জাফর আহমাদ

আগামীকাল মানে আখিরাত। দুনিয়ার এ গোটা জীবনকাল হলো, ‘আজ’ এবং কিয়ামতের দিন হলো, আগামীকাল যা আগমন ঘটবে আজকের এ দিনটির পরে। অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ায় আনন্দ উপভোগ করার জন্য যে ব্যক্তি তার সবকিছু ব্যয় করে ফেলে এবং কাল তার কাছে ক্ষুধা নিবারণের জন্য খাদ্য ও মাথা গুঁজাবার ঠাই থাকবে কিনা সে কথা চিন্তা করে না সে ব্যক্তি এ পৃথিবীতে বড়ই নির্বোধ। ঠিক তেমনি ঐ ব্যক্তিও নিজের পায়ে কুঠারাঘাত করছে যে তার পার্থিব জীবন নির্মানের চিন্তায় এতই বিভোর যে আখিরাত সম্পর্কে একেবারেই গাফেল বা উদাসীন হয়ে গিয়েছে। অথচ আজকের দিনটির পরে কালকের দিনটি যেমন অবশ্যই আসবে তেমনি আখিরাতও আসবে। আর দুনিয়ার বর্তমান জীবনে যদি সে সেখানকার জন্য অগ্রীম কোন ব্যবস্থা না করে তাহলে সেখানে কিছুই পাবে না। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “হে ঈমানদাররা! আল্লাহকে ভয় করো। আর প্রত্যেককেই যেন লক্ষ্য রাখে সে আগামীকালের জন্য কী প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। আল্লাহকে ভয় করতে থাকো। আল্লাহ নিশ্চিতভাবেই তোমাদের সেই সব কাজ সম্পর্কে অবহিত যা তোমরা করে থাক।” (সুরা হাশর : ১৮)

আয়াতটিতে শুরু ও মধ্যেখানে দু’বার করে আল্লাহকে ভয় করার কথা বলা হয়েছে। এ ধরনের বাচনভঙ্গির দ্বারা অত্যন্ত বিজ্ঞোচিতভাবে মানুষকে বুঝিয়েছেন যে, ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার আরাম-আয়েশ করার জন্য যারা চিরস্থায়ী, অনন্ত অসীম সময়কালের পূঁজি সংগ্রহের কথা ভুলে যায় তারা মূলত আল্লাহর ব্যাপারে নির্ভিক। তারা আল্লাহকে ভয় করে না বিধায় দুনিয়াকে তাদের সকল কিছুর কেন্দ্রবিন্ধু বানিয়ে নেয়। আল্লাহকে ভয় করার অর্থ হলো, নিজের মধ্যে তাকওয়ার গুণ সৃষ্টি করা। যারা তাকওয়ার গুণে সমৃদ্ধ কেবল তারাই আজকের চেয়ে আগামীকালের গুরুত্ব বেফশ দেয়। তাকওয়া মানে নিজের মধ্যে ভালো-মন্দের পার্থক্যবোধ সৃষ্টি করা। নিজের মধ্যে এ গুণ সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত আদৌ সে অনুভব করতে পারবে না যে, সে যা কিছু করছে তা তার আখিরাতের জীবনকে সুন্দর ও সুসজ্জিত করছে না ধ্বংস করছে। তার মধ্যে এ অনুভূতি যখন সজাগ ও সচেতন হয়ে উঠে তখন তার নিজেকেই হিসেব-নিকেশ করে দেখতে হবে, সে তার সময়, সম্পদ, শ্রম, যোগ্যতা এবং প্রচেষ্টা যে পথে ব্যয় করছে তা তাকে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে না জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়টি বিবেচনা করা তার নিজের স্বার্থেই প্রয়োজন। অন্যথায় নিজের ভবিষ্যত সে নিজের হাতেই ধ্বংস করবে। এই বিষয়টিই পরের আয়াতে ব্যক্ত করা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন,“তোমরা তাদের মত হয়ো না যারা আল্লাহকে ভুলে যাওয়ার কারণে আল্লাহ তাদের নিজেদেরকেই ভুলিয়ে দিয়েছেন। তারাই ফাসেক।” (সুরা হাশর : ১৯)

