রচলিত দুই দলের বাইরে শিক্ষার্থীরা বিকল্প নেতৃত্ব খুঁজছে। শিবির যদি এই প্রবণতা ধরে রাখতে পারে, তবে জাতীয় পর্যায়েও বিকল্প শক্তি হিসেবে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
বাংলাদেশের ইতিহাস বলছে- জাতীয় রাজনীতির বড় আন্দোলনের সূচনা হয় ছাত্রসমাজের হাত ধরে। শিবির যদি তাদের সাংগঠনিক অবস্থানকে কাজে লাগাতে পারে, তবে ভবিষ্যতের যেকোনো জাতীয় আন্দোলনে তারা নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হতে পারে। ছাত্র সংসদ নির্বাচন শুধু ভোটের খাতায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও জন আলোচনায় ব্যাপকভাবে প্রতিফলিত হয়। এর মাধ্যমে জনমতের একটি বড় ধারা তৈরি হয়, যা জাতীয় নির্বাচনেও প্রভাব বিস্তার করে।
ছাত্র সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। ডাকসু ও জাকসুতে ইসলামী ছাত্র শিবিরের বিজয় যে নতুন প্রবণতার সূচনা করেছে তা সামনে রাকসু ও চাকসু নির্বাচনে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এ প্রবণতা জাতীয় নির্বাচনে কীভাবে প্রতিফলিত হবে, তা এখনই বলা কঠিন হলেও ইতিহাস বলছে- ছাত্র সমাজের পরিবর্তিত মানসিকতা জাতীয় রাজনীতিতেও প্রভাব বিস্তার করে। তাই বলা যায়, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলো এক ধরনের ‘রাজনৈতিক লিটমাস টেস্ট’। লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক।