প্রফেসর আর. কে. শাব্বীর আহমদ
আমরা যখন বিবেকহীনভাবে চলাফেরা করি, ঠুনকো আনন্দে গা ভাসিয়ে দেই, মিথ্যা-প্রতারণায় মানুষদের ঠকাই, তখন কী আমাদের একবারও অনুশোচনা হয় না, একবারও কী মনকে নাড়া দেয় না যে, এ কাজগুলো কি অন্যায় নয়, এ কাজগুলো আল্লাহ তা’আলা পছন্দ করেন কি-না, একবারও আখিরাতে আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার ভয় মনে আসেনা? ভালো আর মন্দ কি এক? ভালো কাজের পুরস্কার আর মন্দ কাজের শাস্তি কি হবে না? অবশ্যই হবে। আল্লাহ তা’আলার ঘোষণা : “যে ব্যক্তি অণু পরিমাণ ভালো কাজ করবে, তার পুরস্কার সে দেখতে পাবে। আর যে অণু পরিমাণ মন্দ কাাজ করেছে, তার মন্দ পরিণতিও (কঠিন শাস্তি) সে দেখতে পাবে।” -সূরা আয যিলযাল, আয়াত-৭,৮। নিজের মন্দ কাজের অভ্যাসগুলো বর্জন করে আমরা যেন নিজেদের বদলে ফেলি। দুনিয়া ও আখিরাতের জীবনকে সুন্দর করি।
আমাদের জীবন ভাসমান নৌকার মতো। যদি সত্য পথের হাল ধরে এগিয়ে যেতে পারি, তাহলে আর কিছু পথ গেলে জান্নাতের ঠিকানায় পৌঁছে যেতে পারি। আর যদি ন্যায়-নীতিহীন মনগড়া পথে এগিয়ে যাই, তাহলে বেশি দূর যেতে না যেতেই ঘূর্ণিঝড়ে জাহান্নামের অতল তলে হারিয়ে যেতে পারি। বেলা ফুরাবার আগে শুদ্ধ জীবনচর্চায় নিবেদিত হই। অতীতের ভুলগুলো শুধরে নিজেকে বদলে ফেলি!
আল্লাহ তা’আলার দীন বা পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা আল ইসলামের প্রতিটি বিধানকে ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনের মতো সর্বক্ষেত্রে বাস্তবায়নের জন্য আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করি। যা নবী, রাসূল, সাহাবা ও সৎকর্মশীল মানুষগণ যুগে যুগে শত নির্যাতন সহ্য করেও আঞ্জাম দিয়ে গেছেন। এ দ্বীনী দায়িত্ব পালন করে আল্লাহর সন্তোষ অর্জনের মাধ্যমে আমরা আমাদের দুনিয়া ও আখিরাতের জীবনকে সার্থক করে তুলি। শুধু দুনিয়ার সুখ-সম্পদের মোহে অনন্ত জীবনের সুখের জন্য নিজের কুপ্রবৃত্তিকে বদলে ফেলি!
অপরাধমুক্ত, নৈতিকতাপূর্ণ বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য আমরা সমস্ত অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকি। নিজেদেরকে পরিশুদ্ধ করে আল্লাহ তা’আলার ক্ষমাপ্রাপ্ত হওয়ার যোগ্য করে তুলি এবং ক্ষমাপ্রাপ্ত সৎ, যোগ্য নেতৃত্বের হাতে আমাদের দেশ পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করি। যাতে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ মৌলিক অধিকার লাভ করে নিরাপদে বসবাস করতে পারে। আল্লাহ ছাড়া কারো গোলামি না করে স্বদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে পারে। অন্যের লেজুড়বৃত্তি ও গোলামির মানসিকতাকে বদলে ফেলত পারি আমরা সবাই। কবর জীবনকে নিরাপদ রাখার জন্য দুনিয়ার জীবনে সর্বস্তরে আল্লাহর দ্বীন বা বিধান কায়েমের কাজে আমরা আত্মনিবেদিত থাকি।
জীবনের ভুলগুলো শুধরে ফেলে আগামী জীবনে আর গুনাহ না করার শপথ নিয়ে হৃদয়ের অশ্রু ঢেলে অতীত জীবনের গুনাহ মাফের জন্য আল্লাহ তাআলার কাছে আকুতি জানাই! আল্লাহ তাআলার প্রিয় বান্দাহ হওয়ার জন্য আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে নিজেকে বদলে ফেলি! আল্লাহ তা’আলা আমাদের ক্ষমা করুন!