আল্লাহকে ভুলে যাওয়ার অনিবার্য ফল হলো, নিজেকে ভুলে যাওয়া, সে কার বান্দা সে কথা যখন কেউ ভুলে যায়, তখন অনিবার্যরূপে সে দুনিয়ায় তার একটা ভুল অবস্থান ঠিক করে নেয়। এ মৌলিক ভ্রান্তির কারণে তার গোটা জীবনই ভ্রান্তিতে পর্যবসিত হয়। অনুরূপভাবে সে যখন একথা ভুলে যায় যে সে এক আল্লাহ ছাড়া আর কারো বান্দা নয় তখন আর সে শুধু এদের বন্দেগী করে না। এমতাবস্থায় সে প্রকৃতই যার বান্দা তাকে বাদ দিয়ে যাদের সে বান্দা নয় এমন অনেকের বন্দেগী করতে থাকে। এটি আর একটি মারাত্মক ও সর্বাত্মক ভুল যা তার গোটা জীবনকেই ভুলে পরিণত করে। সে অসংখ্য রবের গোলামে পরিণত হয়। এবং সকল রব তার দ্বারা সকল কাজ করিয়ে নেয়।

পৃথিবীতে মানুষের প্রকৃত মর্যাদা ও অবস্থান হলো সে আল্লাহর বান্দা বা দাস, স্বাধীন বা মুক্ত নয়। সে কেবল এক আল্লাহর বান্দা, তার ছাড়া আর কারো বান্দা সে নয়। একথাটি যে ব্যক্তি জানে না প্রকৃতপক্ষে সে নিজেই নিজেকে জানে না। আর যে ব্যক্তি এ কথাটি জেনেও এক মুহুর্তেও জন্য তা ভুলে যায় সে মুহুর্তে সে এমন কোন কাজ করে বসতে পারে যা কোন আল্লাদ্রোহী বা মুশরিক অর্থাৎ আত্মবিস্মৃত মানুষই করতে পারে। সঠিক পথের ওপর টিকে থাকা পুরোপুরি নির্ভর করে আল্লাহকে স্মরণ করার ওপর। আল্লাহ তা’আলা সম্পর্কে গাফেল হওয়া মাত্রই সে নিজের সম্পর্কেও গাফেল হয়ে যায় আর এই গাফলতিই তাকে ফাসেক বানিয়ে দেয়।

আল কুরআনের দৃষ্টিতে দুনিয়ার জীবন সামগ্রী দু’প্রকারের। এক প্রকারের জীবন সামগ্রী আল্লাহ বিমুখ লোকদেরকে ফিতনার মধ্যে নিক্ষেপ করার জন্য দেয়া হয়ে থাকে। এর মাধ্যমে প্রতারিত হয়ে তারা নিজেদেরকে দুনিয়া পূজা ও আল্লাহ বিস্মৃতির মধ্যে আরো বেশি করে হারিয়ে যায়। আপাতদৃষ্টিতে এটি নিয়ামত ঠিকই কিন্তু গভীরভাবে নিরীক্ষণ করলে দেখা যাবে এটি আল্লাহর লানত ও আযাবের পটভূমিই রচনা করে। এই সম্পদের লোভে দুনিয়াতে এক প্রকার ফাসাদ সে ছড়িয়ে দেয়। সম্পদ রক্ষা বা আরো সম্পদ আহরণের জন্য সে হেন হীনতর কাজ নেই যা সে করে না। সম্পদের মোহে সে এতটাই অন্ধ হয়ে পড়ে যে, তার সম্পদ লাভের প্রক্রিয়ার কারণে কত মানুষ দুর্ভোগের শিকার হলো, সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্র বিপর্যয় সৃষ্টি হলো, তাতে তার কোন ভ্রুক্ষেপই নেই। হালাল-হারামকে একাকার করে সম্পদ আহরণের ফলে সমাজে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

দ্বিতীয় প্রকারের জীবন সামগ্রী মানুষকে আরো বেশি সচ্ছল, সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করে তাকে তার আল্লাহ আরো বেশি কৃতজ্ঞ বান্দায় পরিণত করেন। এভাবে সে আল্লাহর, তাঁর বান্দাদের এবং নিজের অধিকার আরো বেশি করে আদায় করতে সক্ষম হয়। আল্লাহর দেওয়া উপকরণাদির সাহায্যে শক্তি সঞ্চয় করে সে দুনিয়ায় ভালো, ন্যায় ও কল্যাণের উন্নয়ন এবং মন্দ, বিপর্যয় ও অকল্যাণের পথ রোধ করার জন্য এর বেশি প্রভাবশালী ও কার্যকর প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। এ হচ্ছে কুরআনের ভাষায় উত্তম জীবন সামগ্রী। অর্থাৎ এমন উন্নত পর্যায়ের জীবন সামগ্রী যা নিছক দুনিয়ার আয়েশ আরামের মধ্যেই খতম হয়ে যায় না বরং পরিণামে আখেরাতেরও শান্তির উপকরণে পরিণত হয়। এ সমস্ত উত্তম জীবন সামগ্রীর দ্বারা সে আগামীকালের বা আখিরাতের ঘর তৈয়ার করে নেয়।

যে ব্যক্তি আগামীকালের কথা চিন্তা করে কাজ করে সে ব্যক্তি চরিত্রগুণে ও নেক আমলের দ্বারা অনেক দুর এগিয়ে যায়। আর আল্লাহ তাকে আরো বেশি ও বড় মর্যাদা দান করেন। আল্লাহর দরবারে তাদের কৃতিত্ব ও সৎকাজকে নষ্ট করা হয় না। তাঁর কাছে যেমন অসৎকাজ ও অসৎবৃত্তির কোন মর্যাদা নেই তেমনি সৎকাজ ও সৎবৃত্তির কোন অমর্যাদা হয় না। যে ব্যক্তি নিজের চরিত্র ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নিজেকে যেরূপ মর্যাদার অধিকারী প্রমাণ করবে তাকে আল্লাহর সে মর্যাদা অবশ্যই দেবেন। আখিরাতে কারো প্রতি জুলুম করা হবে না। যার যা প্রাপ্য তা তাকে যথাযথ বুঝিয়ে দেয়া হবে। যে অন্যায় করেছে সে তার অন্যায়ের প্রতিফল যথাযথভাবে পাবে। ভালো-মন্দ-এর পাওনা থেকে কাউকে বঞ্চিত করা হবে না।

আল্লাহ তা’আলা বলেন,“তোমরা তোমাদের রবের কাছে চাও এবং তাঁর দিকে ফিরে এসো, তাহলে তিনি একটি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তোমাদের উত্তম জীবন সামগ্রী দেবেন এবং অনুগ্রহ লাভের যোগ্য প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার অনুগ্রহ দান করবেন। তবে যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে আমি তোমাদের ব্যাপারে একটি অতীব ভয়াবহ দিনে আযাবের ভয় করছি।” (সুরা হুদ : ৩) অর্থাৎ যারা ইস্তেগফার করে আল্লাহর দিকে ফিরে আসবে দুনিয়ায় তাদের অবস্থান করার জন্য যে সময় নির্ধারিত রয়েছে সেই সময় পর্যন্ত আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে খারাপ নয় বরং ভালোভাবেই রাখবেন। তাঁর নিয়ামতসমূহ তাদের ওপর বর্ষিত হবে। তাঁর বরকত ও প্রাচুর্যলাভে তারা ধন্য হবে। তারা সচ্ছল ও সুখী-সমৃদ্ধ থাকবে। তাদের জীবন শান্তিময় ও নিরাপদ হবে। তারা লাঞ্ছনা, হীনতা ও দীনতার সাথে নয় বরং সম্মান ও মর্যাদার সাথে জীবন যাপন করবে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন,“ঈমান সহকারে সৎকাজ করবে, সে পুরুষ হোক বা নারী আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করবো।” (সুরা নাহল : ৯৭)

