জাফর আহমাদ
মহান আল্লাহ তাঁর বান্দার প্রতি বড়ই মেহেরবান। পাহাড়সম পাপাচারে নিমজ্জিত হওয়ার পরও যদি সে মহান আল্লাহর দিকে ফিরে আসে, তাতে তিনি শুধু ক্ষমাই করেন না বরং তিনি খুশিও হন। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “যদি কোন ব্যক্তি খারাপ কাজ করে বসে অথবা নিজের ওপর জুলুম করে এবং এরপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে তাহলে সে আল্লাহকে ক্ষমাকারী ও পরম দয়ালু হিসাবেই পাবে।” (সুরা নিসা: ১১০) হাদীসে কুদসীতে বর্ণিত হয়েছে, ‘হে আদম সন্তান! তোমার গোনাহের পরিমাণ যদি আসমানের কিনারা বা মেঘমালা পর্যন্তও পৌঁছে যায়, তারপর তুমি আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেবো, এতে আমি পরোয়া করবো না। হে আদম সন্তান! তুমি যদি সম্পূর্ণ পৃথিবী পরিমাণ গোনাহ নিয়েও আমার কাছে আসো এবং আমার সঙ্গে কাউকে অংশীদার না করে থাকো, তাহলে তোমার কাছে আমি পৃথিবী পরিমাণ ক্ষমা নিয়ে হাজির হবো।’ (তিরমিযি: ৩৫৪০)
তিনি রাউফুম বিল ইবাদ অর্থাৎ বান্দার প্রতি অতিশয় শুভাকাক্সক্ষী বা অত্যন্ত দয়ালু আল্লাহ তা’আলা তাঁর বান্দাদের প্রতি পরম শুভাকাক্সক্ষী। কারণ তিনি পূর্বাহ্নেই তাদের এমন সব কাজ থেকে সতর্ক করে দিচ্ছেন, যা পরিণামে তাদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারতো। এটি আল্লাহ তা’আলার চরম কল্যাণাকাংখারই প্রকাশ। যেমন: আল্লাহ তা’আলা বলেছেন : “সেদিন আসবে, যেদিন প্রত্যেক ব্যক্তি তার কৃতকর্মের ফল সামনে উপস্থিত পাবে, তা ভাল কাজই হোক আর মন্দ কাজ। সেদিন মানুষ কামনা করবে, হায়! যদি এখনো এ দিন এর থেকে অনেক দূরে অবস্থান করতো! আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর নিজের সত্তার ভয় দেখাচ্ছেন। আর তিনি বান্দাদের প্রতি গভীর শুভাকাক্সক্ষী।” (সুরা আলে ইমরান ঃ ৩০) আল্লাহ মানুষের শূভাকাংখী বলেই তিনি ভয়াবহতম চূড়ান্ত দিন আসার আগেই নবী, কিতাব ও দীন-ইসলাম দিয়ে আমাদের হিদায়াতের ব্যবস্থা করেছেন। ভালো কাজের প্রতি আগ্রহ ও মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার বোধশক্তি দান করেছেন।
বান্দাদের প্রতি মহান আল্লাহ অত্যন্ত কল্যাণকামী। এ কল্যাণের জন্যই তিনি সত্য-সরল পথ দান করেছেন এবং দৈনন্দিন জীবনে প্রবৃত্তির ঘূর্ণাবর্তে পড়ে ভুল করার পরও সঙ্গে সঙ্গে তা হিসাবের খাতায় না তুলে অবকাশ দেন। আর নেক কাজের ইচ্ছা পোষণ করলেই নেকী লিখা হয়। বান্দার প্রতি এটিই তাঁর ইহসান। দু’টি হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন: আবু হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেছেন: আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, আমার বান্দা যখন কোন ভাল কাজের নিয়্যাত করে অথচ এখনো তা কাজে বাস্তবায়ন করেনি, তখন আমি তার জন্য একটি সাওয়াব লিখি; আর যদি তা কাজে পরিণত করে তবে দশ থেকে সাতশ’ গুণ পর্যন্ত সাওয়াব লিখি। পক্ষান্তরে যদি মন্দ কাজের নিয়্যাত করে অথচ এখনো তা কাজে পরিণত করেনি তবে এর জন্য কিছু লিখি না। আর তা কাজে পরিণত করলে একটি মাত্র পাপ লিখি।” (মুসলিম: ২৩৩, কিতাবুল ঈমান, বাবু ইজা হাম্মাল আবদু বি হাসানাতিন.......ইফা: ২৩৫, ই. সে: ২৪৩)
ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে বর্ণনা করে বলেন, আল্লাহ তা’আলা ভালো এবং মন্দ উভয়টিকে লিপিবদ্ধ করেন। অতঃপর তিনি এভাবে বর্ণনা দিলেন, যে ব্যক্তি কোন ভালো কাজ করার ইচ্ছা করে অথচ তা এখনো বাস্তবে পরিণত করেনি, তার জন্যে আল্লাহ নিজের কাছে একটি পূর্ণাঙ্গ সাওয়াব লিপিবদ্ধ করেন। আর যদি সে কোন ভালো কাজ করার ইচ্ছা করে এবং তা বাস্তবেও পরিণত করে, তখন আল্লাহ নিজের কাছে দশ থেকে সাতশ’ বা আরো অধিক গুণ বেশি সাওয়াব লিপিবদ্ধ করেন। আর যদি সে কোন মন্দ কাজ করার ইচ্ছা করে এবং তা বাস্তবে পরিণত না করে, তবে তখন আল্লাহ নিজের কাছে একটি পরিপূর্ণ সাওয়াব লিখেন, কিন্তু যদি সে মন্দ কাজটি বাস্তবে পরিণত করে, তখন আল্লাহ তা’আলা কেবলমাত্র একটি পাপই লিপিবদ্ধ করেন।” (মুসলিম: ২৩৬, কিতাবুল ঈমান, বাবু ইজা হাম্মাল আবদু বি হাসানাতিন......, বুখারী: ৩৮৯১, ইফা: ২৩৮, ই. সে: ২৪৬)
