ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
রমযান-বছরের সবচেয়ে পবিত্র ও ফজিলতপূর্ণ মাস। রমযানের শেষ ১০ দিনকে বলা হয় “নাজাতের দশক” বা “মুক্তির দশক”। এসময় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাঁর বান্দাদের মুক্তি প্রদান করেন, গুনাহ ক্ষমা করেন এবং লাইলাতুল কদরের মতো বরকতময় রাত প্রদান করেন, যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।
রমযানে শেষ দশ দিনের আমল
১. ইবাদত বৃদ্ধি ও ইতিকাফ করা : রমযানের শেষ দশ দিন আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের সর্বোত্তম সময়। এ সময় আমাদের উচিত ইবাদত বৃদ্ধি করা এবং ইতিকাফের মাধ্যমে নিজেকে আল্লাহর ইবাদতে সম্পূর্ণভাবে নিয়োজিত করা। ইতিকাফ হলো এমন একটি আমল যেখানে একজন মুসলিম মসজিদে অবস্থান করে ইবাদত-বন্দেগিতে মগ্ন থাকেন, পার্থিব কাজকর্ম থেকে নিজেকে দূরে রেখে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে সময় কাটান।
২. লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান ও ইবাদত করা : রমযানের শেষ দশ দিনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান করা। আল্লাহ তাআলা কুরআনে লাইলাতুল কদরকে হাজার মাসের চেয়ে উত্তম বলে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ, এ এক রাতের ইবাদতের সওয়াব প্রায় ৮৩ বছরের ইবাদতের সমান। এটি এমন একটি বরকতময় রাত, যখন ফেরেশতারা পৃথিবীতে অবতরণ করেন এবং রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের দরজা উন্মুক্ত থাকে।
৩. তাহাজ্জুদ নামায পড়া : রমযানের শেষ দশ দিনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো তাহাজ্জুদ নামায। এটি এক বিশেষ নফল নামায, যা রাতের শেষ অংশে পড়া হয় এবং আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাত লাভের অন্যতম মাধ্যম। তাহাজ্জুদ নামায সম্পর্কে কুরআন ও হাদিসে অসংখ্য ফজিলতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেছেন, “তারা রাতের শেষ প্রহরে ক্ষমা প্রার্থনা করে” (সূরা আয-যারিয়াত: ১৮। এই নামায আল্লাহর নৈকট্য লাভের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম এবং বিশেষ করে রমযানের শেষ দশ দিনে এই নামাযের গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পায়, কারণ এই সময়েই লাইলাতুল কদর পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
৪. বেশি বেশি ইস্তিগফার ও তওবা করা : রমযানের শেষ দশ দিন ক্ষমা লাভের শ্রেষ্ঠ সময়। এ সময় আল্লাহর দরবারে বেশি বেশি ইস্তিগফার ও তওবা করা উচিত, কারণ এ সময় আল্লাহ তাঁর বান্দাদের গুনাহ মাফ করেন। কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, “তোমাদের প্রতিপালকের ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন কর” (সূরা হূদ: ৩)। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেও দিনে শতবার ইস্তিগফার করতেন এবং তাঁর উম্মতকেও এটি বেশি বেশি করতে বলেছেন।
ইস্তিগফার হলো আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া, আর তওবা হলো নিজের ভুলগুলো বুঝতে পেরে ভবিষ্যতে সেগুলো না করার প্রতিজ্ঞা করা। তওবার কয়েকটি ধাপ রয়েছে:
১. নিজের গুনাহ স্বীকার করা-বোঝা যে আমরা ভুল করেছি এবং আল্লাহর কাছে তা স্বীকার করা।
২. আল্লাহর কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাওয়া-শুধুমাত্র মুখে নয়, বরং হৃদয় থেকে অনুশোচনা করা।
৩. পুনরায় সেই গুনাহ না করার সংকল্প করা-গুনাহ থেকে দূরে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৪. পূর্ববর্তী গুনাহ সংশোধনের চেষ্টা করা-যদি কারও হক নষ্ট করা হয়, তাহলে তা ফিরিয়ে দেওয়া বা সংশোধন করা।
রমযানের এ বরকতময় দিনগুলোতে আমাদের উচিত বেশি বেশি ইস্তিগফার করা, বিশেষত রাতের শেষ ভাগে আল্লাহর কাছে কাঁদতে কাঁদতে ক্ষমা চাওয়া, কারণ এ সময় আল্লাহ তাঁর বান্দাদের সবচেয়ে বেশি ক্ষমা করেন।
