ডঃ মুহাম্মদ আনসার মুস্তাকিম

প্রবাস জীবনের জন্য ২০২৪-এর জুলাই ছিল একটা কঠিন থেকে কঠিনতম মাস। মানসিক অস্থিরতায় কেটেছে আমাদের সকলের । শ্বাসরুদ্ধকর দিনগুলো ছিল আমাদের পুরো পরিবারের জন্য এক মহা চ্যালেঞ্জের। বাসায় সৃষ্টি হয়েছিল এক অভাবনীয় অবস্থা। প্রত্যেকের মনের অবস্থা ছিল সবচাইতে অস্বস্তিকর ও সদাশঙ্কিত। কেউ কারো দিকে তাকাতে পারছিলাম না। শুধু চিন্তা একটিই, দেশে কী হতে চলেছে। প্রতিটি মুহূর্তে দেশের পরিস্থিতি ইন্টারনেটে চেক করা-কাজ ছিল একটাই। রাজপথে নেমে পড়া লাখ লাখ সোনার টুকরো তরুণ-যুবকদের নিরাপত্তার বিষয়। ঢাকা তামিরুল মিল্লাতে পড়ছে আমার এক ভাইপো। ফোনে কথা হতো বরাবরই তার সাথে। সে ছিল সেখানকার এক প্রথম সারির যোদ্ধা। ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ীর ছাত্র-পুলিশের সে সম্মুখ সমরে সেও ছিল উপস্থিত। সেদিনগুলোর মানসিক অবস্থার সে কী টান টান অবস্থা। অফিসে কাজের ফাঁকে ফাঁকে শুধু একটাই কাজ ঢাকার পরিস্থিতি কি তার খোঁজ নেয়া।

প্রিয় মাতৃভূমিতে কী হতে যাচ্ছে, আন্দোলন কোন দিকে গড়াচ্ছে এবং সর্বোপরি ছাত্রদের প্রতি স্বৈরাচার হাসিনা রেজিমের নিত্যনতুন দম্ভোক্তি আমাদেরকে ট্রমাটাইজ্ড করে তুলেছিল। আমার স্ত্রী রীতিমতো মানসিকভাবে যারপর নেই আক্রান্ত হয়ে পড়েছিল। ৫ আগস্ট স্বাধীনতা না এলে সম্ভবত তাকে লন্ডনের হাসপাতালে ইমারজেন্সিতে নিতে হতো। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়ি থেকে জীবন্ত যুবককে ফেলে দেওয়ার দৃশ্য যে কত ভয়ংকর। বিশ্ববিবেক সেদিন বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। গুলিবিদ্ধ যুবকের নিথর দেহ রিকশায় তুলে রিক্সাওয়ালার সে কী প্রাণপণ চেষ্টা। সে দৃশ্য সমগ্র পৃথিবীর শান্তিপূর্ণ বিবেককে হতভাক করে তুলেছিল। জনগণের ট্যাক্স থেকে ক্রয়কৃত সরকারি হেলিকপ্টার থেকে নিরপরাধ মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি মনে হয়েছিল বিশ্ব মানবতার বুকে গুলির সমান। ছাত্র-যুবকের সন্ধানে পেটুয়া পুলিশ বাহিনীর ঘরে ঘরে তল্লাশি যা-বোনদেরকে তার প্রিয় সন্তানদের জীবন সম্পর্কে করে তুলেছিল সীমাহীন শংকিত। ১৬ বছরের নিচের বাচ্চাদের কোমরে দড়ি দিয়ে বাঁধার দৃশ্য জাতিকে হতবাক করেছিল। সমগ্র দেশ হয়েছিল জেলখানা আর কয়েদখানার সমতুল্য। দেশের ১৮ কোটি মানুষ হয়েছিল ঐ ফ্যাসিস্ট সরকারের পেটুয়া বাহিনীর কাছে দৃশ্যত জিম্মি।

বাসায় রীতিমতো খাওয়াদাওয়া বন্ধ হয়েছিল আমাদের। পরিস্থিতিটা ঠিক এমনি দাঁড়িয়ে ছিল কিছু একটা ইমিডিয়েট ফায়সালা হতে যাচ্ছে। এটি আসলে শুধু আমাদের পরিস্থিতি ছিল না। আমার ফ্রেন্ড-বন্ধু যারা এ লন্ডনসহ সারাবিশ্বে যেখানেই কথা বলেছি পরিস্থিতি কমবেশি সকলের একই রকম। কী হতে যাচ্ছে বাংলাদেশে? স্বৈরাচার ও ফ্যাসিস্ট হাসিনা রেজিমকে অপসারণ সম্ভব হবে কিনা? আমার মনে হয়েছে বিশ্বজুড়ে আল্লাহর কাছে মানুষ দুহাত তুলে রাতের পর রাত কেঁদেছে সমগ্র জুলাই। আমি জানি বিগত ১৬ টি বছর আল্লাহর দরবারে সারা বিশ্বে বসবাসরত বাংলাদেশী ঈমানদার মুসলমানরা এই রেজিমের ধ্বংস চেয়ে দিনরাত কেঁদেছে।

২৪-এর এ নতুন স্বাধীনতা তাই অত্যন্ত মূল্যবান। দু’হাজারেরও বেশি টগবগে যুবকের রক্ত ঢেলে দিয়ে আনীত এই স্বাধীনতা। ২০ হাজারেরও বেশি তরুণ যুবকের অঙ্গহানি আর পঙ্গুত্ববরণের বিনিময়ে এ স্বাধীনতা। শতশত যুবকের চোখ তুলে নেয়া হয়েছে এ স্বাধীনতার মূল্য দিতে গিয়ে। প্রিয় মাতৃভূমির সন্তানদের রক্ত যে কত তুচ্ছ ছিল ফাসিস্ট হাসিনার কাছে তা আমরা তার জিঘাংসায় দেখেছি।

বাংলাদেশের জনগণের ওপর নির্বিচার গুলি চালানোর নির্দেশ প্রমাণ করে স্বৈরাচার টিক্কা খানের চেয়েও ফ্যাসিস্ট হাসিনা কত ভয়ংকর ছিল। জনগণের জীবনের কোন মূল্য ছিল না তার কাছে। না কেউ ছিল তার হাতে নিরাপদ।

২৪-এর এ নতুন স্বাধীনতা তাই অনেক মূল্যবান। অনেক মা-বাবার কোল খালি করা ত্যাগের বিনিময়ে এ নতুন স্বাধীনতা। ২৪-এর এ স্বাধীনতা ভারতীয় আধিপত্যবাদমুক্ত স্বাধীনতা। খুব জানতে ইচ্ছে করে পাঁচ আগস্ট বিকেলে এয়ারপোর্টে কিছু পুলিশ অফিসার অস্ত্রসহ ভিড় করছিল। এরা কারা? এয়ারপোর্টে অস্ত্রসহ অপেক্ষমান বিমানের পাশে দৌড়ে আসছিল। তাহলে কি এরা বাংলাদেশী ছিল না? তাহলে কি এরা অস্ত্রধারী পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আসা সন্ত্রাসী? আজও কেন জাতি এর প্রকৃত তথ্য জানলো না? এরা কেন ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকলো আজও? এ বিমানটির কী পরিচয়? কোথা থেকে এসেছিল এবং কোথায় চলে গেল? অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিকট স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশীদের প্রত্যাশার একটি দিক হচ্ছে জাতি এ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের বিচার চায়।

লেখক : যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রাবন্ধিক।