মাহে রমযান একটি মহিমান্বিত মাস। বছর ঘুরে এ মাসটি অত্যন্ত মর্যাদার সাথে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়। এ মাসে মুসলিম এবং কাফিরদের মধ্যে ঘটে যাওয়া একটি ঐতিহাসিক ঘটনার তাৎপর্য বিশ্বের মুসলমানদের দ্বীন কায়েমের সংগ্রামে নতুনভাবে উজ্জীবিত করে। রমযানের মহিমান্বিত ১৭তম দিনে ঐতিহাসিক বদর নামক প্রান্তরে যুদ্ধটি সংঘটিত হওয়ার কারণে এর নাম জঙ্গে বদর বা ‘বদর যুদ্ধ’। এ যুদ্ধ কাফেরদের সাথে মুসলমানদের প্রথম সম্মুখ যুদ্ধ। প্রতিবছর দিনটি আমাদের মাঝে আসে ঈমানী চেতনা জাগ্রত ও ইসলামের সুমহান আদর্শের দাওয়াত মানুষের কাছে পৌঁছানোর বার্তা নিয়ে। বদর যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধ। যা মুসলমান ও কাফিরদের মধ্যে দ্বিতীয় হিজরী সনের ১৭ রমযান ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ মার্চ মদিনা থেকে প্রায় ৮০ মাইল দূরে বদর নামক প্রান্তরে সংঘটিত হয়। ইসলামের ইতিহাসে ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনস্বীকার্য। এ যুদ্ধ ছিল সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে এবং অসত্য, জুলুম, অত্যাচার, অন্যায়, অবিচার ও অবৈধ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে। এ যুদ্ধে মুসলমানরা সংখ্যায় অনেক কম হয়েও মক্কার কাফির পরাশক্তিকে পরাজিত করে ইসলামের স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাসের সূচনা করে। এর মাধ্যমে সত্য মিথ্যার পার্থক্য সূচিত হয় এবং মুসলিম উম্মাহ দ্বীন কায়েমের অনুপ্রেরণা পায়। এজন্য এ যুদ্ধকে সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী বলা হয়। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে এ দিনকে ‘ইয়াওমুল ফুরকান’ বা কুরআন দিবস হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এজন্য দিনটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য গোটা মুসলিম উম্মাহর নিকট ঐতিহাসিক অনুপ্রেরণার উৎস।

বদরের ঐতিহাসিক ঘটনা : আমাদের প্রিয় নবী রাসুলুল্লাহ (সা) পবিত্র ভূমি মক্কা থেকে মদিনা মুনাওয়ারায় হিজরত করার পর সেখানে একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন এ রাষ্ট্রের অধিপতি। তিনি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় শান্তি এবং নিরাপত্তার লক্ষ্যে মদিনার অন্যান্য জাতি গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে মদিনা সনদের মাধ্যমে একটি শান্তি ও সন্ধি চুক্তিতে আবদ্ধ হন। এটি মদিনা সনদ নামে পরিচিত। মদিনায় রাসুল (সা) তাঁর সুদক্ষ নেতৃত্বে অতি অল্প সময়ের মধ্যে বিভক্ত জাতিকে একটি সুশৃঙ্খল জাতিতে পরিণত করেন। মক্কার কুরাইশরা মদিনায় নব প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র চালিয়ে যেতে থাকে। এমনকি মদিনা আক্রমণ করে তারা রাসুল (সা) তথা ইসলামকে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা করেছিল। তারই অংশ হিসেবে তারা কুরাইশ নেতা আবূু সুফিয়ানের নেতৃত্বে একটি বাণিজ্যিক কাফেলা সিরিয়ায় পাঠিয়েছিল অস্ত্রশস্ত্র