ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরাইলী দখলদার নারকীয় ধ্বংস ও হত্যাযজ্ঞ অব্যাহত রয়েছে। জায়নবাদী নির্মমতা ইতোমধ্যেই হালাকু খানের বাগদাদ ধ্বংসের নৃশংসতাকেও হার মানিয়েছে। প্রতিনিয়ত মজলুম ফিলিস্তিনীদের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে গাজার জনপদ। ফলে গাজা এখন পরিণত হয়ে উঠেছে একবিংশ শতাব্দীর বধ্যভূমিতে। কিন্তু বিশ্ব পরাশক্তি সহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো রহস্যজনকভাবে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন। ফলে গাজার মজলুম মানুষের আর্তনাদ ও আহাজারি বন্ধ হচ্ছে না।
প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুয়াযী, ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় প্রায় দু’বছর ধরে চলা দখলদারদের নির্বিচার হামলায় নিহতের সংখ্যা ৬৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্প্রতি এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। তবে নিহতের প্রকৃত সংখ্যা আরো অনেক বেশি হতে পারে বলে গাজার উদ্ধারকর্মীরা দাবি করেছেন। কারণ, ভবনগুলোর ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনো বহু মানুষের দেহাবশেষ আটকা পড়ে আছে। স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রতিনিয়তই গাজা ভূখণ্ডজুড়ে ইসরাইলী বাহিনীর উপর্যুপরি বিমান হামলা ও গোলাবর্ষণে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। ব্যাপক আক্রমণের মধ্য দিয়ে বেসামরিক বাসিন্দাদের শহর ছাড়া করে হামাস যোদ্ধাদের মুখোমুখি হতে চায় তারা। ইসরাইলী সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, শহর ছাড়তে থাকা গাজা সিটির ফিলিস্তিনিদের ব্যবহার করার জন্য তারা ৪৮ ঘণ্টার জন্য আরেকটি রুট খুলেছে। দখলদাররা গাজা সিটির বাসিন্দাদের শহরটি ছেড়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছে। এ নির্দেশ মেনে গাজা সিটি ছেড়ে যাওয়ার সময় গত ১৭ সেপ্টেম্বর ইসরাইলী সেনাদের গুলিতে ১৩ জন নিহত হয়েছে বলে গাজার চিকিৎসাকর্মীরা জানিয়েছেন। দখলদাররা জানিয়েছে, তাদের সেনারা একটি ‘তাৎক্ষণিক হুমকি’ সরাতে সতর্কতামূলক গুলি ছুড়েছিল। এদিকে গাজা সিটির একটি প্রধান আবাসিক এলাকায় কয়েক ডজন ইসরাইলী ট্যাংক ও সামরিক বাহন ঢুকে পড়েছে বলে স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ট্যাংক, বুলডোজার ও সাঁজোয়া যানগুলো উত্তর গাজা সিটির শেখ রাদওয়ানের পথে চলেছে। নিজেদের অগ্রযাত্রা আড়াল করার জন্য ইসরাইলী বাহিনী কামানের গোলা ও স্মোক বম্ব নিক্ষেপ করায় চারদিকে মেঘের মতো ঘন ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে।
অন্যদিকে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতে স্বাক্ষর সংগ্রহে নেমেছে জাজিম নামের একটি অ্যাডভোকেসি সংস্থা। এরই মধ্যে এ দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে জাজিমের পিটিশনে স্বাক্ষর করেছেন সাত হাজার পাঁচ শতাধিক ইসরাইলী। ইসরাইলে অবস্থিত বামপন্থি ইহুদি ও আরবদের রাজনৈতিক সংগঠন জাজিম, যারা মূলত বিভিন্ন ইস্যুতে তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করে। অবশ্য ইতোমধ্যেই যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস ইসরাইলে আক্রমণের পর থেকে এ সংঘাতের শুরু হয়েছিল। এর প্রতিশোধ নিতে গাজায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় ইসরাইল। সেখানে মানবিক সংকট এখন প্রকট আকার ধারণ করেছে। হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, ইসরাইলের সামরিক অভিযান চলাকালে অর্ধলক্ষাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং গাজার অধিকাংশ অবকাঠামো বিমান হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে। মূলত গাজা উপত্যকা এখন রীতিমত ধ্বংস স্তূপ।
