আলকামা সিকদার

ভোট বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার একটি প্রধান অনুষঙ্গ। ভোটের সাথে ভোটারের রয়েছে নিবড়ি সম্পর্ক। যার মাধ্যমে দেশের আপামর ১৮ কোটি মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর। নির্বাচন কমিশন কর্তৃক বিশেষ তালিকাভুক্ত প্রাপ্তবয়ষ্ক ব্যক্তিরা প্রত্যক্ষ ব্যালটে, সিল দেয়ার মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচন করে পবিত্র সংসদে প্রেরণ করে থাকেন তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি। মূলত আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও অধিকার দেশে প্রায় গত দেড় দশকে এক কলঙ্কতি অধ্যায়ে পরিনত হয়েছিল। সাধারণ বা বিশেষ যাই বলিনা কেন সকল শ্রেণীর জনগণই ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছিল প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে। আমরা বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় সাধারণ জনগণ আর ঐ অধ্যায়ে ফিরে যেতে চাই না। আমাদের নিজের ভোট যাতে নিজেই প্রয়োগ করতে পারি বা ভোট প্রয়োগের ক্ষেত্রে যাতে কোন বাধা বা ভয়ভীতির আশঙ্কা না থাকে সেটি আগে নিশ্চিত করতে হবে। জনগণের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে ভোট নামক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি। আমাদের ন্যায্য অধিকার ফিরে পেতে আমরা গত প্রায় দেড় দশকই আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি। শুধু মাত্র আমাদের ন্যায্য অধিকার ভোটাধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের জন্য।

গত স্বৈরাচারি সরকারের আমলে যতগুলো নির্বাচন সংগঠিত হয়েছে তার মধ্যে সবগুলোই ত্রুটিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। কোনো ভোটারই তার নিজের ভোট নিজে প্রয়োগ করতে পারেনি। দিনের ভোট আওয়ামী গুন্ডাপান্ডারা রাতে ব্যালটে সীল মেরে ব্যালট বাক্স ভরাট করে রেখেছে। ভোটের দিনের শুরুতেই ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ছিল খুবই স্বাভাবিক। ভোট কেন্দ্রে গুলি চলতো, ককটেল ফুটতো। আর এসব দেখে সাধারণ ভোটারগণ ভিত হয়ে আর ভোট কেন্দ্রের দিকে যেতে চাইত না। ভোট নামক প্রক্রিয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ঘরে বসে দিন কাটাতো। আর তাই এজন্যই ভোটারদের এখন প্রধান চাওয়া ও প্রত্যাশা হচ্ছে আগে ভোটাধিকারের নিশ্চয়তা দিতে হবে যে, একজন ভোটার বিনা বাধায় কেন্দ্রে গিয়ে নির্বিঘ্নে ঘরে ফিরে আসতে পারবে।

পৃথিবীর যে দেশেই জনগণের অধিকার হরণ করে স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছে সেখানেই কোন না কোনভাবে সে সরকারকে জনগণের রোষাণলে পড়তে হয়েছে। আমরা কিছুদিন পূর্বে দু,একটি দেশের দিকে তাকালে নিশ্চই বুঝতে পারবো গণতন্ত্র হরণ করলে পরিণতি কেমন ভয়াবহ হয়। শ্রীলংকায় নামে মাত্র জনগণের ম্যানডেট নিয়ে সরকার গঠন করে, অদূরদর্শি সরকার অপরিকল্পিত প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যেয়ে মহা দুর্নীতির আগ্রাসন বসিয়ে সে দেশের অর্থনীতি এমনভাবে পঙ্গু করে ফেলেছিল যার দরুন সাধারণ জনগণ দেশকে বাঁচাতে মাঠে নেমে পড়েছিল। সে দেশের মন্ত্রী-এমপিরা জনগণের ধাওয়া খেয়ে নর্দমায় পড়ে হাবুডুবু খেতে হয়েছে।

মায়নমারের স্বৈরাচারী নেত্রী অংসাং সূচির নিজস্ব মনোভাবের কারণে এবং কি ঐ দেশের সেনাবাহিনীর সাথে আঁতাত করে আরাকান নামক রাজ্য থেকে সে দেশের বৈধ নাগরিক মুসলমান রোহিঙ্গাদেরকে বিতাড়িত করে সে নিজেও ক্ষমতার আসনে টিকে থাকতে পারেনি। জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা যখন তলানীতে চলে যায় ঠিক তখন আর সরকারের কোন তোয়াক্কা করে না জনগণ। এখন কারাগারে দিন যাপন করতে হচ্ছে অংসাং সূচিকে। আর জনগণের আকাক্সক্ষাকে অবমূল্যায়ন করলে পরিণতি হয় ভয়াবহ।

