আসিফ আরসালান
গত ৫ অগাস্ট মানিক মিয়া এভিনিউতে জুলাই বিপ্লবের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এক অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। এসময় মঞ্চে তার ডানে এবং বামের সারিতে সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ এবং নৌ, সেনা ও বিমান বাহিনীর প্রধান উপস্থিত ছিলেন। সকলের উপস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা যে জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করেন সেখানে রয়েছে ২৮টি অনুচ্ছেদ। ঘোষণাপত্র পাঠের পর সাংবাদিকরা উপস্থিত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের তাৎক্ষণিক মতামত জানতে চান। জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের তাৎক্ষণিক একটি মন্তব্য করেন। তবে সাথে সাথে তিনি এও বলেন যে, আজ রাতেই (৫ অগাস্ট) জামায়াতের নীতি নির্ধারণী কমিটির বৈঠক বসবে। এ বৈঠকে জুলাই ঘোষণাপত্র সম্পর্কে আলোচনা হবে এবং দলের মতামত গৃহীত হবে। অতঃপর পরবর্তী দিন অর্থাৎ ৬ অগাস্ট বুধবার এক সাংবাদিক সন্মেলন করে এ সম্পর্কে জামায়াতের মতামত আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে। তদনুযায়ী পরদিন অর্থাৎ গত বুধবার জামায়াতের অফিসিয়াল মন্তব্য সাংবাদিক সন্মেলনে জানানো হয়েছে। এ সম্পর্কে আমরা একটু পর বিস্তারিত আলোচনায় যাবো। তার আগে ৭ অগাস্ট বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত জুলাই ঘোষণাপত্র সম্পর্কে বিভিন্ন দলের যেসব প্রতিক্রিয়া এসেছে সেসব থেকে দেখা যায় যে, একমাত্র বিএনপি ছাড়া আর কোনো দল শর্তহীনভাবে জুলাই ঘোষণাপত্রকে স্বাগত জানায়ানি। পবিত্র রমযান মাসের পূর্বে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে যে সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন সেটিকে বিএনপি অভিনন্দিত করেছে। সাথে সাথে তারা জুলাই ঘোষণাপত্রকেও স্বাগত জানিয়েছে।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, জুলাই বিপ্লব সম্পন্ন হওয়ার ১ দিন পর থেকেই অর্থাৎ ৭ জুলাই থেকেই বিএনপি নির্বাচনের দাবি করে আসছে। বিগত প্রায় ১ বছর হলো বিএনপির কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা দেখা যায়নি। ৫ অগাস্ট বিপ্লব সম্পন্ন হলে ৭ অগাস্টেই বিএনপি নয়াপল্টনে সমাবেশ করে। এ সমাবেশে বেশ কয়েক বছর পর অসুস্থ বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার ভিডিওতে ধারণকৃত বক্তব্য প্রচার করা হয়। এছাড়া লন্ডন থেকে বিএনপির অস্থায়ী প্রধান তারেক রহমান অনলাইনে এ সভায় যুক্ত হন। ঐ সভায় তিনি দাবি করেন যে, পরবর্তী ৩ মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন দিতে হবে।
তারেক রহমানের এ বক্তব্যের পর দলের হাইকমান্ড থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত বিগত ১ বছরে বিএনপির কন্ঠে ছিলো একই আওয়াজ। অবিলম্বে, পরবর্তীকালে সংশোধন করে চলতি ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই, নির্বাচন অনুষ্ঠানের অব্যাহত দাবি করে যাচ্ছে দলটি। দেশের হাজারও সমস্যা , পুলিশরা পালিয়ে যাওয়ায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দেওয়া, ভারতের উস্কানিতে এবং পতিত আওয়ামী লীগের ইন্ধনে সংখ্যালঘু নির্যাতনের একটি ইস্যু বানানোর চেষ্টা -ইত্যাদি কোনো ব্যাপারে বিএনপিকে মাথা ঘামাতে দেখা যায়নি। তাদের একমাত্র দাবি ছিলো নির্বাচন। ভাবতে অবাক লাগে, নির্বাচন নিয়ে দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ এমন সব উক্তি করেছেন যা হাসিনার স্বৈরশাসনের অক্টোপাস থেকে সদ্যমুক্ত জনগণকেও বিস্মিত করে। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জাা আব্বাস বলেন যে, ইউনূস সরকারের একমাত্র কাজ হলো নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। সালাহ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন যে, নির্বাচন অনুষ্ঠান করা ছাড়া ইউনূস সরকারের আর কোনো ম্যানডেট নাই। ৫ অগাস্টের আগের দিনও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন যে, আমরা আর কিছু বুঝি না। আমরা বুঝি শুধু নির্বাচন। প্রিয় পাঠক, এগুলো কারো বানোয়াট কথা নয়। আপনারা সাম্প্রতিককালের পত্রপত্রিকার পাতা উল্টালেই আমাদের কথার সত্যতা পাবেন।
নির্বাচনই বিএনপির একমাত্র ইস্যু হওয়ার পটভূমিতে গত ৫ অগাস্টের ভাষণে যখন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস রমযানের পূর্বেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন তখন তিনি প্রকারন্তরে বিএনপির দাবিই পুরোপুরি মেনে নেন। এ অবস্থাতে ড. ইউনূসের ভাষণকে স্বাগত জানানো ছাড়া বিএনপির আর বলার মতো কিছু ছিলো না। আরো একটি কারণে বিএনপি উল্লসিত হয়েছে। সেটি হলো, গত জুন মাসে লন্ডনে ড. ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যে যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় সে বৈঠকেই তারেক রহমান ডিসেম্বরের মধ্যেই ইলেকশন দিতে হবে, সে দাবি থেকে সরে আসেন। তেমনি ড. ইউনূসও আগামী বছরের জুন মাসের মধ্যে ইলেকশন দেওয়া হবে, তেমন দাবি থেকে এগিয়ে আসেন। ঐ লন্ডন বৈঠকেই দু’নেতা যৌথভাবে সিদ্ধান্ত নেন যে আগামী বছর পবিত্র রমযান মাসের পূর্বেই ইলেকশন করা হবে। পবিত্র রমযান মাসের পূর্বে করতে হলে আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথম পক্ষের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে।
৫ অগাস্ট নির্বাচনী সময়ের ঘোষণা দেওয়ার পরদিনই প্রধান উপদেষ্টা প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে (সিইসি) আগামী রমযান শুরু হওয়ার পূর্বেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নেয়ার জন্য লিখিতপত্র দেন। এখানে সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হলো, বিএনপি ছাড়াও দেশে আরো অনেকগুলেী রাজনৈতিক দল রয়েছে যারা বিগত ১৫ বছর ধরে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। এসব দলের এবং তাদের ঘরানার নেতাকর্মীরা জুলাই বিপ্লবে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। অনেক নেতাকর্মী শাহাদতবরণ করেছেন। অনেক নেতাকর্মীর অঙ্গহানি হয়েছে। অনেক নেতাকর্মীর সম্পূর্ণ বা আংশিক চোখের জ্যোতি নষ্ট হয়েছে। যেসব দল জুলাই বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেছে, শহীদ হয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির এবং অন্যান্য ইসলামী দল। এদের কারো সাথে কোনোরূপ আলাপ আলোচনা না করে লন্ডনে এক ব্যক্তির সাথে আলোচনা করে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা প্রমাণ করে যে, ড. ইউনূসের সরকার একটি বিশেষ দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করছেন। এর ফলে তার নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন হয়েছে। এবার গত ৫ অগাস্ট জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস যখন ঘোষণা দেন যে, পবিত্র রমযানের পূর্বেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তখন জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ (মওলানা মামুনুল হক), হেফাজতে ইসলাম প্রভৃতি দল মনে করেছে যে, ড. ইউনূস সমগ্র ইসলামী ঘরানাকে উপেক্ষা করেছেন। জামায়াতসহ অন্যান্য সব ইসলামী দল বলেছে যে, বিএনপিকে দেশের একমাত্র রাজনৈতিক শক্তি গণ্য করে অন্যান্য ইসলামী দলকে যেভাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়েছে, তার ফলে এসব দল নিজেদেরকে অপমানিত ভাবছেন। তারপরেও তারা বলছেন যে, যেহেতু এটা নির্বাচনের প্রশ্ন তাই তারা আপাতত এ ঘোষণাকে ইতিবাচক বলেই ধরে নিচ্ছেন।
