নানা তন্ত্রমন্ত্রের মধ্যে ‘গণতন্ত্র’ এমন এক শাসন পদ্ধতি যেখানে নীতিনির্ধারণ বা জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে প্রত্যেক নাগরিকের ভোটাধিকারের নিশ্চয়তা থাকে। এ পদ্ধতিতে আইন প্রস্তাবনা, প্রণয়ন ও তৈরির ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের অংশগ্রহণের সমান সুযোগ স্বীকার করা হয়। সঙ্গত কারণেই গণতন্ত্র আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সবচেয়ে জনপ্রিয় ও কার্যকর শাসন পদ্ধতি হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। প্রচলিত গণতন্ত্রের কিছু নেতিবাচক দিক থাকলেও অপরাপর শাসন পদ্ধতি থেকে এ ব্যবস্থাকে উত্তম ও অধিকতর গতিশীল মনে করা হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক বিশ্বে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বড় ধরনের বিচ্যুতি ঘটতে শুরু করেছে। যা বৈশ্বিক গণতন্ত্রের কক্ষচ্যুতি হিসাবেই দেখছেন বিশ্বের আত্মসচেতন ও গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ।

মূলত, গণতন্ত্রের কথিত প্রতিভূদের হাত ধরেই বৈশ্বিক গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বড় ধরনের অবনোমন হতে শুরু করেছে। বিখ্যাত দ্য ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিনের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ২০২০ সালের শুরুতে প্রকাশিত গণতন্ত্র সূচকে বলা হয়, গণতন্ত্রের পশ্চাৎপসারণ ঘটছে সারা বিশ্বেই। ২০১৯ সালে বৈশ্বিক গণতন্ত্রে বড় ধরনের অবনতি ঘটেছে। যা একটি চলমান প্রক্রিয়ায় রূপ নিয়েছে। এতে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অবস্থা আরও খারাপ বলে দাবি করা হয়। ১৬৭ টি দেশের ওপর চালানো বার্ষিক জরিপের ফলাফলে বাংলাদেশের অবস্থান ৮০ নম্বরে এসে ঠেকেছিলো সে সময়।

৪টি ক্যাটেগরিতে ভাগ করা হয় সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে। এগুলো হলো যেসব দেশে পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্র আছে তাদেরকে রাখা হয়েছে সবার শীর্ষে। এ ক্যাটেগরির নাম দেয়া হয়েছে ‘ফুল ডেমোক্রেসি’। এরপরে রয়েছে যেসব দেশে ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র রয়েছে তাদের নাম। এ ক্যাটেগরিকে আখ্যায়িত করা হয়েছে ‘ফ্লড ডেমোক্রেসি’ হিসেবে। বাংলাদেশের নাম ছিলো এ ক্যাটেগরিতে। এরপরে ছিলো ‘হাইব্রিড রেজিম’। তারপরে ছিলো কর্তৃত্ববাদী শাসন চলছে, এমন দেশের তালিকা। একে আখ্যায়িত করা হয়েছে ‘অথরিটারিয়ান রেজিম’ হিসেবে। অবশ্য কোন কোন আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে ‘হাইব্রিড রেজিম’ এ স্থান দেয়া হয়েছিলো সে সময়।

মোট ৫টি সূচকের ওপর ভিত্তি করে এ তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়। এগুলো হচ্ছে-১. নির্বাচনী প্রক্রিয়া। ২. সরকারের কার্যকারিতা। ৩. রাজনৈতিক অংশগ্রহণ। ৪. গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও ৫. নাগরিক স্বাধীনতা। এসব সূচকের ওপর ভিত্তি করে বলা হয়, ২০১৯ সালে সারাবিশ্বে গণতন্ত্রের ক্ষয় হয়েছে। ২০০৬ সালে এ সূচকের প্রচলন করা হয়। তারপর থেকে ১০ পয়েন্টের মধ্যে গত বছরে সর্বনিম্ন ছিল বৈশ্বিক স্কোর। তা হলো ৫.৪৪। ১৬৭টি দেশের মধ্যে মাত্র ২২টি দেশে পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্র ছিল বলে মনে করা হয় সূচকে। এসব দেশে বসবাস করেন ৪৩ কোটি মানুষ। কিন্তু, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশের বেশি এখনও বসবাস করেন কর্তৃত্ববাদী শাসনের অধীনে। যা বৈশ্বিক গণতন্ত্রের জন্য মোটেই সুখবর নয়।

চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় সিনজিয়াং প্রদেশে বৈষম্য ও ডিজিটাল নজরদারির মতো অন্যান্য নাগরিক স্বাধীনতা লঙ্ঘনের ফলে দেশটির স্কোরের বড় ধরনের অবনতি হয়। ভারতের স্কোর ৩.৩২ থেকে কমে এসে দাঁড়িয়েছিলো ২.২৬। রিপোর্টে বলা হয়, জম্মু ও কাশ্মীর অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নিয়েছে ভারতীয় সরকার। এ ছাড়া আসামে প্রায় ২০ লাখ মানুষকে নাগরিকত্বের বাইরে রাখা হয়েছে। এদের বেশির ভাগই মুসলিম। যা সূচকের অবনমনে ভূমিকা রেখেছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে বৈষম্যমূলকভাবে ভারতের পার্লামেন্টে পাস হয় নাগরিকত্ব সংশোধন আইন। এ প্রক্রিয়া ২০২০ সালের সূচকে দেশটির গণতন্ত্রের সূচকে আরও অবনোমন ঘটেছিলো।

সাব সাহারান আফ্রিকার ৪৪টি দেশের অর্ধেকই এ সূচকে কর্তৃত্বপরায়ণ শাসক শ্রেণিতে পড়েছে। এ অঞ্চলের ২৩টি দেশে গণতান্ত্রিক স্কোর একেবারেই নিম্নমুখী। উন্নতি হয়েছে ১১টি দেশে। এ জন্য দায়ী করা হয় ওই অঞ্চলে অগণতান্ত্রিক নির্বাচনকে। এমন বিতর্কিত নির্বাচন হয় সেনেগালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। দেশটিতে ম্যাকি সাল-এর প্রতিদ্বন্দ্বীদের নির্বাচনের বাইরে রাখা হয়েছিলো।

ফ্রান্সে ইয়েলো জ্যাকেট বিক্ষোভের জবাবে প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন ধারাবাহিকভাবে টাউন হল মিটিং আহ্বান করেন। এর নাম দেয়া হয় ‘গ্রেট ন্যাশনাল ডিবেট’। এতে অনলাইনে যুক্ত হন প্রায় ২০ লাখ নাগরিক। ফলে ফ্রান্সকে ‘পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্রের’ মর্যাদা ধরে রাখতে এমন প্রচেষ্টা সহায়ক হয়েছে। দেশে উচ্চ পর্যায়ের অসমতা ইস্যুতে চিলিতে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ শুরু হয়। সরকার সর্বনিম্ন বেতন বৃদ্ধি করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিক্ষুব্ধদের সাথে সমঝোতা করে। একই সঙ্গে সরকার এ বছরে সেখানে একটি নতুন সংবিধানের ওপর গণভোট দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু যথেষ্ট মূল্যের বিনিময়ে এসেছে এই সংস্কার। ওই বিক্ষোভে মারা গেছেন কমপক্ষে ২০ জন। আহত হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ।