সূত্রমতে, ইসরাইল বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শহুরে এলাকায় বোমাবর্ষণ করেছে এবং কিছু অবকাঠামোয় একাধিকবার হামলা চালানো হয়েছে। জাতিসংঘের স্যাটেলাইট সেন্টারের (ইউএনওস্যাট) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ডিসেম্বরের শুরুতে গাজার ৬৯ শতাংশ ভবন ও স্থাপনা পুরোপুরি ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সে সাথে গাজার রাস্তাঘাটের ৭৫ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে। জাতিসংঘ আরো জানিয়েছে, অনেক হাসপাতাল এবং এর আশপাশের এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার একাধিক উদাহরণ পাওয়া গেছে। যা সেখানে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। জাতিসংঘের দেওয়া তথ্যে বলা হয়েছে, গাজার ৫০ শতাংশ হাসপাতাল বন্ধ হয়ে গেছে। বাকি হাসপাতালগুলোয় আংশিকভাবে কাজ চলছে। যার মানে হলো, হাসপাতালগুলো খোলা আছে ঠিকই কিন্তু তারা দীর্ঘস্থায়ী রোগ এবং জটিল আঘাতের কোনো চিকিৎসা দিতে পারছে না। ইসরাইল শুরু থেকেই অভিযোগ করে আসছে, হামাস হাসপাতাল এবং এর আশপাশে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, যেমন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা না থাকার ব্যাপক সমালোচনা করেছে।
জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী চলমান সংঘাতে অন্তত দুু’সহস্রাধিক চিকিৎসাকর্মী নিহত হয়েছেন। গাজার ছয়টি পাবলিক কমিউনিটি মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং একমাত্র ইনপেশেন্ট সাইকিয়াট্রিক হাসপাতালও এখন আর চালু নেই বলে সেভ দ্য চিলড্রেন বিবিসিকে জানিয়েছে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, প্রায় দশ লাখ শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তার প্রয়োজন যা মোকাবিলা করা এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। মিসেস হাস্টার বিবিসিকে বলেছিলেন, অনেক বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবা এখন দক্ষ কর্মী এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ছাড়া চলছে।
জায়নবাদী আগ্রাসনে গাজার শিক্ষা ব্যবস্থারও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আইডিএফ জানায়, তারা জুলাই মাসের মাঝামাঝি থেকে হামাস যোদ্ধাদের লক্ষ্য করে ৪৯টি স্কুল ভবনে হামলা চালিয়েছে। স্থানগুলো তখন আর স্কুল হিসেবে চালু ছিল না বরং বাস্তুচ্যুত মানুষের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল। কিন্তু স্কুল ভবনে হামলায় যে ক্ষতি হয়েছে তা গাজায় শিক্ষা স্বাভাবিক করতে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। বিবিসি দেখিয়েছে, ইসরাইল তাদের সামরিক অভিযান শুরুর পর পর কীভাবে শত শত পানির লাইন এবং স্যানিটেশন সুবিধা ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস করে দিয়েছে। অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ অর্থাৎ মানুষের বাড়িঘর থেকে শুরু করে জনসেবা কেন্দ্র পুনরায় নির্মাণ করাই হবে সামনের বছরগুলোয় একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। মে মাসে জাতিসংঘ অনুমান করেছিলো যে গাজা পুনর্গঠনে ৪০ বিলিয়ন বা চার হাজার কোটি ডলার খরচ হতে পারে।
