মো. মোস্তফা মিয়া
কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক। পরিস্থিতি এমন যে, গোলা-কামান নিয়ে যুদ্ধে প্রস্তুত পারমাণবিক শক্তিধারী প্রতিবেশী দু’দেশ। তবে ভারত-পাকিস্তান এ দ্বন্দ্বের রয়েছে ৭৮ বছরের দীর্ঘ ইতিহাস। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আল-জাজিরাসহ বিভিন্ন মিডিয়া কাশ্মীর ও ভারত-পাকিস্তান উত্তপ্ত দ্বন্দ্বের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নিয়ে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছে। সে আলোকে প্রবন্ধটি উপস্থাপন করা হয়েছে।
১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে পাকিস্তান এবং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে ভারত বিভক্ত হয়। সে সময় থেকেই ‘ভূস্বর্গ’ খ্যাত কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাত শুরু হয়। ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ, তবে হিন্দু রাজার শাসনাধীন কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দু’দেশ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৮ সালে প্রথম এ যুদ্ধ শেষ হওয়ার সময় সদ্য স্বাধীন ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই কাশ্মীরের কিছু অংশের নিয়ন্ত্রণ নেয়।
পাকিস্তান মূলত উত্তর ও পশ্চিম অংশ অর্থাৎ আজাদ কাশ্মীর, গিলগিট এবং বালতিস্তান নিয়ন্ত্রণ করে। অন্যদিকে ভারতের নিয়ন্ত্রণে যায় দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব অংশ। যার মধ্যে কাশ্মীর উপত্যকা এবং এর বৃহত্তম শহর শ্রীনগর, পাশাপাশি জম্মু এবং লাদাখও রয়েছে। কাশ্মীর স্বায়ত্তশাসিত থাকবে, এ অঞ্চলের নিজস্ব সংবিধান, পতাকা ও আইন থাকবে-এমন প্রতিশ্রুতিতে কাশ্মীরের হিন্দু রাজা হরি সিং ভারতে যোগ দিয়েছিলেন। তবে চুক্তির অংশ হিসাবে নয়াদিল্লি প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগ খাতের দায়িত্ব পালন করবে বলে ঠিক হয়। এ বিশেষ মর্যাদা ভারতের সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদে অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা মোদি সরকার ২০১৯ সালে বাতিল করে দেয়।
কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তান আরও দুটি যুদ্ধে লিপ্ত হয় ১৯৬৫ ও ১৯৯৯ সালে। ২০০৩ সালে নিয়ন্ত্রণ রেখা নিয়ে একটি ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০০৮ সালে মুম্বাইয়ের তাজ হোটেলে এক হামলায় তিন দিনে ১৬৩ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় দু’দেশের মধ্যে সশস্ত্র সংঘাতে জড়ানোর আশঙ্কা সৃষ্টি হয়।
২০১৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে আমন্ত্রণ জানানোর পর দু’দেশ শান্তি আলোচনা চালিয়ে যেতে পারে বলে আশা করা হচ্ছিল। তবে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের সঙ্গে দেখা করায় সে আশা ক্ষণস্থায়ী হয়।
২০১৯ সালে কাশ্মীরে ভারতীয় আধা-সামরিক বাহিনীর ওপর এক মারাত্মক হামলা হয়, যার দায় স্বীকার করেছিল পাকিস্তানি গোষ্ঠী জইশ-ই-মোহাম্মদ। এরপরই নরেন্দ্র মোদি জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে নিজস্ব আইন নির্ধারণের উদ্যোগ নেন। বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহারের পর কাশ্মীর এক বছরেরও বেশি সময় ধরে অবরুদ্ধ ছিল। মাঝেমধ্যে ফোন সিগন্যাল ও ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া এবং বহু মানুষকে আটক করা হয়।
এরপর দীর্ঘদিন এ অবস্থা চলার পর ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ পর্যটক নিহত হওয়ার পর দু’দেশের মধ্যে আবারও উত্তেজনা শুরু হয়। হামলার পর ভারত ও পাকিস্তান একে অপরের বিরুদ্ধে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কিন্তু সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পিছনে যে পাকিস্তান, তা ভারত প্রমাণ করতে পারেনি। বরং ভারতের কিছু মিডিয়াসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় তথ্য প্রকাশ পেয়েছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেডিডেন্ট ভারত সফরকালে পাকিস্তানকে বেকায়দায় ফেলার জন্য ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র, এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছে। কিন্তু তাদের ষড়যন্ত্র সফল হয়নি। তাছাড়া কাশ্মীরে এ সন্ত্রাসী হামলাকে কেন্দ্র করে সমগ্র ভারতে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর চরম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করা হয়। নিরীহ মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর অমানবিক নির্যাতন করা হচ্ছে।