ও খাদ্য-সামগ্রী নিয়ে আসার জন্য। মক্কার আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা বাদ পড়েনি যারা এ বাণিজ্যে পুঁজি বিনিয়োগ করেনি। শুধু বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং পুণ্যের কাজ এবং সামাজিক কর্তব্য মনে করে সবাই এতে অংশগ্রহণ করেছিল। রাসুল (সা) যখন সংবাদ পেয়ে আবু সুফিয়ান সিরিয়া থেকে অস্ত্রশস্ত্র ও খাদ্য-সামগ্রীর বিশাল সম্ভার নিয়ে মক্কায় ফিরছেন, তখন তিনি বদর গিরিপথে আবু সুফিয়ানকে বাধা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। এ উদ্দেশ্যে রাসুল (সা) দ্বিতীয় হিজরীর ১২ রমযান ৩১৩ জন সাহাবীর একটি ক্ষুদ্র বাহিনী নিয়ে মদিনা থেকে ৮০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে বদর গিরিপথের দিকে রওয়ানা হন। এদিকে কুরাইশরা আবু জাহেলের নেতৃত্বে আবু সুফিয়ানকে সাহায্য করার জন্য অস্ত্রশস্ত্র ১০০০ সুসজ্জিত সৈন্যের বিশাল এক বাহিনী নিয়ে রওয়ানা করে। আবু লাহাব ব্যতীত কুরাইশদের প্রায় সকল গোত্রের দলপতিই উক্ত বাহিনীতে অংশগ্রহণ করে।” রাসুল (সা) সাফরা নামক স্থানে পৌঁছার পর আবু জাহেল এর নেতৃত্বে আসা মক্কা বাহিনীর বিশাল রণপ্রস্তুতির কথা অবহিত হলে তাদের শক্তি ও প্রাচুর্যের কথা সাহাবায়ে কিরামকে জানিয়ে দিলেন এবং তাদের সঙ্গে পরামর্শ সভায় মিলিত হলেন। একপর্যায়ে রাসুল (স) সাহাবায়ে কিরামকে নিয়ে বদর প্রান্তরে উপনীত হন। যুদ্ধের আগাম ফলাফল ঘোষণা করে মহান আল্লাহ বলেন, “আর স্মরণ কর! আল্লাহ তোমাদের প্রতিশ্রুতি দেন যে দুই দলের একদল তোমাদের আয়ত্ত্বে আসবে। অথচ তোমরা চেয়েছিলে যে নিরস্ত্র দলটি তোমাদের আয়ত্ত্বে আসুক। আর আল্লাহ চেয়েছিলেন সত্যকে তার বাণী দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে এবং অবিশ্বাসীদেরকে নির্মূল করতে।” [সূরা আনফাল: আয়াত-০৭]।

শেষ পর্যন্ত ১৭ রমযান শুক্রবার বদর প্রান্তরে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। সে যুগের প্রথা অনুযায়ী দ্বৈতযুদ্ধে হযরত হামযা (রা) তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী উতবা বিন রাবিআকে, হযরত আলী (রা) তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ওলিদ বিন উতবাকে প্রথম আঘাতেই খতম করে ফেলেন। এদিকে বয়োবৃদ্ধ হযরত উবাইদা বিন হারিস (রা) তাঁর প্রতিপক্ষ শায়বা বিন রাবিআর সঙ্গে যুদ্ধে আহত হলেন। হযরত আলী (রা) ও হযরত হামযা (রা) হযরত উবাইদা (রা) এর সাহায্যে এগিয়ে এসে তাঁকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেন। এরই মধ্যে হযরত আলী (রা) শায়বাকে হত্যা করেন। প্রথম আঘাতেই তিনজন যোদ্ধা ও গোত্র নেতাকে হারিয়ে কুরাইশ পক্ষ মরিয়া হয়ে মুসলমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। রাসুল (সা) এর নির্দেশে মুসলমানরা ঈমানী শক্তিতে বলিয়ান হয়ে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যান। তুমুল যুদ্ধে আনসারদের বনু সালামা গোত্রের কিশোর দুই ভাই হযরত মুআয ও হযরত মুআওয়িয ইবনু আফরা (রা) আবু জাহেলকে বীরদর্পে আক্রমণ করেন এবং