মমতাজ উদ্দিন আহমদ
মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী; অর্থহীন নয়। এ ক্ষণস্থায়ী জীবনে মানুষ চায় সাফল্য। আধুনিক সমাজে সাফল্যের সংজ্ঞা প্রায়ই জাগতিক সম্পদের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু ইসলামে প্রকৃত সাফল্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। মুমিনরা এ পার্থিব জীবনকে একটি পরীক্ষার ক্ষেত্র হিসেবে দেখে, যেখানে তাদের মূল লক্ষ্য হলো পরকালের অনন্ত জীবনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া। কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনা এবং আধুনিক জীবনের চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখেই মুমিনরা এই পথে এগিয়ে চলে।
ইসলামের মূল ভিত্তিই হলো আল্লাহর ওপর গভীর বিশ্বাস ও নির্ভরতা। মুমিনের জীবন আল্লাহর কাছে উৎসর্গীকৃত। আল্লাহ কুরআনে বলেন, “বলো, আমার নামাজ, আমার কুরবানি, আমার জীবন, আমার মরণ-সবই আল্লাহর জন্য।” (সূরা আন’আম: ১৬২)। এ আয়াতটি মুমিনের জীবনদর্শনের মূলমন্ত্র। তারা মনে করে, তাদের জীবনের প্রতিটি কাজ, প্রতিটি সিদ্ধান্ত আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হওয়া উচিত।
আধুনিক যুগে এ বিশ্বাস একটি শক্তিশালী মানসিক ঢাল হিসেবে কাজ করে। যখন মানুষ জীবনের নানামুখী চাপ, ব্যর্থতা বা হতাশায় ভেঙে পড়ে, তখন মুমিনের মনে আল্লাহর ওপর ভরসা থাকে। তারা জানে, সবকিছু আল্লাহর ইচ্ছায় হয় এবং তার পরিকল্পনাতেই কল্যাণ নিহিত আছে। এ বিশ্বাস তাদের হতাশামুক্ত থাকতে সাহায্য করে।
আল্লাহ বলেন, “তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সব গোনাহ মাফ করবেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (সূরা যুমার: ৫৩)। এ আয়াতটি মুমিনদের মনে সাহস জোগায় এবং জীবনের কঠিন সময়েও তাদের দৃঢ় রাখে।
মুমিনের প্রতিটি কাজ, প্রতিটি সম্পর্ক-সবকিছুই আল্লাহর সন্তুষ্টির ওপর নির্ভরশীল। সে আল্লাহর জন্যই বন্ধুত্ব করে, আবার আল্লাহর জন্যই শত্রুতা পোষণ করে। এ ত্যাগ ও উৎসর্গীকৃত জীবনের প্রতি আল্লাহ বড়ই মেহেরবান। আল্লাহ তায়ালা সূরা লাইলের ২০-২১ আয়াতে বলেন, “সে তো শুধু মহান রবের সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে এ কাজ করে। অবশ্যই তিনি (তার উপর) সন্তুষ্ট হবেন।”
যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পরস্পরকে ভালোবাসে, কিয়ামতের কঠিন দিনে তাদের জন্য রয়েছে মহাপুরস্কার। সেদিন যখন কেউ কাউকে চিনবে না, তখন আল্লাহ তাদের আরশের ছায়ায় আশ্রয় দেবেন। মহানবি (সা.) বলেছেন, “কেয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা বলবেন, যারা আমার জন্য পরস্পরকে ভালোবাসতে, তারা কোথায়? আজ তোমাদেরকে আমার আরশের ছায়ায় আশ্রয় দেব। আজ আমার আরশের ছায়া ব্যতীত অন্য কোনো ছায়া নেই।” (মুসলিম: ৪৬৫৫)।
আধুনিক জীবন ব্যবস্থা মানে শুধু অর্থ উপার্জন বা পেশাগত সাফল্য নয়, বরং একটি সুশৃঙ্খল ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবন। মুমিনরা কুরআন-হাদীসের আলোকে তাদের জীবনকে পরিচালিত করে।
সময় ব্যবস্থাপনা : ইসলামে সময়ের গুরুত্ব অপরিসীম। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ সময়মতো আদায় করা সময়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ারই এক প্রশিক্ষণ। মহানবি (সা.) বলেছেন, একজন মুমিন কীভাবে তার সময়কে সঠিকভাবে কাজে লাগাবে। তিনি বলেন, “তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সে ব্যক্তি, যে মানুষের উপকার করে।” (মুসনাদে আহমাদ)। আধুনিক জীবনে সময় ব্যবস্থাপনার কৌশলগুলো মুমিনদের জন্য অত্যন্ত কার্যকর, যখন তারা নিজেদের কাজ, পরিবার এবং সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালন করে।
নৈতিকতা ও পেশাগত জীবন : আধুনিক পেশাজীবনে সততা, বিশ্বস্ততা এবং নৈতিকতার অভাব দেখা যায়। কিন্তু ইসলামে এ গুণগুলো অত্যাবশ্যক। মুমিনরা হালাল উপায়ে উপার্জন করে, আমানতের খিয়ানত করে না এবং ওয়াদা রক্ষা করে। মহানবি (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আমানত রক্ষা করে না, তার কোনো ঈমান নেই; আর যে ব্যক্তি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে না, তার কোনো ধর্ম নেই।” (মুসনাদে আহমাদ)। এ আদর্শগুলো আধুনিক পেশাগত জীবনের জন্য এক শক্তিশালী নৈতিক ভিত্তি তৈরি করে।
সম্পর্কের ব্যবস্থাপনা : আধুনিক সমাজ প্রায়শই ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে, যেখানে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন দুর্বল হয়। কিন্তু ইসলামে পারিবারিক সম্পর্ক রক্ষা করা এবং মানুষের সঙ্গে ভালো আচরণ করাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মহানবি (সা.) বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সে, যে তার পরিবারের প্রতি উত্তম।” (তিরমিযী)। এ হাদিস মুমিনদের পরিবার ও সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল হতে শেখায়।
জীবন ও ইসলামের সম্পর্ক হলো এক ভারসাম্যপূর্ণ জীবনদর্শনের। এখানে পার্থিব জীবনের সাফল্যকে পুরোপুরি অস্বীকার করা হয় না, বরং তা পরকালের সাফল্যের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। মুমিনরা বিশ্বাস করে, আল্লাহ তাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গী। যখন তারা আল্লাহর ওপর ভরসা রাখে, তখন তাদের অন্তর শান্তি ও স্থিরতা লাভ করে।
আধুনিক জীবনের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে মুমিনরা কুরআন-হাদীসের নির্দেশনাকে তাদের পথপ্রদর্শক হিসেবে গ্রহণ করে। তারা জিনা-ব্যভিচার, মিথ্যা এবং প্রতারণা থেকে দূরে থাকে। তারা জানে, জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আল্লাহর রহমতের দরজা খোলা থাকে। এভাবেই মুমিনরা একটি অর্থপূর্ণ ও সফল জীবন লাভ করে, যা কেবল পার্থিব নয়, বরং পরকালেও তাদের জন্য অনন্ত শান্তি বয়ে নিয়ে আসে।
লেখক : সাংবাদিক।