আমরা সত্যিকার ঈমানদার মুসলিমরা দলমত নির্বিশেষে সীসাঢালা প্রাচীরের মতো ঐক্যবদ্ধ হয়ে সব ধরনের অন্যায়-অরাজকতার বিরুদ্ধে প্রাণান্তকর সংগ্রাম সাধনায় নিবেদিত হই। তাহলে সমাজ থেকে অন্যায় অবিচার দূরীভূত হবে। সব ধর্মের সর্বস্তরের মানুষ সার্বিক অধিকার নিয়ে নিরাপদে বসবাস করতে পারবে। শিক্ষা-সংস্কৃতিতে, সমাজ ও রাষ্ট্রে সর্বজনীন শান্তিপূর্ণ ইসলামি বিধান প্রতিষ্ঠা করে সেক্যুলার-ধর্মনিরপেক্ষ- বাদীদের অপকৌশল ও ভ্রান্ত ধারণার অপনোদন করা এখন সময়ের দাবি। মানব তৈরি ভ্রান্ত ধারণার অসারতা উপলব্ধি করে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে নিজের চিন্তা-চেতনাকে বদলে ফেলা আমাদের অপরিহার্য কাজ। আজকেই যদি আমার জীবনের শেষ দিন হয়, তাহলে আমার আজকের আমলগুলো কেমন হওয়া উচিত ভেবে নিয়ে আল্লাহর বিধান ও রাসূলের আদর্শের আলোকে নিজেকে ঢেলে সাজাই। আটপৌরে জীবনের আচার-আচরণকে বদলে ফেলি।
আমাদের সামনেই রয়েছে পরকালের অনন্ত যাত্রা। সে যাত্রার জন্য কি আমরা কোনো পাথেয় জমা রাখি? সময়ের শেষ ঘণ্টা বাজার আগেই কি আমাদের উচিত নয়, অনন্তকালের সুখের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা। আমরা ব্যক্তি ও সমাজে আল্লাহর আনুগত্য প্রতিষ্ঠায় আত্মনিবেদিত হয়ে আল্লাহর সন্তোষকে পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করি। পরনির্ভরশীলতার অভ্যেস বদলে ফেলি।
আমাদের জীবনবেলা ধীরে ধীরে ফুরিয়ে যাচ্ছে। আল্লাহর প্রতিশ্রুতি নিকটতর হচ্ছে। আল্লাহ তা’আলা বলছেন, “মানুষের হিসেব-নিকেশের সময় ঘনিয়ে আসছে। অথচ তারা উদাসীনতায় আল্লাহ বিমুখ হয়ে আছে।” -সূরা আল আম্বিয়া, আয়াত-০১।
আসুন ক্ষণস্থায়ী জীবনে আল্লাহর বিধান মোতাবেক জীবন ও সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রকে সাজিয়ে তুলে নিজের জীবনকে সার্থক করে তুলি। শয়তানের কুমন্ত্রণায় পাপ-পংকিলতা ও মানবরচিত মনগড়া আইন থেকে মুক্ত থেকে নিজের ভ্রান্ত জীবনকে বদলে ফেলি। পরিশুদ্ধ মানুষ হই।
জান্নাত পরিবেষ্টিত আছে দুঃখ-কষ্ট-বেদনা দ্বারা। এগুলো সহ্য করেই জান্নাতে যেতে হবে। জাহান্নাম পরিবেষ্টিত আছে লোভ-লালসা, কামনা-বাসনা দ্বারা। এগুলো ধারে-কাছেও যাওয়া যাবে না। আসুন আল্লাহ-রাসূলের আনুগত্যে হাজারো কষ্ট স্বীকার করে হলেও আমরা আমাদের নিজের জীবনকে নির্যাতিত সাহাবাদের মতো জান্নাতের জন্য বদলে নেই।
ফিলিস্তিনসহ আজ বিশ্বমুসলিম জুড়ে মুসলমানরা ইহুদি খ্রিস্টান মুশরিকদের হাতে চরমভাবে নির্যাতিত হচ্ছে, মুসলমানদের আবাসস্থল, মাসজিদ, মাদরাসা, ইবাদতখানা, আদর্শিক প্রচারকেন্দ্র ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। অথচ বিশ্বের প্রায় দু’শ কোটি মুসলিম রাষ্ট্রীয় শক্তি ঐক্যবদ্ধ সামরিক প্রতিরোধ গড়ে না তুলে নীরব ভূমিকা পালন করছে। পরাশক্তিগুলোর লেজুড়বৃত্তি করছে। প্রকৃত মুসলিম আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে মাথা নত করে না। নিজের ঈমানী বল ও পার্থিব শক্তি সামর্থ্য নিয়ে বাতিলের বিরুদ্ধে লড়াই করে। তবেই আল্লাহর অদৃশ্য সাহায্য নেমে আসে।