যারা আগামীকালের সঞ্চয়ে ব্যস্ত থাকেন তারা দুনিয়ার ধন-দৌলতের প্রতি তেমন একটা ভ্রুক্ষেপ করেন না। এ ধরনের ব্যক্তিদের আল্লাহ ভালবাসেন। আর আল্লাহ যাদেরকে ভালবাসেন তাদের বৈশিষ্ট্য হলো, তারা দুনিয়ার মোহে বিভোর হয় না। পদ-পদবী, বিত্ত-বৈভব, প্রভাব-প্রতিপত্তির প্রতি তারা লোভাতুর হয় না। নিজেদেরক পুরোপুরি আল্লাহর কাছে সোপর্দ করে দেয়। আল্লাহই হন তাদের ভরসার মূল কেন্দ্রবিন্দু। তাই বলে তারা বৈরাগ্য জীবনযাপন করেন না; বরং বৈধভাবে যতটুকু সম্পদ হাতে আসে তাতেই সন্তুষ্ট থাকেন। অবৈধভাবে দুনিয়া উপার্জনের হাজার সুযোগ সুবিধাকে পায়ে ঠেলে দেন। মনের দিক থেকেও তারা ঐশ্বর্যশালী। আল্লাহর ভালবাসার জন্য দুনিয়ার সকল অভাব-অনটন ও দু:খ-কষ্টকে হাসিমুখে বরণ করে নেন। আল্লাহ তাঁর এ প্রিয় বান্দাদের জন্য দুনিয়াকে তিক্ত করে দেন এবং সকল অবৈধ কাজ থেকে তাদেরকে বিরত রাখেন।

যাদেরকে আল্লাহ ভালবাসেন তারা ভাল করেই জানে যে, পার্থিবজীবন আখিরাতকে ভুলিয়ে দেয়, তাই তারা সে দিকে পা বাড়ায় না। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “এ কথা সত্য, যারা আমার সাক্ষাতের আশা পোষণ করে না এবং পার্থিব জীবনেই পরিতৃপ্ত ও নিশ্চিন্তে থাকে আর আমার নিদর্শনসমূহ থেকে গাফেল, তাদের শেষ আবাস হবে জাহান্নাম এমন সব অসৎকাজের কর্মফল হিসেবে যেগুলো তারা ক্রমাগতভাবে আহরণ করতো।”(সুরা ইউনুস:৭-৮) অর্থাৎ যারা কখনো নিজেদের সারাজীবনের সমস্ত কাজের শেষে একদিন আল্লাহর কাছে তার হিসেব পেশ করার ভয় করে না, যারা এ ধারণার বশবর্তী হয়ে কাজ করে যায় যে, দুনিয়ার সমস্ত কাজ কারবার ও তার হিসেব-নিকাশ এ দুনিয়ার জীবনেই শেষ, যাদের দৃষ্টিতে দুনিয়ায় মানুষ যে পরিমাণ সমৃদ্ধি, সুখ, ঐশ্বর্য, খ্যাতি ও শক্তিমত্তা লাভ করতে সক্ষম হয়েছে শুধুমাত্র তারই ভিত্তিতে তার সাফল্য ও ব্যর্থতা বিচার্য এবং যারা নিজেদের বস্তুবাদী ধ্যান-ধারণার কারণে আল্লাহর আয়াতের প্রতি দৃষ্টি দেবার প্রয়োজন বোধ করে না, তাদের সারা জীবন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। আল্লাহ তা’আলা বলেন, (সে দিন দুনিয়াপূজারীরা বলবে) “আজ আমার অর্থ-সম্পদ কোন কাজে আসলো না। আমার সব ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বিনাশ প্রাপ্ত হয়েছে। (আদেশ দেয়া হবে) পাকড়াও করো ওকে আর ওর গলায় বেড়ি পরিয়ে দাও।” (সুরা হাক্বাহ : ২৮-৩০) এ জন্য আল্লাহ যাদেরকে ভালবাসেন, তাদের মধ্যে দুনিয়ার অর্থ-যশ,ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির লোভ সংবরণ করার ক্ষমতা দান করেন। নিজের প্রয়োজন পূরণের পর সে আর আগে বাড়ে না।

লেখক : ব্যাংকার।