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) ডেমোক্রেসি ইনডেক্স-২০২০ বিষয়ক আরও একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এতে ১৬৫টি দেশ ও দু’টি অঞ্চলের মধ্যে ৭৬তম অবস্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। সেবার বাংলাদেশের স্কোর দাঁড়ায় ৫.৯৯। এর আগের বছর ৫.৮৮ স্কোর নিয়ে এ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৮০তম। তার আগের বছর ৫.৫৭ স্কোর নিয়ে অবস্থান ছিল ৮৮তম। প্রতিবেদন অনুযায়ী আগের বছরের তুলনায় বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সূচকের তেমন হেরফের না হলেও ইষৎ উন্নতির কথা বলা হয়। কিন্তু এর সাথে একমত হতে পারেন নি দেশের ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ। কারণ, তদানীন্তন ফ্যাসিবাদী সরকার তাদের ভোটাধিকার পুরোপুরি কেড়ে নিয়েছিলো।

ইআইইউ ২০০৬ সালে যখন প্রথম এ সূচক প্রকাশ করে, তখন বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৬.১১। সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্ববাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালে তা এক ধাক্কায় ৫.৫২ পয়েন্টে নেমে যায়। অন্যদিকে ২০২০ সালে এ সূচকে পুরো বিশ্বের গড় স্কোর আগের বছরের ৫.৪৪ থেকে কমে ৫.৩৭ হয়েছে। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বলছে, ২০০৬ সালে সূচক প্রকাশের পর থেকে এটাই সবচেয়ে বাজে স্কোর। মূলত, গণতন্ত্রের এ অবনমনের পেছনে মহামারির মধ্যে দেশে দেশে কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপের বিষয়টি বড় ভূমিকা রেখেছে। ২০২০ সালের সূচক বলছে, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক (৪৯.৪ শতাংশ) এখন গণতন্ত্র অথবা আংশিক গণতন্ত্র ভোগ করছে। এর মধ্যে পূর্ণ গণতন্ত্র উপভোগ করছে মাত্র ৪.৮ শতাংশ মানুষ।

নির্বাচনী ব্যবস্থা ও বহুদলীয় অবস্থান, সরকারে সক্রিয়তা, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নাগরিক অধিকার এ পাঁচ মানদণ্ডে একটি দেশের পরিস্থিতি বিবেচনা করে ১০ ভিত্তিক এই সূচক তৈরি করে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। সব সূচক মিলিয়ে কোনো দেশের গড় স্কোর ৮-এর বেশি হলে সে দেশে ‘পূর্ণ গণতন্ত্র’ রয়েছে বলে বিবেচনা করা হয় প্রতিবেদনে। স্কোর ৬ থেকে ৮-এর মধ্যে হলে সেখানে ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র’, ৪ থেকে ৬-এর মধ্যে হলে ‘মিশ্র শাসন’ এবং ৪-এর নিচে হলে সে দেশে ‘স্বৈরশাসন’ চলছে বলে ধরা হয়।

৯.৮১ স্কোর নিয়ে সেবারের তালিকার শীর্ষে ছিল নরওয়ে। শীর্ষ দশে আরো ছিলো আইসল্যান্ড, সুইডেন, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, আয়ারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও নেদারল্যান্ডস। যুক্তরাষ্ট্র স্থান পেয়েছিলো আগের বারের মতোই ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রের’ দেশের তালিকায়। তালিকার তলানিতে ছিলো উত্তর কোরিয়া। এ ছাড়া ডিআর কঙ্গো, সেন্ট্রাল আফ্রিকা, সিরিয়া, চাদ, তুর্কমেনিস্তানকেও নিচের দিকে রাখা হয়েছিলো।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে আমাদের দেশের গণতন্ত্রের সূচক কিঞ্চিৎ ওঠানামা করলেও আমরা যে এ বিষয়ে খাদের কিনারে ছিলাম তা নিশ্চিত করে বলা যায়। ‘বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। উদার গণতান্ত্রিক সূচক এবং নির্বাচনভিত্তিক গণতন্ত্রের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বল হচ্ছে’-তখন এমন কথাই জানিয়েছিলো সুইডেনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ভ্যারাইটিজ অব ডেমোক্রেসি (ভি-ডেম)। যা আমাদের গণতন্ত্রের দৈন্যদশার প্রতিই অঙ্গুলি নির্দেশ করে। (চলবে)