ইব্রাহীম খলিল (সবুজ)

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম চালিকাশক্তি প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স। বিদেশে কর্মরত প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি শ্রমিক প্রতি বছর দেশে পাঠান বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেশে পাঠিয়েছেন প্রায় ২,২০০ কোটি মার্কিন ডলার, যা দেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের একটি বিশাল অংশ। এ অর্থে গ্রামীণ অর্থনীতি সচল থাকে, লাখো পরিবার টিকে থাকে, সন্তানরা শিক্ষিত হয়, ঘরবাড়ি তৈরি হয়, এমনকি বাজারে ভোগচাহিদাও বজায় থাকে। তবে প্রশ্ন হলো-এই নির্ভরতা কতটা নিরাপদ?

রেমিট্যান্স অর্থনীতিকে সাময়িকভাবে প্রাণবন্ত রাখে, কিন্তু এটি টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি হতে পারে না। কারণ, এ আয়ের প্রবাহ দেশের উৎপাদন ক্ষমতার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয়। শ্রমিক বিদেশে কাজ করেন, মজুরি আসে অন্য দেশে উৎপাদিত সম্পদ থেকে। অর্থাৎ, দেশীয় উৎপাদন না বাড়িয়ে আমরা বৈদেশিক শ্রমবাজারের ওপর নির্ভরশীল থেকে যাই। যখন একটি দেশের অর্থনীতি নিজের উৎপাদন বা শিল্পের পরিবর্তে বিদেশি আয়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, তখন তা মূলত “অর্থনৈতিক কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসে” বেঁচে থাকে। একটি ছোট পরিবর্তন-যেমন তেলের দাম কমে যাওয়া, গালফ অঞ্চলের রাজনৈতিক সংকট, বা অভিবাসন আইনের সংশোধন-সঙ্গে সঙ্গে সেই শ্বাস বন্ধ করে দিতে পারে।

বাংলাদেশের শ্রম রপ্তানির মূল গন্তব্য গালফ অঞ্চল-সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, ওমান। এখানে কর্মরত প্রায় ৭০ লাখ শ্রমিকের পাঠানো অর্থ দেশের অর্থনীতির জীবনরেখা । কিন্তু এ বাজারগুলো এখন ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। গালফ দেশগুলো ‘ন্যাশনালাইজেশন প্রোগ্রাম’ চালু করেছে-যেখানে নিজেদের নাগরিকদের অগ্রাধিকার দিয়ে বিদেশি শ্রমিক কমানোর নীতি নেওয়া হচ্ছে। প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতি গড়ে ওঠায় ম্যানুয়াল শ্রমের চাহিদাও কমছে। একই সঙ্গে, ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারেও অভিবাসন নীতি কঠোর হচ্ছে। ফলে, বাংলাদেশের রেমিটেন্স প্রবাহ এখন আর ততটা স্থিতিশীল নয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০২২ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ধাক্কায় রেমিটেন্স প্রবাহ কমে গিয়েছিল প্রায় ১০ শতাংশ। একই সময়ে দেশের বৈদেশিক রিজার্ভেও ধস নেমেছিল।

এ নির্ভরতা কেবল অর্থনীতিকেই নয়, সামাজিক কাঠামোকেও প্রভাবিত করছে। বিদেশে কাজের স্বপ্নে দেশ ছেড়ে যাওয়া তরুণদের সংখ্যা বাড়ছে। গ্রামীণ বাংলাদেশে এখন “বিদেশ যাওয়া” সফল জীবনের প্রতীক। পরিবারের তরুণ সদস্য বিদেশে পাঠাতে পারলে গর্ব, আর না পারলে হতাশা। কিন্তু দেশে উদ্যোক্তা বা উদ্ভাবক তৈরি হচ্ছে না। শিক্ষিত তরুণদের একটি বড় অংশ প্রযুক্তি বা শিল্পখাতে নিজস্ব উদ্যোগের পরিবর্তে বিদেশে শ্রম বিক্রিকে নিরাপদ মনে করে। ফলাফল-“ব্রেন ড্রেইন” এবং দক্ষতার শূন্যতা।

অন্যদিকে, রেমিট্যান্সের অর্থ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যয় হয় ভোগে, উৎপাদনে নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, রেমিট্যান্সের প্রায় ৮০ শতাংশ অর্থ যায় ভোগে-বাড়ি নির্মাণ, ভোগ্যপণ্য ক্রয়, বা জমি কেনায়। মাত্র ১০-১২ শতাংশ অর্থ যায় কোনো ধরনের উৎপাদন বা বিনিয়োগে। অর্থাৎ এ বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি মূল্য তৈরি করে না। এটি অর্থনীতিকে অস্থায়ীভাবে চাঙা রাখে, কিন্তু নতুন কর্মসংস্থান বা উৎপাদন ক্ষমতা তৈরি করে না। ফলে অর্থনীতি ক্রমেই ভোগনির্ভর, আমদানিনির্ভর হয়ে ওঠে। কিন্তু অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে দরকার ছিল এ অর্থকে বিনিয়োগ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ, কিংবা প্রযুক্তি উন্নয়নের দিকে প্রবাহিত করা। এখন সময় এসেছে নির্ভরতার এ চক্র ভাঙার। প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে অর্থনীতির বহুমুখীকরণ। কৃষি, শিল্প, প্রযুক্তি ও সেবা খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে দেশে কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে। দ্বিতীয়ত, রেমিটেন্স ব্যবহারে নীতি উদ্ভাবন জরুরি-যেমন প্রবাসীদের জন্য বিনিয়োগ বন্ড, ইনসেনটিভ স্কিম, কিংবা উদ্যোক্তা তহবিল। তৃতীয়ত, মানবসম্পদ উন্নয়ন- দেশের তরুণ প্রজন্মকে এমন দক্ষতায় শিক্ষিত করতে হবে যাতে তারা বিদেশ নয়, নিজ দেশেই মানসম্পন্ন কাজ ও উদ্যোগ গড়তে পারে।

রেমিট্যান্স বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ, কিন্তু এর ওপর অতিনির্ভরতা অভিশাপে পরিণত হতে পারে। বিদেশি আয়ের বিকল্প তৈরি না করলে অর্থনীতি থাকবে অস্থির অবস্থায়। বাংলাদেশের টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ে উঠবে তখনই, যখন দেশের আয় আসবে দেশের ভেতর থেকেই-শিল্প, উদ্ভাবন, কৃষি ও প্রযুক্তির মাধ্যমে। বিদেশে শ্রম রপ্তানির যুগ পেরিয়ে এখন দরকার জ্ঞান ও দক্ষতা রপ্তানির যুগে প্রবেশ। অর্থনীতির এ পরিবর্তন কেবল সরকারের দায়িত্ব নয়; এটি একটি জাতীয় মানসিকতা পরিবর্তনের প্রক্রিয়া। আমরা যদি প্রবাসীদের পাঠানো অর্থকে শুধু ভোগ নয়, উৎপাদন ও উন্নয়নের শক্তিতে রূপান্তর করতে পারি, তবে সেটাই হবে প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশের “রেমিট্যান্স বিপ্লব”।

লেখক : শিক্ষার্থী, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।