সম্প্রতি ইন্ডিয়া হেট ল্যাব (আইএইচএল) নামের একটি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২২ এপ্রিল থেকে ২ মের মধ্যে ভারতের নয়টি রাজ্য এবং জম্মু ও কাশ্মীরে মোট ৬৪টি সরাসরি ঘৃণামূলক বক্তব্যের ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে মহারাষ্ট্রে সর্বোচ্চ সংখ্যক ঘটনা ঘটছে।
ঘটনাগুলো পেহেলগামে হামলার পর সংঘটিত হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, হিন্দু কট্টর ডানপন্থী গোষ্ঠীগুলো মুসলিমদের লক্ষ্য করে দেশব্যাপী ঘৃণা ও ভীতিকর ক্যাম্পেইন পরিচালনা করেছে।
আইএইচএল-এর প্রতিবেদনে জানা যায়, এ মিছিলগুলোর বেশিরভাগই আয়োজন করেছে হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলো, যার মধ্যে রয়েছে- বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি), বজরং দল, আন্তর্জাতিক হিন্দু পরিষদ (এএইচপি), জাতীয় বজরং দল (আরবিডি), হিন্দু জনজাগৃতি সমিতি, সকল হিন্দু সমাজ, হিন্দু রাষ্ট্র সেনা এবং হিন্দু রক্ষা দল। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘গোষ্ঠীগুলো সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা উসকে দিতে এবং সহিংসতা, সামাজিক বর্জন ও অর্থনৈতিক বয়কটের ডাক দেওয়ার জন্য পেহেলগাম ট্র্যাজেডিকে ব্যবহার করছে।’ মুসলিমদের উদ্দেশ্য করে সবচেয়ে বেশি ঘৃণামূলক বক্তব্য দেওয়া হয়েছে মহারাষ্ট্রে। ভারতের ক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) শাসিত এ রাজ্য এমন ১৭টি ঘটনা ঘটেছে। এরপর উত্তর প্রদেশে ১৩টি, উত্তরাখণ্ডে ৬টি, হরিয়ানায় ৬টি, রাজস্থানে ৫টি, মধ্যপ্রদেশে ৫টি, হিমাচল প্রদেশে ৫টি, বিহারে ৪টি, এবং ছত্তিশগড়ে ২টি ঘৃণামূলক বক্তব্যের ঘটনা পরিলক্ষিত হয়েছে।
প্রতিবেদন অনুসারে, এসব অনুষ্ঠানে বক্তারা নিয়মিতভাবে মুসলমানদের ‘সবুজ সাপ’, ‘কীটপতঙ্গ’, এবং ‘পাগলা কুকুর’ বলে অবমাননাকর ভাষায় আক্রমণ করেছেন। অনেক ক্ষেত্রেই বক্তারা সহিংসতা উসকে দিয়েছেন এবং মুসলমানদের এলাকা থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। মুসলিমবিরোধী মিছিলে এসব মিছিলে উপস্থিত ছিলেন বিজেপির বিধায়ক নন্দকিশোর গুরজার এবং বিভিন্ন হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠনের সদস্যরা। তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে অমানবিক সব গালি ব্যবহার করেছেন, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বয়কটের আহ্বান জানিয়েছেন, সহিংসতার উসকানি দিয়েছেন এবং হিন্দুদের অস্ত্রধারণে উদ্বুদ্ধ করেছেন। অনেক র্যালিতে বক্তারা মুসলমানদের বিতাড়নের হুমকি দিয়েছেন এবং তাদেরকে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত করে ষড়যন্ত্রমূলক তত্ত্ব প্রচার করেছেন।
প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছে, মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণার ছড়ানো শুধু মুখের কথাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ভারতের বিভিন্ন অংশে মুসলমানদের বিশেষ করে কাশ্মীরিদের লক্ষ্য করে ঘৃণাপূর্ণ অপরাধ ও সহিংসতা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। হকারদের ওপর হামলা ও তাদের পণ্যসামগ্রীতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। হামলার শিকার হয়েছেন কাশ্মীরি শাল বিক্রেতারাও। উত্তরাখণ্ডে মুসলিমদের প্রকাশ্য হুমকি দিয়েছেন বিজেপি নেতা। উত্তর প্রদেশে একজন মুসলিম ব্যক্তির উপর কুঠার দিয়ে নির্মম হামলার পর হামলাকারীকে বলতে শোনা গেছে, ‘ছাব্বিশজন মারা গেছে, তোমাদেরও ছাব্বিশজন মরবে।’
আইএইচএল-এর গবেষকরা লক্ষ্য করেছেন, এসব ঘৃণামূলক বক্তব্যের বেশিরভাগই সামাজিক মাধ্যমে লাইভ স্ট্রিম করা হয়েছে অথবা রেকর্ড করে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব বা এক্স-এর মতো সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে আপলোড করা হয়েছে। ফলে মুহূর্তেই লাখো মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে মুসলিমবিরোধী বার্তা। গবেষকরা যোগ করেন, ‘এসব কন্টেন্টের দ্রুত ছড়িয়ে পড়া প্রমাণ করে যে, অনলাইনে ঘৃণার পরিবেশ এবং অফলাইনে সহিংসতার মধ্যে একটি ভয়ংকর সম্পর্ক রয়েছে।’
ভারত সরকার প্রতিবেশি দেশগুলোতে সংখ্যালঘুদের ইস্যু নিয়ে উচ্চবাচ্য করলেও নিজের দেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা কোনো পদক্ষেপ-ই গ্রহণ করে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেওয়া তো দূরের কথা ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ মদদে-ই মুসলিমদের বিরুদ্ধে নিপীড়ন চালায় উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা। তাদের মূল উদ্দেশ্য হলো সর্বক্ষেত্রে চরম মুসলিম বিদ্বেষী সর্বগ্রাসী ভূমিকা পালন করা এবং কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী মুসলমানদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা। অথচ ভারতের মুসলমান তাদের জীবনের বিনিময়ে অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতা সুরক্ষায় অঙ্গীকারাবদ্ধ। বিজেপি সরকারের উচিত মুসলমানদের বিষয়ে তাদের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ ঘটানো। মুসলমানদের জীবনমানকে মাইনাস করে ভারতের টেকসই উন্নয়ন সুনিশ্চিত করা কখনো সম্ভব হবে না। ঐতিহাসিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনের প্রেক্ষাপট অনুধাবনের মাধ্যমে ভারতের মুসলমান সম্প্রদায় ভারতে আছে এবং থাকবে। এ বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। মুসলমানদের অবদান ও ন্যায্য অধিকারকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিতর্ক করার জন্য বিজেপি এবং তাদের সহযোগীগণ মুসলমানদের নামে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের সন্ত্রাস সৃষ্টি এবং অমানবিক কর্মকাণ্ডের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত। যার প্রমাণ বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশ পেয়েছে, যেমন-শঙ্করসিংহ বাঘেলা ২০১৯ সালের মে মাসে একটি বিতর্কিত মন্তব্য করেছিলেন, যেখানে তিনি দাবি করেন যে ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের পুলওয়ামায় সিআরপিএফ জওয়ানদের উপর হওয়া সন্ত্রাসী হামলাটি বিজেপির একটি ষড়যন্ত্র ছিল, যা ২০০২ সালের গোধরা কাণ্ডের মতো। তিনি বলেন, “পুলওয়ামা হামলায় ব্যবহৃত গাড়িটির রেজিস্ট্রেশন নম্বর ছিল গুজরাটের (GJ)। গোধরা একটি ষড়যন্ত্র ছিল,” যা ANI সংবাদ সংস্থা উদ্ধৃত করেছে।
বাঘেলা আরও অভিযোগ করেন যে বিজেপি সরকার নির্বাচনে জয়লাভের জন্য সন্ত্রাসবাদকে ব্যবহার করছে। তিনি বলেন, “গত পাঁচ বছরে অনেক সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। তিনি বালাকোট এয়ার স্ট্রাইক সম্পর্কেও সন্দেহ প্রকাশ করেন, বলেন, “বালাকোট এয়ার স্ট্রাইকে কেউ মারা যায়নি। এমনকি কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থাও প্রমাণ করতে পারেনি যে ২০০ জন জঙ্গি নিহত হয়েছে। বালাকোট এয়ার স্ট্রাইক একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র ছিল।
মন্তব্যগুলি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, যেমন The Indian Express, Business Standard, এবং Firstpost| ([Firstpost][1])
বক্তব্যগুলি ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে দেওয়া হয়েছিল, এবং তা রাজনৈতিক বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল। যার অব্যাহত প্রভাব বর্তমানেও পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ অবস্থায় ভারতের মুসলমান সম্প্রদায়ের দায়িত্বশীলগণের চরম ধৈর্যের সাথে প্রতিকূল ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতি মোকাবেলায় মুখ্য ভূমিকা পালন করা আবশ্যক।
লেখক : অধ্যক্ষ ও এনজিও ব্যক্তিত্ব।