জাতিসংঘের মানবিক সহায়তার সমন্বয় অফিস-ওসিএইচএ ধারণা করছে, গাজায় অন্তত ২১ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে যা কিনা গাজার মোট জনসংখ্যার ৯৩ শতাংশ। অর্থাৎ এ মানুষ তাদের বাড়ি ছেড়ে গাজার অন্য জায়গায় যেতে বাধ্য হয়েছেন। কেউ কেউ একাধিকবার এক স্থান থেকে অন্য স্থানে আশ্রয় নিতে হয়েছে। গাজার ২৩ লাখ মানুষের প্রায় সবাইকে বাড়িঘর ছেড়ে যেতে হয়েছে। কারণ ইসরাইল বিরামহীনভাবে আক্রমণ চালিয়েছে। সাম্প্রতিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে গাজার উত্তরাঞ্চলে প্রায় ৯০ শতাংশ এলাকা থেকে মানুষকে সরে যেতে বলা হয়। কারণ ইসরাইল উত্তর গাজায় বড় আকারে হামলা চালায়।
এমনকি মানবিক অঞ্চল (হিউমেনিটেরিয়ান জোন) যেখানে ফিলিস্তিনিদের নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য যেতে বলেছিল আইডিএফ, সেখানেও তারা বহু বিমান চালায়। আইপিসি গ্রুপ যারা সরকার, দাতব্য সংস্থা এবং এজেন্সির সাথে কাজ করে, তারা জানিয়েছে, উত্তর গাজায় সাম্প্রতিক অভিযানগুলোর পর সেখানে দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ সংকটগুলোর মধ্যে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো কৃষিজমির ক্ষতি। সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সংস্থাগুলো জানিয়েছে, গাজার ৭৭ দশমিক ছয় শতাংশ কৃষিজমি গোলাবর্ষণ, যানবাহনের চলাচল ও অন্যান্য সংঘর্ষজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত কয়েক মাসে গাজায় পৌঁছানো ত্রাণ সহায়তার পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হরে কমে গেছে। আগে প্রতিদিন গড়ে ৫০০ ট্রাক ত্রাণ গাজায় ঢুকত। কিন্তু ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ত্রাণ আসা কমে গিয়েছে যা এখনো স্বাভাবিক হয়নি। ত্রাণ ঢুকলেও অনেক সময় তা সঠিক জায়গায় পৌঁছাতে পারছে না। গাজার ত্রাণকর্মীরা জানাচ্ছেন, অপরাধী চক্রগুলো ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানোর সময় তা আটকে ফেলে এবং জিনিসপত্র লুট করে। কারণ সেখানে আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। জাতিসংঘের ধারণা, প্রায় ১৯ লাখ মানুষের জরুরি আশ্রয় এবং প্রয়োজনীয় গৃহস্থালি সামগ্রীতে প্রয়োজন। যুদ্ধবিরতি হয়তো ত্রাণ পৌঁছানো সহজ করবে, কিন্তু বড় প্রশ্ন হলো, গাজা কীভাবে আবার গড়ে তোলা হবে। ১৫ মাসের ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের পর গাজা পুনর্গঠনে ১০ বছরেরও বেশি সময় লাগতে পারে।
মূলত, ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় গণহত্যা ২০২৩ সাল থেকে শুরু হওয়া নিয়ে প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসকে দায়ি করা হলেও এ দাবি মোটেই বাস্তবসম্মত নয়। কারণ, ১৯৪৮ থেকেই গাজায় নির্মম ও নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ চলছে এবং সে ধরাবাহিকতা এখনো অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু এ গণহত্যা বন্ধে বিশ্ব সম্প্রদায় সহ জাতিসংঘের মত বিশ্বসংস্থাও বরাবর ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। আর বর্তমান সময়ে এসে এ ব্যর্থতার ষোলকলা পূর্ণ হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ফিলিস্তিনে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৫৬ সালে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের সশস্ত্র শান্তিরক্ষী মোতায়েন করা হয়। তাদের গন্তব্য ছিল সিনাই ও গাজা উপত্যকা, যা তখন মিশরের নিয়ন্ত্রণে ছিল। সেখানে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইসরাইলের যৌথ আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়। ফিলিস্তিনের