প্রায় দেড় দশক আগে স্বৈরাচারি সরকার জনগণের অধিকারকে হরণ করে নিজের স্বেচ্ছাচারিতাকে কাজে লাগিয়ে দিনের পর দিন নিজের ক্ষমতা পরিপুষ্ট করতে ব্যস্ত সময় পার করছিল এবং দাম্ভিকতা ও অহমিকার উচ্চাসনে অধীন হয়ে জনগণকে নানাভাবে পিষ্টে মারছিল, তখন আর হাত গুটিয়ে বসে থাকেনি সাধারণ মানুষ। বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনয়নের জন্য মাঠে নেমে পড়েছে নিজেদের স্বার্র্থেই।

সরকার দেশের বিভিন্ন দপ্তর ও অধিদপ্তরকে যেভাবে ধ্বংস করেছিল, তেমনিভাবে বাংলাদেশের জনগণের ভাগ্য নির্ধারণের জায়গা নির্বাচন ব্যবস্থাকেও ধ্বংস করেছিল। গত দেড় দশকে বাংলাদেশের তিনটি সংসদ নির্বাচন যেমন কলঙ্কিত করেছে তেমনি জনগণকে বঞ্চিত করেছে তাদের সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকার থেকে। বাংলাদেশের মানুষ নির্বাচন এলেই উন্মূখ হয়ে থাকে উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে উৎসব মুখর পরিবেশে ভোট দেয়ার জন্য। কিন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসে গত ২০১৪, ২০১৮ ও সর্বশেষ ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হাতেগোনা ৭ থেকে ১০ শতাংশ ভোটার ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিলেও ৯০ শতাংশ মানুষই ভোট দিতে পারেনি বা ভোট দিতে যায়নি। এর পিছনের কারণ আমরা সকলেই জানি। সরকারের জনগণের উপর রক্ত চক্ষু দেখানো। নানাভাবে সাধারণ জনগণকে ভোট কেন্দ্রে যেতে নিরুৎসাহিত করা, দিনের ভোট রাতেই প্রদান করা, ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করা, একজনের ভোট অন্যজন দিয়েছে এমন তথ্য পাওয়া, আপনার ভোট কেন্দ্রে যেয়ে ভোট দেয়ার প্রয়োজন নাই এমন ভয় মূলক কথা ছড়ানোর ফলে জনগণের ভোট থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া।

দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ফলে স্বৈরাচারি সরকার যখন ৫ আগষ্ট ২০২৪ সালে পালাতে বাধ্য হয় এবং তার কয়েকমাস পার হতে না হতেই দেশের কিছু রাজনৈতিক দল নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরে। স্বৈরাচারি সরকার পালানোর পর অন্তর্বর্তী সরকার নানা দফতরে সংস্কার নিয়ে কাজ করছে এবং বিভিন্ন সংস্কার কমিশন তৈরি করে সুপারিশ গ্রহণ করছে সরকার। যাতে দেশকে একটা স্বচ্ছতার মধ্যে নিয়ে এসে আন্তার্জাতিক মানদণ্ডে পৌঁছানো যায়। স্বচ্ছ নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে সঠিক ও সুন্দর একটি নির্বাচন পরিচালনা করা যায়। কিন্তু সৈরাচারের দোসররা কেউ কেউ বলেও বেড়াচ্ছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নাকি নির্বাচন পরিচালনা করবেন না, দীর্ঘ সময় নিয়ে তারা সরকার পরিচালনা করবেন। কিন্তু সরকারের ঘোষণা হচ্ছে যথাসাধ্য সংস্কার করেই নির্বাচন পরিচালনা করা হবে। এখন কথা হচ্ছে নির্বাচন পরিচালনা করলেই কি জনগণ আনন্দিত হয়ে উৎসাহ নিয়ে তাতে অংশগ্রহণ করবে? না কি জনগণকে সম্পৃক্ত করতে সরকারকে নির্বাচনি ব্যবস্থায় সংস্কার, পরিবর্তন ও আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। উত্তর একটাই জনগণের মধ্যে আগে নির্বাচন ব্যবস্থায় আস্থা ফেরানোটাই বিশেষ জরুরি। জনগণকে নির্বাচন মুখী করতে আগে তাদের মধ্যে এখন বিশ্বাস যোগ্যতা অর্জন করাটাই অতীব প্রয়োজন।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী