প্রফেসর আর. কে. শাব্বীর আহমদ
ব্যক্তির শুদ্ধতা ও কলুষমুক্ত সমাজ গঠনের জন্য আত্মশুদ্ধির চর্চা অপরিহার্য। আত্মশুদ্ধি মানে নিজের মনন ও কর্মশক্তিকে পবিত্র ও মানবিক পথে পরিচালনা করার নিরন্তর প্রচেষ্টা। পবিত্র ও ক্লেদ-কালিমামুক্ত ব্যক্তি উভয় জগতে সাফল্য লাভ করে। আল্লাহ তা’আলার ঘোষণা : “সে নিশ্চিত সফলতা লাভ করলো যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করলো, আর সে ধ্বংস হলো যে দুশ্চরিত্র হলো।” -সূরা আশ শামস, আয়াত-৯-১০
আত্মশুদ্ধির আরবি পরিভাষা হলো ‘আত তাযকিয়াতুন নাফস’। অর্থ প্রবৃত্তির পরিশুদ্ধতা। আল্লাহ তা’আলা রাসূল (সা:)মকে দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন মানুষকে পাপ পঙ্কিলতা থেকে পবিত্র পরিশুদ্ধ করার জন্য। আল্লাহ তা’আলার ঘোষণা : “তিনি সেই সত্তা যিনি অজ্ঞদের মাঝে রাসুল পাঠিয়েছেন তার নিদর্শনসমূহ বর্ণনা করার জন্য এবং তাদেরকে পবিত্র-পরিশুদ্ধ করার জন্য, আল্লাহর কিতাব এবং বুদ্ধিমত্তা প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য।” -সূরা আল জমু’আহ, আয়াত-২
চিন্তা চেতনা মননে পরিশুদ্ধ ব্যক্তি পারে একটি নির্মল পরিচ্ছন্ন নিরাপদ সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে। তাইতো রাসূলে আকরাম (সা:) প্রতিনিয়ত মানুষের চরিত্র সংশোধন ও সুন্দর করার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। বর্বর অসভ্য কলুষ ও নিষ্ঠুর মানুষদের গড়ে তুলেছিলেন দয়াদ্র মানবিক সোনার মানুষে। রাসূলুল্লাহ (সা:) ছিলেন নিষ্কলুষ, পবিত্র, অনুসরণীয় অনুকরণীয় এক অনুপম চরিত্রের মানুষ। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা তাঁর চরিত্র-মাধুর্যের সনদ দিয়েছেন এভাবে : “ নিশ্চয়ই আপনি মহা উন্নত চারিত্রিক সৌন্দর্যের উপর প্রতিষ্ঠিত।” - সূরা আল কালাম, আয়াত-৪
মানব চরিত্রকে উন্নত করার জন্য আল্লাহ তা’আলা রাসূলকে অনুসরণ ও অনুকরণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন এভাবে : “রাসূল তোমাদের জন্য যে নির্দেশিকা নিয়ে এসেছেন তাকে তোমরা শক্তভাবে আঁকড়ে ধরো। আর যা কিছু করতে নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকো।” -সূরা আল হাশর, আয়াত-৭
নফস বা প্রবৃত্তিকে উন্নত করার জন্য রাসুলের জীবন ও কর্মকে অনুসরণ করা মানুষের জন্য অতি আবশ্যক। আল্লাহ তাআলা আল কুরআনে মানুষের নফস বা আত্মাকে তিন রকম বলে উল্লেখ করেছেন:
১. নফসে আম্মারা- সরাসরি কুপ্রবৃত্তির অনুসরণকারী আত্মা। আল্লাহ তাআলার ভাষায় : নিশ্চয়ই নফসে আম্মারা মন্দ কাজের নির্দেশ দেয়।” - সূরা ইউসুফ, আয়াত-৫২
২. নফসে লাউয়ামা- মানুষের নিজের কুপ্রবৃত্তিকে তিরস্কৃত করার মতো নফস বা আত্মা। আল্লাহ তাআলার ভাষায় : “আমি কসম করছি আত্মভৎসনাকারী আত্মার।” - সূরা আল কিয়ামাহ, আয়াত-২
৩. নফসের মুতমাইন্না- মানুষের পবিত্র, নিষ্কলুষ প্রশান্ত নফস বা আত্মা।