একই ঘটনা ঘটেছে জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়েও। ইসলামী আন্দোলনের প্রধান চরমোনাইয়ের পীর সাহেব সৈয়দ রেজাউল করিম অভিযোগ করেছেন যে, জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়া তাদেরকে আগে দেখানো হয় নি। অথবা এটি নিয়ে তাদের সাথে কোনো আলোচনাও করা হয়নি। ৫ অগাস্ট মানিক মিয়া এভিনিউতে নির্মিত মঞ্চে জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করা হবে, এ বিষয়টি তাদেরকে জানানো হয় এবং ড. ইউনূসের পাশে সভামঞ্চে থাকার জন্য তাদেরকে অনুরোধ করা হয়। তিনি বলেন যে, যখন ড. ইউনূস জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করছিলেন তখন তিনি এবং তার সহগামীরা মনোযোগের সাথে সেগুলো শোনেন এবং মানসিকভাবে তারা অত্যন্ত অস্বস্তি অনুভব করেন। কারণ জুলাই ঘোষণাপত্রে বিধৃত ২৮টি দফার মধ্যে বেশ কয়েকটি দফার সাথে তাদের চরম মতভেদ রয়েছে। তিনি বলেন, সংস্কারের জন্য সবগুলো রাজনৈতিক দলের সাথে ড. আলী রিয়াজ একের পর এক বৈঠক করেছেন। কিন্তু প্রফেসর ইউনূস জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে তাদের সাথে কোনো আলোচনাই করেননি। কিন্তু ঘোষণাপত্রের খসড়া ইতোপূর্বে বিএনপিসহ ৩টি দলকে ঠিকই দেয়া হয়েছিলো। এক্ষেত্রেও তাদের প্রতি বৈষম্য করা এবং উপেক্ষা প্রদর্শন করা হয়েছে।
প্রায় একই ধরনের মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশের আমীর মওলানা মামুনুল হক। দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত মন্তব্যে তিনি বলেছেন যে, জুলাই ঘোষণাপত্র ইসলামপন্থীদের অবমাননা ও জনগণের আকাক্সক্ষার প্রতি চরম অবহেলা। তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টার পাঠ করা জুলাই ঘোষণাপত্র, ঘোষণার আয়োজন এবং একটিমাত্র দলের সঙ্গে আলাপের ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা- সবকিছুই প্রমাণ করে, ইসলামপন্থীদের মতামত, আত্মত্যাগ ও সাংগঠনিক ভূমিকাকে অবজ্ঞা করা হয়েছে। তিনি বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যারা রক্ত দিয়েছেন- আলেম-ওলামা, মাদরাসাশিক্ষক ও ছাত্র, প্রবাসী এবং অনলাইন এক্টিভিস্টদের ভূমিকাকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে। ১৯৪৭-এর আজাদী, ২০১৩-এর শাপলা চত্বর গণহত্যা, পিলখানা ট্র্যাজেডির মতো গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনারও কোনো উল্লেখ নেই। অথচ এগুলোই বাংলাদেশে স্বৈরাচার পতনের ধারাবাহিকতায় সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়। এ উপেক্ষা ইতিহাসের প্রতি চরম অবিচার।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ও সাবেক সংসদ সদস্য ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেছেন, গত ৫ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা যে ঘোষণাপত্র উপস্থাপন করেছেন তাতে গণমানুষের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেনি। এটি একটি অপূর্ণাঙ্গ বিবৃতি। নবগঠিত এনসিপি ড. ইউনূস কর্র্তৃক নির্বাচন ঘোষণার সময়সীমাকে স্বাগত জানালেও জুলাই ডিক্লারেশনকে স্বাগত জানাননি। জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন এবং বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ-সকলেই বলেছেন যে, জুলাই ঘোষণাপত্র নির্বাচনের পর সংস্কারকৃত জাতীয় সংসদ কর্তৃক গ্রহণ করার বিষয়টি মেনে নেয়া যায় না। তারা নির্বাচনের আগেই জুলাই ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নের দাবি জানান।