আমাদের উচিত, ইহুদি খ্রিস্টান মুশরিকদের প্রতি নতজানু আচরণ ও লেজুড়বৃত্তি পরিত্যাগ করে আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুলে ঋদ্ধ হয়ে খাঁটি মুসলিম হিসেবে নিজেদের জীবনকে বদলে ফেলা।
আমরা একটি অনিবার্য দ্বীনী বিপ্লবে নিবেদিত হই। আমি যে দ্বীনের কথা বলছি তা একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান সার্বভৌম সত্তা মহান আল্লাহর মনোনীত দ্বীন আল ইসলাম।
যে দ্বীনী বিপ্লব সাধিত হলে ফুলে ফলে সুশোভিত হবে মানব পৃথিবী। সুরেলা পাখির মায়াবী কূজনে মুখরিত হবে দিক দিগন্তর। নব সম্ভাবনার সোনালি সূর্য উদিত হবে জুলমাত ফেঁড়ে। আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হবে না অসহায় নিপীড়িতের রোনাজারি। পলিবাহী নদীরা দ্বিগুণ বেগে প্রবাহিত হবে আবাদী জমিতে। নয়নাভিরাম হৃদয়ছোঁয়া ফসলে সমৃদ্ধ হবে ফসলের করিতকর্মারা। আকাশ যমিন খুলে দেবে বারাকাতের সমস্ত দরজা বিশ্বাসীদের সৌজন্যে। অবিশ্বাসী স্বৈরাচারীর খড়গ কৃপাণ ভেঙে খানখান হবে মাজলুমানের ফরিয়াদে। যে দ্বীনী বিপ্লব সাধিত হলে মানুষে মানুষে থাকবে না কোনো ভেদাভেদ। প্রতিটি মানুষ ফিরে পাবে তার বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার। মাথা গোঁজার নিরাপদ স্বাধীন ভূখণ্ড পাবে আপামর জনতা।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার অবারিত স্বাধিকার পাবে প্রতিটি নাগরিক। রোগে শোকে ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতরাবে না কোনো প্রজাতি। কোনো বিধবা দরিদ্র যৌবনা নারী সম্ভ্রম হারাবে না চরিত্রহীনের কবলে। মুশরেকী খোদাদ্রোহী অনৈতিক শিক্ষায় পাষণ্ড হবে না কোন মানবগোষ্ঠী।
আমরা আহ্বান জানাই-সুসভ্য ন্যায়পরায়ণ আদর্শ নেতৃত্বের জন্য একটি দ্বীনী বিপ্লবের। এ বিপ্লবের জন্য প্রয়োজন নির্মোহ ভালোবাসা সত্যপ্রেম, সদোপদেশ, হিকমাহ, পরার্থপরতা, কল্যাণকামিতা, আত্মত্যাগ আর উজাড় মানবিকতার। যে মানবিকতায় হিংসার বোমা সুগন্ধি গোলাপে পরিণত হবে। প্রতিটি বুলেট হবে নিরন্ন মানুষের জন্য এক একটা শস্যদানা।
আসুন, আমরা মাজলুম মানবতার সার্বিক মুক্তির জন্য জীবন ও সম্পদ দিয়ে আল্লাহদ্রোহী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য নিজের ভীরুতা বর্জন করে আল্লাহর সৈনিক হিসেবে নিজেকে বদলে ফেলি! আল্লাহর রাহে জীবন ও সম্পদ উৎসর্গ করে বিনিময় হিসেবে চিরসুখের স্থান জান্নাত লাভ করি। আল্লাহ তা’আলা আমাদের কবুল করুন ও সত্যিকার মুসলিমের মতো ঈমানী শক্তি, সাহস দান করুন! আমীন!
লেখক : শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, কবি।