হত্যা করেন। হযরত বেলাল (রা.) এর হাতে তাঁর সাবেক মনিব উমাইয়া ইবনে খালফ নিহত হন। উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) তাঁর মামা আস ইবনে হিশাম ইবনে মুগিরাকে হত্যা করেন। বিকেলের মধ্যে যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। ভীষণ এ যুদ্ধে কুরাইশ বাহিনী শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। মুসলমানদের ভাগ্যে ঐতিহাসিক বিজয়ের গৌরব অর্জিত হল। হক ও বাতিলের মধ্যে চূড়ান্ত ফয়সালা হল। পবিত্র কুরআনের বর্ণনানুযায়ী এ যুদ্ধে আল্লাহ তাআলা ফেরেশতা প্রেরণ করে মুসলমানদের সাহায্য করেন। এ যুদ্ধে মুসলমানদের মধ্যে ছয়জন মুহাজির ও আটজন আনসার শহীদ হন। কাফিরদের পক্ষে ৭০ জন নিহত ও ৭০ জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বন্দি হয়। একপর্যায়ে তাদের বড় বড় ২৪ জন নিহত নেতাকে বদরের একটি পরিত্যক্ত দুর্গন্ধময় কূপে নিক্ষেপ করা হয়। মুসলমানগণ প্রচুর গনীমতের মালের অধিকারী হন। যুদ্ধ শেষে আরবের রীতি অনুযায়ী রাসুল (সা) মুসলিম বাহিনীসহ বদর ময়দানে তিন দিন অবস্থান করার পর নিজ বাহিনী নিয়ে মদিনায় ফিরে আসেন।

বদর যুদ্ধের পর রাসুল (সা) এর অবস্থান ছিল পরাজিত যুদ্ধ বন্দিদের হত্যা না করা ও কষ্ট না দেয়া।সাহাবায়ে কিরামের সাথে পরামর্শক্রমে রাসুল (সা) বন্দিদের হত্যা না করে মুক্তিদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সিদ্ধান্ত ঘোষিত হলো, মুক্তিপণ দেয়ার মতো যাদের সামর্থ্য আছে তারা মুক্তিপণ দিয়ে মুক্তি লাভ করবে। আর যাদের সামর্থ্য নেই তাদের মুক্তিপণ নির্ধারিত হল আনসার সাহাবীদের ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া শিক্ষা দেয়া। বদরের বন্দিদের প্রতি রাসুল (সা) যে আদর্শ ও উদার ব্যবহার দেখালেন, জগতের ইতিহাসে তার তুলনা হয় না।” রাসুল (সা) ও সাহাবায়ে কিরামের এমন সুন্দর ও উদার ব্যবহার দেখে বন্দিদের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। ফলে পরবর্তীতে অনেকেই ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য এক ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হচ্ছে-বদর যুদ্ধ। এ যুদ্ধ থেকে আমরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিক্ষা লাভ করতে পারি। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে দোয়া। তাই দোয়ায় শিথিলতা প্রদর্শন না করা এবং সকল বিপদ মুসিবতে আল্লাহর ওপর অগাধ বিশ্বাস ও ভরসা রাখা।

বদর যুদ্ধের সুমহান শিক্ষা সর্বযুগে মুসলিম জাতিকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। ভবিষ্যতেও দ্বীন প্রতিষ্ঠার প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে প্রেরণার উৎস হিসেবে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। সুতরাং বদর যুদ্ধের প্রেরণাকে কাজে লাগিয়ে পবিত্র এ রমযান মাসে দ্বীন প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়ে নব্য ফ্যাসিবদের বিরুদ্ধে মুসলিম উম্মাকে ঈমানী চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক : শিক্ষাবিদ।