গাজায় যখন ইসরাইলি নৃশংসতা যখন চরমে, তখন জাতিসংঘ ৮০তম সাধারণ অধিবেশনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তখন অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, এখন গাজার জন্য কী করতে পারে জাতিসংঘ? কেন তারা বেশি কিছু করতে পারছে না? যদিও সুয়েজ সংকট ও গাজার বর্তমান পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। জাতিসংঘের বিশেষ বাহিনীর মোতায়েন এখনকার সময়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়, বিশেষ করে তারা কীভাবে পদক্ষেপ নিতে পারে।
বহু আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ ও গবেষক বলছেন, গাজায় যা চলছে, তা রীতিমত গণহত্যা। এরপরও গাজায় চালানো ইসরাইলের আক্রমণকে নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়ে আসছে বিশ্ব পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে কমপক্ষে ছয়বার ভেটো দিয়েছে দেশটি। এতে যুদ্ধবিরতি ও মানবিক সহায়তা প্রবেশের আহবান জানিয়ে তোলা প্রস্তাবগুলো আটকে গেছে। ১৯৫৬ সালেও এভাবে নিরাপত্তা পরিষদ অচল ছিল। কারণ তখন দু’পরাশক্তি ব্রিটেন ও ফ্রান্স ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করত। তখন জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৯৫০ সালের ‘শান্তির পক্ষে ঐক্য’ প্রস্তাব ব্যবহার করে নিরাপত্তা পরিষদকে পাশ কাটিয়ে সেখানে শান্তিরক্ষী পাঠায়। জাতিসংঘ সনদের অধ্যায়-৭ অনুযায়ী শান্তিরক্ষী পাঠানো ও নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষমতা আছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের হাতে। ১৯৫৬ সালে সাধারণ পরিষদের পক্ষে একটি বড় শক্তি কাজ করেছিল, তা হলো যুক্তরাষ্ট্রের দৃঢ় সমর্থন। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডুইট আইজেনহাওয়ার ব্রিটেন-ফ্রান্স-ইসরাইলের চালানো যৌথ আক্রমণের বিরোধিতা করেছিলেন।
জাতিসংঘের তৎকালীন সাহসী মহাসচিব ড্যাগ হ্যামারশোল্ড অনেক দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করে শান্তিরক্ষীদের মোতায়েনের জন্য সম্মতি আদায় করেন, তখন মিশরও বিষয়টি গ্রহণ করেছিল। কিন্তু কূটনীতিক ও বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র এখন গাজাকে আন্তর্জাতিকীকরণ করতে রাজি নন। এখন গাজার জন্য শিক্ষা হলো, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও কৌশল থাকলে পরিষদ নিরাপত্তা পরিষদকে পাশ কাটিয়ে পদক্ষেপ নিতে পারে সাধারণ পরিষদ। যদিও শেষ পর্যন্ত সদস্য দেশগুলোর সদিচ্ছার ওপরই নির্ভরশীল জাতিসংঘ।
গণহত্যা রোধে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ইতিহাস তেমন একটা গৌরবজনক নয়। সর্বোচ্চ বললে জাতিসংঘের রেকর্ড মিশ্র বলে মনে করেন মার্টিন শ। তিনি সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক ও গণহত্যা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। রুয়ান্ডা ও বসনিয়ার গণহত্যার ক্ষেত্রে কেবল ঘটনার পরেই বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে গণহত্যা বলে স্বীকার করে জাতিসংঘ। রুয়ান্ডার ক্ষেত্রে এ ব্যর্থতা আরও জোরালো ছিল। সেখানে হালকা অস্ত্রসহ মোতায়েন জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর কমান্ডার রোমিও ডালেয়ার বারবার সতর্ক করেছিলেন, গণহত্যা হতে পারে। কিন্তু জাতিসংঘ তখন কার্যকর ব্যবস্থা নিয়ে ব্যর্থ হয়েছিল।