বান্দার প্রতি আল্লাহর এতই মেহেরবান যে, কোন মুসলিম বান্দা পাপ করার পর ফেরেশতাগণ সাথে সাথেই আমলনামায় লিপিবদ্ধ করেন না, বরং একটা নির্ধারিত সময় পর্যন্ত তাকে অবকাশ দেন। এ সময়ের মধ্যে যদি সে ব্যক্তি ক্ষমা প্রার্থনা করে তবে তা মুছে দেয়া হয়। পক্ষান্তরে যদি সে ভালো কাজের নিয়ত করে সে ভালো কাজের নিয়তের জন্য তার আমলনামায় সওয়াব লেখা হয়। এমনকি সে যদি কোন খারাপ কাজের নিয়ত করে কিন্তু পাপ কাজটি সে আল্লাহর ভয়ে করেনি, তাতেও তার আমলনামায় সওয়াব লেখা হয়। আল্লাহর কাছে সে ব্যক্তি সবচেয়ে প্রিয় যে গোনাহ করার পর দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমা প্রার্থনা করে। পাপ করার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমা প্রার্থনা করলে আল্লাহ তা’আলা ঐ বান্দাকে মাফ করে দেন।
যারা সত্যিকারের আল্লাহভীরু, যারা অন্তর থেকে আল্লাহকে ভয় করে তাদের কোন অপরাধ সংঘটিত হয়ে গেলে, তার বিবেক তাকে সারাক্ষণ আঘাত করতে থাকে। ফলে সে আল্লাহ কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে। মহান আল্লাহ তা’আলা আল কুরআনে এ শ্রেণীর লোকের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, “আর যারা কখনো কোন অশ্লীল কাজ করে ফেলে অথবা কোন গোনাহের কাজ কাজ করে নিজেদের ওপর জুলুম করে বসলে আবার সংগে সংগে আল্লাহর কথা স্মরণ হয়ে তাঁর কাছে নিজেদের গোনাহ খাতার জন্য মাফ চায়-কারণ আল্লাহ ছাড়া আর কে গোনাহ মাফ করতে পারেন-এবং জেনে বুঝে নিজেদের কৃতকর্মের ওপর জোর দেয় না। এ ধরনের লোকদের যে প্রতিদান তাদের রবের কাছে আছে তা হচ্ছে, তিনি তাদের মাফ করে দেবেন এবং এমন বাগিচায় তাদের প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হবে, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। সৎকাজ যারা করে তাদের জন্য কেমন চমৎকার প্রতিদান!” (সুরা আলে ইমরান: ১৩৫-১৩৬)
মানুষ প্রবৃত্তির অনুসরণ করে পাপে লিপ্ত হলে আল্লাহ তা’আলা তাদের দয়া করেন, তার আমলনামায় ততটুকু গোনাহই লিখা হয়, যতটুকু সে করেছে। পক্ষান্তরে যখন কোন ব্যক্তি নেক কাজ করে তার জন্য দশগুণ বাড়িয়ে আমল নামায় সওয়াব লেখা হয়। এক হাদীস গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, কোন মুসলিম বান্দা গোনাহ করার পর দু কাঁধের ফেরেশতা ৬ ঘন্টা গুনাহ লিখা থেকে কলম উঠিয়ে রাখেন। যদি সে বান্দা অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে তাহলে ফেরেশতারা সে গোনাহ না লিখে ছুড়ে ফেলে দেন, অন্যথায় একটি গোনাহ লেখা হয়। (সহীহ আল জামি: ২০৯৭, হাদীসটি সহীহ, সিলসিলাহ সহীহাহ: ১২০৯)
সুতরাং আল্লাহর ইহসান পেতে হলে মু’মিনদের উচিত হবে পাপ কাজ করার সাথে সাথে কোন প্রকার অবহেলা না করে ক্ষমা প্রার্থনা করা। এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, প্রত্যেক আদম সন্তান ত্রুটিশীল অপরাধী গোনাহগার। আর অপরাধীদের মধ্যে উত্তম তারা যারা তাওবা করে। (সুনানে তিরমিযি: ২৪৯৯) আল্লাহ তা’আলা বলেন, “হে মু’মিনগণ! তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর কাছে তাওবা করো। আশা করা যায় তোমরা সফলকাম হবে।” (সুরা নুর: ৩১) আসুন, আমরা গোনাহ থেকে বেঁচে থাকি আর গোনাহ হয়ে গেলে মহান দয়ালু আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি। তাওবা করে তাঁর কাছে ফিরে আসলে আল্লাহ খুশি হন। বেশি ইস্তেগফার করলেও তিনি খুশি হন ও ক্ষমা করেন।
লেখক : ব্যাংকার।