ইকবাল হোসেন

বাংলার প্রবাদ-“চোর চুরি করে অভাবে নয়, স্বভাবে”-কেবল একটি কথার মোড়কে ঢেকে রাখা বাস্তবতার নিষ্ঠুর রূপ নয়, এটি আমাদের সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের এক নগ্ন চিত্র। আজ আমরা যখন প্রতিনিয়ত চারপাশে লুটপাট, দুর্নীতি, বিশ্বাসঘাতকতা আর অন্যায়ের বিস্তার দেখি, তখন এই প্রবাদ যেন আমাদের কানে কানে বলে-অভাব আসল সমস্যা নয়, মানুষের স্বভাবই সব কিছু ধ্বংসের মূল।

আমরা একটি আশ্চর্য সমাজে বাস করছি। যেখানে একজন গরিব রিকশাচালক হয়তো একশ টাকা রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পেয়ে মালিককে খুঁজে ফেরত দিতে ছুটে যান। আর অন্যদিকে কোটি কোটি টাকার মালিক, শিক্ষিত, পদ-পদবীধারী ব্যক্তিরাই রাষ্ট্রের সম্পদ আত্মসাৎ করেন-জনগণের হক মেরে ফেলেন নিঃসংকোচে। প্রশ্ন আসে, কেন? তারা কি অভাবে আছেন? মোটেই না। তাদের ঘরে অভাব নেই, খাদ্যের চিন্তা নেই, সন্তানদের বিদেশে পড়ানোর ব্যবস্থা আছে, বিলাসবহুল গাড়ি-বাড়ি সবই আছে। তাহলে? উত্তর একটাই-চুরি তাদের অভাব থেকে নয়, স্বভাব থেকে জন্ম নিয়েছে।

আমরা ভুলে গেছি, নৈতিকতা একটি আত্মিক শক্তি। আর এ শক্তির অভাবেই জন্ম নেয় একেকটি ‘সভ্য চোর’। সমাজের উচ্চশ্রেণির এ চোররা মুখে মুখে নীতি, আদর্শ, শুদ্ধতা নিয়ে কথা বলেন, আবার পর্দার আড়ালে লেনদেন করেন কোটি কোটি টাকার। তারা কর ফাঁকি দেন, ঘুষ নেন, সরকারি প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ করেন, জনসেবার দায়িত্বে থেকেও জনবিরোধী কাজ করেন-আর এসব করতে গিয়ে তারা একটিবারও থেমে ভাবেন না, “আমি কি চোর হয়ে যাচ্ছি?”

ইসলামী মূল্যবোধ ও বাস্তবতা : ইসলাম চুরি ও দুর্নীতিকে শুধু আইনত অপরাধ হিসেবেই দেখেনি, একে আখ্যা দিয়েছে আত্মার পাপ হিসেবে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, “ফাতিমা (রা.) যদি চুরি করতেন, তবে আমি তার হাত কেটে দিতাম।” (সহীহ বুখারী)

এ বক্তব্যের মূল শিক্ষা হলো-চুরি কোনো শ্রেণি দেখে না, বরং বিবেকহীন মানুষকে গ্রাস করে। অথচ আজকের বাস্তবতায় আমরা দেখি, চুরি করলে বিচার হয় গরিবের, আর ধনী-ক্ষমতাবানরা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এর ফলেই সমাজে চুরি, দুর্নীতি ও অন্যায় বেড়ে যায় ভয়াবহভাবে।

শিক্ষা কি চরিত্র গড়ছে? : একটা সময় ছিল, যখন মানুষ বলত-“পড়াশোনা করো, বড় মানুষ হও।” আজকের সমাজে দেখা যাচ্ছে, উচ্চ শিক্ষিত অনেক মানুষও দুর্নীতিতে জড়িত। তাই প্রশ্ন আসে-শিক্ষা কি সত্যিই মানুষকে মানুষ করছে? নাকি কেবল দক্ষ চোর তৈরি করছে? যে শিক্ষা মানুষের চরিত্র গঠন করে না, তাকে কীভাবে প্রকৃত শিক্ষা বলা যায়?

একজন মানুষ প্রকৃত শিক্ষিত তখনই, যখন সে অন্যায়কে ‘না’ বলতে শেখে, যখন সে সততা ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ায়। অথচ আজ শিক্ষিত সমাজের একটি অংশ নীরব, সুযোগসন্ধানী এবং স্বার্থপর। তারা অনেকেই নিজের সুবিধার জন্য সত্যকে বিকিয়ে দেন। তারা হয়তো চুরি করেন না প্রকাশ্যে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তারা চুরিকেই প্রশ্রয় দেন।

সমাজের করুণ প্রতিচ্ছবি : আজকে আমরা এমন একটি বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে গরিব মানুষ না খেয়ে থাকে, অথচ কিছু মানুষ বিদেশে টাকা পাচার করে বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন। সমাজের একপাশে শিশু শিক্ষার অভাবে ঝরে পড়ে, অন্যপাশে শিশুদের জন্য বিদেশি স্কুল আর দামি খেলনা। একপাশে হাসপাতালে ওষুধ নেই, অন্যদিকে সরকারি টাকায় বিদেশে চিকিৎসা নিচ্ছে কিছু মানুষ। এসব বৈষম্য কি কোনো অভাব থেকে তৈরি হচ্ছে? না, এটি এসেছে স্বভাবের বিকৃতি থেকে।

করণীয় ও আশার আলো : এসব অপরাধীরা সমাজের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে পড়েছে-রাজনীতি, ব্যবসা, প্রশাসন, শিক্ষা, এমনকি ধর্মীয় অঙ্গনেও। আমাদের এখন সবচেয়ে জরুরি প্রয়োজন-স্বভাব বদলের সংগ্রাম। এ সংগ্রাম শুরু করতে হবে পরিবার থেকে, যেখানে সন্তানকে ছোটবেলা থেকে বোঝানো হবে-সততা হলো সাহস, চুরি হলো কাপুরুষতা। স্কুলে পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি পাঠ দিতে হবে চরিত্র গঠনের, আল্লাহভীতির। সমাজকে ফিরিয়ে আনতে হবে সে আলোতে, যেখানে একজন মানুষ অন্যের হক নেয়ার আগে একটিবার হলেও নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করে-“আল্লাহ কি আমাকে দেখছেন না?”

চুরি বা দুর্নীতি কখনোই টাকার অভাব থেকে হয় না। যারা সত্যিকার অভাবে থাকে, তারা জানে রুজি অর্জনের কষ্ট। কিন্তু যারা চুরি করে, তারা ‘অভাব’ নয়, বরং ‘আত্মার অভাব’ নিয়ে বেড়ে ওঠে। তাই আজ প্রয়োজন সুশিক্ষা, ইসলামী আদর্শ, জবাবদিহিতামূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং বিবেকবান নাগরিক। নইলে সমাজের গভীরে গেঁথে যাওয়া এ ‘স্বভাবের চোরেরা’ ধীরে ধীরে আমাদের মূল্যবোধ, আমাদের রাষ্ট্র, এমনকি আমাদের ভবিষ্যতকেও চুরি করে নিয়ে যাবে।

লেখক : সংবাদকর্মী।