পবিত্র নিষ্কলুষ প্রশান্ত আত্মাকে আল্লাহ তা’আলা ডেকে ডেকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন আল্লাহর ভালোবাসাপূর্ণ অমায়িক ভাষায় : “হে পবিত্র প্রশান্ত আত্মারা, ফিরে এসো তোমার রবের সন্তোষের দিকে, প্রবেশ করো আমার অনুগত বান্দাদের মাঝে সুখময় স্থান জান্নাতে।” -সূরা- আল ফাজর, আয়াত-২৭-৩০
মানুষের নফস বা আত্মাকে কুপ্রবৃত্তির দিকে ধাবিত করে শয়তান। শয়তান দু রকমের : জিন শয়তান ও মানুষ শয়তান। এ শয়তান মানুষের অন্তরে কুমন্ত্রণা দেয়। আল্লাহ তা’আলা কুমন্ত্রণা দানকারী জিন শয়তান ও মানুষ শয়তান থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনার জন্য দো’আ করতে শিখিয়েছেন এভাবে : “বল আমি আশ্রয় প্রার্থনা করছি মানুষের রবের কাছে, মানুষের মালিকের কাছে, মানুষের আইনদাতা বিধানদাতার কাছে। যে মানুষের অন্তরে কুমন্ত্রণা দেয়। কুমন্ত্রণা দানকারী জীন শয়তান ও মানুষ শয়তান থেকে আশ্রয় চাই।” -সূরা- আন নাস।
শয়তান মানুষের অন্তরে চরিত্র বিধংসকারী কুমন্ত্রণা দেয়। ফলে মানুষ ধোঁকা প্রতারণা ব্যভিচার মিথ্যাচার সন্ত্রাস ও স্বেচ্ছাচারিতায় লিপ্ত হয়। আল্লাহর গোলামীর পরিবর্তে মানুষের গোলামী করতে শুরু করে। মানুষের তৈরি আইন বাস্তবায়নের জন্য প্রচেষ্টা চালায়। জাতীয়তাবাদ সমাজতন্ত্র পুঁজিবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী মতবাদের অনুসরণ করে আল্লাহর আইনের বিরোধিতা করে। এভাবে শয়তান বিভিন্ন কৌশলে মানুষের ঈমানকে বিনষ্ট করার চেষ্টা চালায়।
সত্যিকারের চরিত্রবান ও মুত্তাকী হওয়ার জন্য এবং শয়তানের ধোঁকা থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য আল্লাহর ফরজ ইবাদত এর পাশাপাশি নফল ইবাদতেও মানুষকে অভ্যস্ত হতে হবে। পাপ কাজে আল্লাহর শাস্তির ভয় সব সময় অন্তরে জাগ্রত রাখতে হবে। সবচেয়ে বড় নফল ইবাদত হলো, নিয়মিত কুরআন তেলাওয়াত করা ও এর অর্থ অনুধাবন করা। এতে ব্যক্তি নিজেকে পরিশুদ্ধ করে একটি নৈতিকতাপূর্ণ সুস্থ সমাজ বিনির্মাণে উৎসাহী হবে।
আত্মশুদ্ধির জন্য আত্মসমালোচনা অপরিহার্য। আত্মসমালোচনার আরবি পরিভাষা ‘ ইহতিসাব ‘। অর্থাৎ নিজের ভালো-মন্দ কর্মের হিসেব নিজেই নিয়মিত করা। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালার বাণী : কেয়ামতের দিন আল্লাহ তা’আলা আমলনামা হাতে দিয়ে বলবেন, “আপন কর্মের রেকর্ড পড়। আজ তোমার নিজের হিসাব করার জন্য তুমিই যথেষ্ট।” - সূরা বনি ইসরাঈল, আয়াত- ১৪
এ চেতনাকে সামনে রেখে প্রত্যেকের দৈনন্দিন কাজের হিসেব রাখা প্রয়োজন। ভালো কাজের জন্য আল্লাহ তা’আলার শোকর আদায় করা, সাওয়াবের প্রত্যাশা করা। আর মন্দ কাজের জন্য আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করে ইস্তেগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা করে এমন মন্দ কাজ আর না করার শপথ গ্রহণ করা প্রয়োজন, যাকে আরবিতে তাওবা বলা হয় ।
এমন তওবাকারী মুত্তাকী ব্যক্তিগণ প্রকৃত আত্মশুদ্ধকারী মানুষ। এদের হাতে সমাজের নেতৃত্ব অর্পিত হলে সে সমাজ দুর্নীতি ও সন্ত্রাসমুক্ত হবে। মানুষ ন্যায়বিচার ও মৌলিক অধিকার লাভ করে একটি নিরাপদ ও সুখী সমাজে বসবাস করতে পারবে।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক।