শুল্ক নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী ভারত রীতিমত বড় ধরনের বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে। বিষয়টি নিয়ে ভারত একটি সম্মানজনক ও গ্রহণযোগ্য সমাধানের প্রচেষ্টা চালালেও এখন পর্যন্ত কোন আশার আলো দেখা যায় নি বরং যতই দিন যাচ্ছে সার্বিক পরিস্থিতি ততই অবনতির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ফলে বিশ্বের বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারত রীতিমত অস্বস্তিতে পড়েছে।
মূলত, এক মেয়াদ পর চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি পুনরায় হোয়াইট হাউসে গিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। শপথ নেওয়ার পরপরই ২শটিরও বেশি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেন ট্রাম্প। পূর্বঘোষণা অনুসারে দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিনেই তিনি বেশকিছু চমক দিয়েছেন। ট্রাম্পের এ চমক ও বিতর্কিত সিদ্ধান্তে রীতিমতো সৃষ্টি করে নানাবিধ আলোচনা-সমালোচনা।
ট্রাম্পের সবচেয়ে বড় বিতর্কিত ফরমান ছিলো বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের ওপর মাত্রাতিরিক্ত শুল্কারোপ। বাংলাদেশের ওপর একইভাবে বড় ধরনের ওপর শুল্কারোপ করা হলেও তা আলোচনার মাধ্যমে মোটামোটি সহনীয় পর্যায়ে আনা হয়েছে। তবে ভারত ও চীনের বিষয়টি এখনো অমীমাংসিতই রয়ে গেছে। ২৭ আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া ভারতীয় পণ্যের ওপর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরোপ করা ২৫ শতাংশ শুল্ক দ্বিগুণ হয়ে ৫০ শতাংশে দাঁড়াবে। এতে টিকে থাকা অনেক ব্যবসা মুহূর্তেই ভেঙে পড়তে পারে। শুল্ক বাড়ার ফলে বিদেশি অর্ডার বন্ধ হয়ে যাবে। পাশাপাশি কর্মসংস্থান হারাবেন লাখ লাখ খেটে খাওয়া মানুষ। যা ভারতকে অনেকটা অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে।
ভারতে কার্পেট একটি বড় ব্যবসা। এখানকার উৎপাদিত ৯৮ শতাংশ কার্পেট বিদেশে রপ্তানি হয়। এর মধ্যে হাতে তৈরি কার্পেটের বাণিজ্যই সবচেয়ে বেশি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রায় ৬০ শতাংশ কার্পেট যুক্তরাষ্ট্রে গেছে। এখন মার্কিন আমদানিকারকদের একটি ৫০০ ডলারের কার্পেটের জন্য ২৫০ ডলার পর্যন্ত শুল্ক দিতে হতে পারে।
ভাদোহি ভারতের কার্পেট শিল্পের কেন্দ্রবিন্দু। এখানে বৃহদাকার ‘আজাজ কার্পেটস’-এর মতো শত শত উৎপাদক রয়েছে। এ শুল্কের কারণে তাদের লাভ প্রায় শেষ হয়ে যাবে। সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন, এ অঞ্চলের প্রায় ২৫ লাখ মানুষ চরম দারিদ্রে পড়বে।
একই রকম সংকটে পড়তে যাচ্ছে আরও কয়েকটি শিল্প। এর মধ্যে রয়েছে বস্ত্র ও পোশাক, চিংড়ি চাষ এবং আসবাবপত্র। এ শিল্পগুলো ভারতের সবচেয়ে চাকচিক্যময় ব্যবসা না হলেও, এগুলোর মাধ্যমে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়। আর এসব শিল্প থেকে অর্জিত কোটি কোটি ডলার ভারতের অর্থনীতিকে নানা সংকটের সময়েও শক্তিশালী রাখতে সাহায্য করেছে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, গত বছর ভারত-মার্কিন বাণিজ্য ছিল ১২৯ বিলিয়ন ডলারের। সে তুলনায় কার্পেট ব্যবসা খুব বড় অংশ না হলেও, এ শুল্ক দু’দেশের মধ্যকার বড় বাণিজ্যিক সম্পর্কেও প্রভাব ফেলছে। ভারতের ওষুধ শিল্পও একটি বড় উদাহরণ। যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবহৃত জেনেরিক ওষুধের একটি বড় অংশ ভারত সরবরাহ করে। ট্রাম্প প্রশাসন আপাতত ভারতীয় ওষুধের ওপর শুল্ক ছাড় দিলেও, ভবিষ্যতে ১৫০ থেকে ২৫০ শতাংশ শুল্ক বসানোর হুমকি দিয়েছে। ট্রাম্পের ধারণা, এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রে ওষুধের উৎপাদন বাড়বে।
একইভাবে, সেমিকন্ডাক্টরের মতো পণ্যে ছাড় থাকায় ভারতের ইলেক্ট্রনিক্স উৎপাদন শিল্প বাঁচতে পারবে কিনা, তা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। অ্যাপল চীনের বদলে ভারতে আইফোন উৎপাদন শুরু করার পর এ শিল্প বেশ ভালো করছিল। তেল ও গ্যাসের বিষয়টাও বেশ জটিল। জ্বালানি পণ্য এখনো শুল্কের বাইরে রয়েছে। কিন্তু ট্রাম্প ভারতের রুশ তেল কেনার বিষয়টিকে ব্যবহার করে অন্যান্য পণ্যের ওপর শাস্তিমূলক শুল্ক আরোপ করছে।
ভারতীয় কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, ট্রাম্পের অভিযোগ ছিল বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে। ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেশি জ্বালানি ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কিনে সে ঘাটতি কমানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক এ শুল্ক বৃদ্ধি দেখে মনে হচ্ছে, এটি ভূ-রাজনৈতিক কারণে হচ্ছে, বিশেষ করে রাশিয়ার কাছ থেকে ভারতের তেল কেনার বিষয়ে ট্রাম্পের অসন্তোষই এর মূল কারণ। মূলত, এ শুল্ক ভারতের রত্ন ও গয়না শিল্পেও বড় ক্ষতি করতে পারে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় রত্নের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। শিল্প সমিতির চেয়ারম্যান কিরিট ভানসালি বলেন, ব্যাপক শুল্ক এ খাতের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হবে। এর ফলে তুরস্ক ও থাইল্যান্ডের মতো প্রতিযোগী দেশগুলো ভারতের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে চলে যাবে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসাগুলোকে বাঁচাতে সরকারের কোনো পরিকল্পনা এখনও দেখা যাচ্ছে না। নয়াদিল্লির একটি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক, গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের অজয় শ্রীবাস্তব বলেছেন, রাজ্য সরকারগুলো বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সবসময় কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর নির্ভরশীল। তবে ভারত বিষয়টি নিয়ে মার্কিনীদের সাথে আপোষরফার চেষ্টা করলেও তাদের ভিন্ন চিন্তাও রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সম্প্রতি তার এক ভাষণে কঠিন সময়ের কথা উল্লেখ করে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘একটি জাতি অন্যের ওপর যত বেশি নির্ভরশীল হবে, তার স্বাধীনতা তত বেশি প্রশ্নের মুখে পড়বে।’ তবে, যেসব অর্থনীতিবিদরা মুক্ত বাণিজ্যকে ভারতের সমৃদ্ধির সোপান বলে মনে করতেন, তাদের কাছে মোদীর এ বক্তব্য একটি পশ্চাৎপদ পদক্ষেপ বলে মনে হচ্ছে।
ভারতীয় কার্পেট রপ্তানিকারক ইশতিয়াক আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সুফলের কথা তুলে ধরে বলেন, তার অঞ্চলের ৮০ শতাংশ কর্মীই কৃষক। তারা বছরে বেশিরভাগ সময় ধান, গম ও সবজি চাষ করে। কিন্তু কার্পেট শিল্পের টুকটাক কাজ, যেমন সুতা কাটা, রং করা বা নকশা তৈরি করে বহু পরিবার মাসে অতিরিক্ত ১৭০ ডলার আয় করে। এ বাড়তি আয় তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সাহায্য করে। তার ভাষায়, সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি হবে আমাদের গ্রামের মানুষ, গুমিক ও তাঁতিদের। যদি দু’দেশের সরকার কোনো সমাধানে না আসে, তাহলে তাদের আর কোনো উপায় থাকবে না।
অবশ্য ভারত সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলোচনার মাধ্যমে একটি সম্মানজনক সমাধানের প্রচেষ্টা চালিয়ে এসেছে। তাদের এ প্রচেষ্টার অংশ হিসাবেই মার্কিন প্রতিনিধি দল ভারত সফর করার কথা। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে বেশ অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আগস্টের দ্বিতীয়ার্ধে ওয়াশিংটন থেকে আলোচনায় অংশ নিতে আসার কথা ছিল মার্কিন প্রতিনিধিদলের, কিন্তু সেটি আপাতত স্থগিত করা হয়েছে বলে ভারতীয় কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে জানিয়েছে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। গত ফেব্রুয়ারি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফরের পর শুরু হওয়া এ আলোচনাকে ঘিরে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে এমন সময়ে, যখন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন যা বিশ্বের যেকোনো দেশের জন্য সর্বোচ্চ। এরই মধ্যে ২৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, রাশিয়া থেকে তেল আমদানির কারণে বাকি ২৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকরের বিষয়টি ‘ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল’।
আলোচনায় অচলাবস্থার মূল কারণ ভারতের দীর্ঘদিনের অবস্থান প্রতিটি বাণিজ্য চুক্তিতে কৃষকদের স্বার্থ সুরক্ষা। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন ভারতের কৃষিপণ্যের বাজারে প্রবেশাধিকার পেতে আগ্রহী। বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চললেও তাতে কোনো ইতিবাচক ফল পাওয়া যায়নি। ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে মোদি বলেন, কৃষক, জেলে ও গবাদিপশুপালকদের স্বার্থে ভারত কোনো আপস করবে না। এর আগে ৭ আগস্ট ট্রাম্পের ঘোষিত অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্কের পরও মোদি জানিয়েছিলেন, ‘প্রয়োজনে ব্যক্তিগতভাবে বড় মূল্য দিতে হলেও’ তিনি আপস করবেন না।
মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট সতর্ক করেছেন, আলোচনায় অগ্রগতি না হলে রাশিয়ার সঙ্গে তেল বাণিজ্যের কারণে ভারতের ওপর ‘দ্বিতীয় দফা শুল্ক’ বাড়তে পারে। ব্লুমবার্গকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করেছিলাম পুতিন আরও গঠনমূলকভাবে আলোচনায় বসবেন। মনে হচ্ছে তিনি হয়তো আলোচনায় রাজি হচ্ছেন। তবে যদি পরিস্থিতি ভালো না হয়, ভারতের ওপর নিষেধাজ্ঞা বা শুল্ক বাড়তে পারে।’
ভারত সরকারের একজন মুখপাত্র জানিয়েছে, ‘ষষ্ঠ দফার দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক আলোচনার জন্য ভারত সফরে আসার পরিকল্পনা ছিল মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি দলের। আগামী ২৫ আগস্ট থেকে ২৯ আগস্ট পর্যন্ত এ আলোচনা হওয়ার কথা ছিল। সে সফর পিছিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মার্কিন সরকার। এর আগে দু’দফায় ভারতের উপর ৫০ শতাংশ শুল্ক ধার্য করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর প্রভাবে দু’দেশের বাণিজ্য ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়। বাণিজ্য প্রতিনিধিদেলর ষষ্ঠ দফার আলোচনার দিনক্ষণ প্রকাশিত হওয়ার পর অনুমান করা হচ্ছিল, অনিশ্চয়তার সে মেঘ এবার হয়তো কেটে যাবে। শুল্কের উপর কিছু ছাড়ও মিলতে পারে বলে আশা করছিলেন অনেকে। কিন্তু আগস্টের এ বৈঠক পিছিয়ে যাওয়ায় সমস্ত সম্ভাবনাও কার্যত বাধা পড়ে গেল।
কৃষি ও দুগ্ধজাত পণ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যে প্রবেশ করতে ভারতের উপর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু, দেশের ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের কথা মাথায় রেখে ওয়াশিংটনের সে দাবি মানতে নারাজ দিল্লি। কৃষক এবং বাকিদের স্বার্থের সঙ্গে কোনও রকম সমঝোতা করা যাবে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে ভারত।
ট্রাম্পের শুল্কারোপে ভারত এক অনিশ্চিত অবস্থান থেকে বের হয়ে আসতে তিনটি কৌশল একসাথে ব্যবহার করছে। প্রথমত ওয়াশিংটনের সাথে নতুন কোনো চুক্তি করতে পারছে না নয়াদিল্লি। এক্ষেত্রে মোদির অভ্যন্তরীণ সমর্থন যাতে বিপন্ন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত চীনের সাথে ভারত তার ভূ-অর্থনৈতিক সম্পর্ককে সূক্ষ্মভাবে পরিচালনা করে পূর্ববর্তী সামরিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা উদ্বেগ উপেক্ষা না করে বেইজিংয়ের সাথে উত্তেজনা কমিয়ে আনতে চেষ্টা করছে। তৃতীয়ত নিজেদের অর্থনীতিকে বিকল্প অংশীদারদের কাছে বৈচিত্র্যময় করে ভূ-রাজনৈতিক উচ্চাকাক্সক্ষাকে এগিয়ে নিতে চাইছে। দ্য ডিপ্লোম্যাট এ অভিমত দিয়ে বলছে, গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রফতানি তার জিডিপির ২ শতাংশ ছিল। আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থা গোল্ডম্যান শ্যাক্স শঙ্কা প্রকাশ করে বলছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম ধাপে ২৫ শতাংশ শুল্ক ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ০.৩ শতাংশ পয়েন্ট কমিয়ে দেবে, অতিরিক্ত সেকেন্ডারি শুল্ক কার্যকর হলে তা দ্বিগুণ হারে হ্রাস পাবে। ধারণা করা হচ্ছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রকে বাণিজ্যিকভাবে মোকাবেলার পাশাপাশি বৈচিত্র্য ধরে রাখার নয়াদিল্লির প্রচেষ্টা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক জুয়া।
শুল্ক হুমকির সম্মুখীন হয়ে নয়াদিল্লী তার মূল স্বার্থের সাথে আপস না করে ওয়াশিংটনের সাথে ৫৫ শতাংশ মার্কিন রফতানির ওপর শুল্ক হ্রাস এবং আমেরিকান প্রতিরক্ষা ও জ্বালানি পণ্য কেনা বাড়াতে হচ্ছে। ভারতীয় কর্মকর্তারা চাচ্ছেন পনির এবং বাদামের মতো সীমিত পরিসরে কৃষিপণ্যের ওপর শুল্ক কমাতে, যা দেশীয় উৎপাদকদের ওপর ন্যূনতম প্রভাব ফেলবে। যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড় দেয়ার ক্ষেত্রে ভারতীয় কৃষকদের সাথে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) অবস্থানকে দুর্বল করলে তা রাজনৈতিক আত্মহত্যা হবে। চুক্তি করলেও ট্রাম্প তা থেকে যে পিছু হটবেন এমন কোনো গ্যারান্টি খুঁজে পাচ্ছে না ভারত। ট্রাম্প আপাতদৃষ্টিতে ধৈর্য হারাচ্ছেন এবং একবার চুক্তি করতে অস্বীকৃতি জানানোর জন্য ইতোমধ্যেই ভারতের ওপর শুল্কারোপ করেছেন। আলোচনা স্থগিত থাকলেও, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপাইনসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অর্থনীতিগুলো কম শুল্ক হার অর্জন করেছে যা তাদের ভারতের তুলনায় মার্কিন বাজারে আরো প্রতিযোগিতামূলক করে তুলেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে শুল্ক বিরোধের ফলে ভারত নানামুখী সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। এজন্য তারা নানা বিকল্পের কথাও ভাবতে শুরু করেছে। তবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওয়াশিংটনের শুল্ক হুমকির মধ্যে চীনের সাথে বাণিজ্য বৃদ্ধি ভারতের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে সাহায্য করতে পারে, যদি তারা চীনে কাঁচামাল রফতানি বাড়াতে পারে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে খোদ ভারতই আশ্বস্ত হতে পারছে না। প্রাপ্ত তথ্যমতে জানা গেছে, বেইজিং ইউরিয়ার ওপর রফতানি নিয়ন্ত্রণ শিথিল করেছে, যার মধ্যে ভারত বিশ্বের বৃহত্তম আমদানিকারক। গত বছর, চীনের সাথে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৯৯.২১ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে রয়েছে ভারতীয় অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন আমদানি, যেমন ইলেকট্রনিক্স, টেক্সটাইল এবং উৎপাদন। চীনের সাথে অতিরিক্ত অর্থনৈতিক সহযোগিতায় ভারতীয় বাজার চীনা পণ্যে সয়লাব হতে পারে। চীন উৎপাদন ও সরবরাহ শৃঙ্খলায় বৃহত্তর ভূমিকা পালন করায় ভারতের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন বেইজিংয়ের কাছে অত্যন্ত কৌশলগত এবং প্রায়শই যা নিজস্ব স্বার্থে নেয়া হয়। তাই ভারতকে বিষয়টি সাবধানতার সাথে বিবেচনা করতে হবে বলেই মনে করা হচ্ছে। চীনকে ছাড় দিলে বেইজিং ভারতের বিতর্কিত সীমান্তে আক্রমণাত্মক অবস্থান বজায় রাখলে মোদিকে দুর্বল দেখাবে এবং বিরোধীদের সমালোচনার মুখোমুখি হতে হবে।
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে ভারত কি বিকল্প অংশীদারদের সাথে অর্থপূর্ণ বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হবে? সে প্রশ্নও এখন আন্তর্জাতিক মহলে ঘুরপাক খাচ্ছে। ভারতীয় প্রচেষ্টায় দেশীয় শিল্পকে রক্ষার উদ্বেগ এবং ডাটা নিয়ন্ত্রণের মতো বিতর্কিত বিষয়গুলো বেশ কয়েকটি অংশীদারের সাথে আলোচনা স্থগিত করে। ভারত সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের সাথে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি চূড়ান্ত করেছে। চিলি এবং অস্ট্রেলিয়ার সাথে চুক্তিগুলোকে আরো শক্তিশালী করার পাশাপাশি ইইউ, নিউজিল্যান্ড, পেরু এবং ওমানের সাথে বাণিজ্য আলোচনা ত্বরান্বিত করেছে। ভারত ব্রিকস ব্লকের অন্যান্য সদস্যদের সাথেও সম্পর্ক জোরদার করছে। তবে ভারতের প্রায় ১৮ শতাংশ রফতানি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যায় এবং ভারতের প্রায় ১৫ শতাংশ আমদানি চীন থেকে আসে, এ ধরনের প্রচেষ্টা দু’টি বৃহৎ শক্তির ওপর নির্ভরতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে পারে না।
ভারতীয় রফতানি চীন এবং উদীয়মান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অর্থনীতির কাছ থেকে কঠোর প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হচ্ছে। চীনের উৎপাদন স্কেলের সাথে ভারত তাল মেলাতে হিমশিম খাবে এবং ভারতীয় রফতানি উন্নত বাজারগুলোতে প্রতিযোগিতা করতে হিমশিম খেতে পারে-যেমন ইইউ এবং কানাডা। যাদের ইতোমধ্যেই ভারতের দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় প্রতিযোগীদের সাথে এফটিএ রয়েছে। ভারতে উৎপাদনকার্যক্রম সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে অ্যাপলের সিইও টিম কুককে ট্রাম্পের সাম্প্রতিক সতর্কবার্তা থেকে বোঝা যায় যে তিনি মার্কিন সংস্থাগুলোর ভারতে উৎপাদন স্থানান্তরে আপাতত সাড়া দেবেন না। ফলে আপাতত ভারত যে রীতিমত বিপাকে পড়েছে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
সার্বিক দিক বিবেচনায় মনে হচ্ছে, মার্কিন শুল্কারোপ নিয়ে ভারত বড় ধরনের জটিলতায় পড়েছে। এ সমস্যা সমাধানের জন্য ভারত মার্কিনীদের সাথে যেমন কোন সমাধানে আসতে পারছে না, ঠিক তেমনি বিকল্পের ওপরও আস্থা রাখা সম্ভব হচ্ছে না। সম্প্রসারণবাদী মনোভাবের কারণে কোন নিকট প্রতিবেশীর সাথে ভারতের কোন সুসম্পর্ক নেই। চীনকে বিকল্পকে হিসাবে ব্যবহারের ক্ষেত্রেও রয়েছে নানাবিধ জটিলতা। রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক নষ্ট করাও সম্ভব হচ্ছে না। ফলে দেশটি রীতিমত লেজে-গোবরে অবস্থায় পড়েছে বলেই মনে হচ্ছে। পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত কোন গন্তব্যে তা অবশ্য সময়ই বলে দেবে।