৭ অক্টোবর হামাসের নেতৃত্বে ইসরাইলের দক্ষিণাংশে আক্রমণের পর গাজায় ইসরাইলের আক্রমণে অন্তত ৬৫ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু বলে দেশটির স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে। পুরো এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। গাজায় বোমাবর্ষণ ও ঘরবাড়ি ধ্বংস করে নতুন আবাসন ও বসতি স্থাপনের কথা প্রকাশ্যে বলেছেন ইসরাইলের অর্থমন্ত্রী। ফিলিস্তিন ও ইসরাইল সংক্রান্ত জাতিসংঘের সর্বোচ্চ তদন্তকারী সংস্থা সম্প্রতি জানিয়েছে, গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে ইসরাইল। এটাই এ পর্যন্ত সংস্থাটির সবচেয়ে বড় ঘোষণা। মার্টিন শ বলেন, এদিক থেকে গাজার গণহত্যা অন্যসব ঘটনা থেকে আলাদা। গাজা আলাদা কারণ এখানে জাতিসংঘ দেরিতে নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র ও রাজনৈতিক সমর্থন দিয়ে এ গণহত্যায় অংশীদার। বিশ্লেষকরা বলছেন, দুটি কারণে জাতিসংঘ গণহত্যা থামাতে ব্যর্থ হয়: প্রথমত বড় বা ছোট শক্তিগুলোর বিদেশি দেশের ভূমিতে হস্তক্ষেপে আগ্রহ কম। যেমন, সুদানের দারফুরে ২০০০ সালের দিকে সরকার ও জানজাওয়াদের মধ্যে সংঘটিত গণহত্যার সময় দেখা যায়। দ্বিতীয়ত দারফুরে গণহত্যা চলছে বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করে ২০০৪ সালে। তবে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। সে সময় কয়েকশ শান্তিরক্ষী পাঠায় আফ্রিকান ইউনিয়ন। কিন্তু ২০০৬ সাল পর্যন্ত কোনো মিশন অনুমোদন করেনি জাতিসংঘ।
প্যারিসের সেন্টার থুসিডিস-এ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বিশেষজ্ঞ অ্যালেক্সান্দ্রা নভোসেলফ বলেন, ‘এটি জাতিসংঘের ব্যর্থতা নয়, বরং সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ব্যর্থতা। জাতিসংঘ নিষেধাজ্ঞা, শান্তিরক্ষী বাহিনী, দেশগুলোর জোট তৈরির মতো সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে, কিন্তু সে সিদ্ধান্ত সদস্যদের ওপর নির্ভর করে। তার ভাষ্য, ফ্রান্স ও সৌদি আরব সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য প্রস্তাব আনতে যাচ্ছে। কিন্তু গাজা নিয়ে এ পর্যন্ত সাধারণ পরিষদে কোনো শক্তিশালী পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। কারণ সাধারণ পরিষদের সদস্য দেশগুলো বিভক্ত।
ইতিহাসের শিক্ষা হলো, ক্ষমতাধর দেশগুলোর সামরিক হস্তক্ষেপ ছাড়া জাতিসংঘের পক্ষে গণহত্যা থামানো সম্ভব নয়। ১৯৯৫ সালে বসনিয়ায় স্রেব্রেনিৎসা গণহত্যার পর যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয় হয়েছিল। জাতিসংঘ আগে থেকেই সার্বিয়ার ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। কিন্তু মুসলিম বসনিয়ানদের হত্যা ঠেকানো যায়নি। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা বসনিয়ান মুসলিম ও খ্রিষ্টান ক্রোয়াটদের অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে এবং ন্যাটো জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অনুমতি নিয়ে সার্বিয়ায় বিমান হামলা চালায়।
ক্যাটো ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো ডগ ব্যান্ডো মনে করেন, গাজায় ইসরাইলী নৃশংসতার জন্য জাতিসংঘ দায়ী নয়। বরং এ জন্য দায়ী ইসরাইলের প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘের নিজস্ব কোনো বাহিনী নেই। তারা রুয়ান্ডা, সুদান বা লাইবেরিয়ায় গণহত্যা থামাতে পারেনি। ফলে গাজায় যা চলছে, তা থামাতে পারবে এমন আশা করা যায় না। গাজার চলমান ঘটনার জন্য প্রায় সব দোষ যুক্তরাষ্ট্রের উল্লেখ করে তিনি বলেন, একদিকে তারা ইসরাইলকে অস্ত্র দেওয়াসহ নানাভাবে সহযোগিতা করছে। অন্যদিকে জাতিসংঘকেও পদক্ষেপ নিতে বাধা দিচ্ছে।
ফিলিস্তিনের গাজায় ২৩ মাসেরও বেশি সময় ধরে ভয়াবহ আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। হামাস উৎখাত ও জিম্মি মুক্তির নামে প্রতিদিনই অবরুদ্ধ উপত্যকাটিতে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে দখলদার সেনারা। পুরো বিশ্ব তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানালেও নেতানিয়াহু প্রশাসনকে আগ্রাসনমূলক এ কর্মকাণ্ডে নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। সবশেষ গাজার যুদ্ধবিরতি আলোচনায় মধ্যস্থতাকারী দেশ কাতারের রাজধানী দোহায়ও হামলা চালিয়েছে তারা। ফলে থমকে গেছে গাজা যুদ্ধবিরতির আলোচনা। তবে গাজা উপত্যকায় চলমান ইসরাইলী গণহত্যা থামানোর একটি পথ এখনও অবশিষ্ট আছে বলে মনে করেন নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন। গত ১৯ সেপ্টেম্বর এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান। জেসিন্ডা বলেন, ফিলিস্তিনকে আরও বেশি দেশ স্বীকৃতি দিলেই গাজায় ইসরাইলী গণহত্যা বন্ধের পথ সুগম হবে। পাশাপাশি যেকোনো সামরিক অভিযানে সহযোগিতা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। তার ভাষায়, গাজায় অবরুদ্ধ ও অনাহারগ্রস্ত মানুষের কাছে জরুরি ভিত্তিতে মানবিক সহায়তা পৌঁছাতে হবে। একইসঙ্গে আহত, অপুষ্টিতে ভোগা মানুষ এবং অন্তঃসত্ত্বা ও সদ্য মা হওয়া নারীদের জন্য চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা জরুরি।
এছাড়া আগামী সপ্তাহে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের ৮০তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশন উপলক্ষে বিশ্ব নেতাদের উদ্দেশে জেসিন্ডা বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে শুরু করে জলবায়ু সংকটজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ-সব মানবিক বিপর্যয়ে শক্তিধর দেশগুলোকে পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে আমাদের শুরুটা করা উচিত গাজা থেকেই। তিনি আরও বলেন, মানবিক সংকটে ভরা এক বিশ্বে বাস করছি আমরা। কিন্তু কেবল সংখ্যার দোহাই দিয়ে মানুষকে অমানবিক করে তোলা থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে।
মূলত, ২০২৩ বছরের ৭ অক্টোবর হামাসের অতর্কিত এক হামলার জেরে ফিলিস্তিনের গাজায় ভয়াবহ এক সামরিক অভিযান শুরু করে ইসরাইল। এরপর থেকে চলমান নির্বিচার আগ্রাসনে এখন পর্যন্ত ৬৫ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। সে সাথে ধ্বংস হয়ে গেছে গাজার ৮০ শতাংশ অবকাঠামো। এরই মধ্যে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজা দখল করে ‘বৃহত্তর এক ইসরাইল’ গঠনের পরিকল্পনা প্রকাশ্যে এনেছেন সম্প্রতি, যেখানে তাকে সমর্থন জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যা বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষকে রীতিমত হতবাক করেছে।
জায়নবাদী নৃশংসতা ও হত্যাযজ্ঞে গাজা নগরী এখন রীতিমত বধ্যভূমিতে পরিণত। ইসরাইলী নিধনযজ্ঞ অতীতের সকল নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতাকে হার মানিয়েছে। ফলে গাজা এখন রীতিমত ধ্বংসস্তূপ। উপত্যকার ৮০ শতাংশ মানুষই এখন আশ্রয়হীন। প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী, জরুরি স্বাস্থ্যসেবা সহ সকল প্রকার মানবিক সরবরাহ ব্যবস্থা এখন পুরোপুরি বিপর্যস্ত। এ অবস্থায় আমরা নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সাথে একাত্ম হয়ে বলতে চাই স্বাধীন ফিলিস্তিনই এ হত্যাযজ্ঞা বন্ধের একমাত্র উপায়। একই সাথে মিত্রদের দখলদার বাহিনীকে সামরিক সহায়তা বন্ধ করতে হবে। শুধুমাত্র জাতিসংঘের ওপর দায় চাপিয়ে এ সমস্যার সমাধান হবে না।