৫. কুরআন তিলাওয়াত বৃদ্ধি করা : রমযান হলো কুরআন নাজিলের মাস, তাই এ মাসে কুরআন তিলাওয়াতের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। আল্লাহ তাআলা বলেন, “রমযান মাস, যে মাসে কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে, যা মানুষের জন্য পথনির্দেশ” (সূরা আল-বাকারা: ১৮৫)। রাসুলুল্লাহ (সা.) এই মাসে জিবরাইল (আ.)-এর সঙ্গে পুরো কুরআন তিলাওয়াত করতেন এবং সাহাবারা রমযানে প্রচুর কুরআন পড়ার অভ্যাস করতেন।
কুরআন পড়ার পাশাপাশি তার অর্থ বোঝার চেষ্টাও করা উচিত। অনেক সময় আমরা শুধু তিলাওয়াত করি, কিন্তু তার মর্মার্থ জানি না। অথচ কুরআনের শিক্ষাগুলো আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করা গুরুত্বপূর্ণ। কুরআন অধ্যয়ন করলে আমরা জানতে পারব কীভাবে একজন ভালো মুসলিম হিসেবে জীবন যাপন করা যায়, কীভাবে গুনাহ থেকে বাঁচা যায়, এবং কীভাবে জান্নাতের পথ সুগম করা যায়।
৬. দান-সদকা করা : রমযানের শেষ দশ দিন শুধু ইবাদতের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এটি দান-সদকারও শ্রেষ্ঠ সময়। এ মাসেই আমাদের উচিত গরিব-দুঃখী, অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের সাহায্য করা। কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, “যারা নিজেদের সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তাদের উদাহরণ একটি শস্যবীজের মতো, যা থেকে সাতটি শীষ জন্মে এবং প্রতিটি শীষে একশত করে দানা থাকে” (সূরা আল-বাকারা: ২৬১)। অর্থাৎ, এ মাসে একটি ছোট দানও বহুগুণ বৃদ্ধি হয়ে আমাদের আমলনামায় সওয়াব হিসেবে জমা হবে।
দান-সদকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো গরিব ও অসহায় মানুষদের সহায়তা করা। যাদের খাদ্য বা পোশাকের অভাব রয়েছে, তাদের পাশে দাঁড়ানো রমযানের অন্যতম বড় ফজিলতপূর্ণ কাজ। অনেক মানুষ সারা বছর অর্থকষ্টে ভোগে, তাই রমযান তাদের জন্য একটি আশার আলো নিয়ে আসে, যখন দানশীল ব্যক্তিরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।
৭. পরিবারের জন্য দোয়া করা : রমযানের শেষ দশ দিনে শুধু নিজের জন্য নয়, বরং পরিবারের সকল সদস্যের জন্য দোয়া করা উচিত। ইসলাম আমাদের শেখায় যে, আমরা শুধু নিজেদের জন্য চিন্তা করব না, বরং আমাদের পরিবার, আত্মীয়স্বজন, এবং পুরো মুসলিম উম্মাহর জন্যও দোয়া করব।
পিতা-মাতার জন্য দোয়া করা সন্তানের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, “তোমার প্রতিপালক আদেশ করেছেন যে, তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করবে না এবং পিতামাতার প্রতি সদয় ব্যবহার করবে” (সূরা বনী ইসরাইল: ২৩)। আমাদের উচিত আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা যেন তিনি আমাদের পিতা-মাতাকে ক্ষমা করেন, তাদের ভালো স্বাস্থ্য দান করেন এবং দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ দান করেন
এ ছাড়া, আমাদের আত্মীয়স্বজনের জন্যও দোয়া করা উচিত। অনেক সময় আত্মীয়দের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হয়, মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়। রমযান হলো সে সম্পর্কগুলো পুনরুদ্ধারের সময়। আল্লাহ আমাদের ক্ষমাশীল হতে বলেছেন, তাই আমাদের উচিত নিজেদের মনকে পরিশুদ্ধ করে সকলের জন্য মঙ্গল কামনা করা।
সবশেষে, পুরো মুসলিম উম্মাহর জন্য দোয়া করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আজকের সময়ে মুসলিম বিশ্ব নানা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমাদের উচিত আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা, যেন তিনি সমস্ত মুসলিমদের নিরাপত্তা, শান্তি ও সমৃদ্ধি দান করেন।
রমযানের শেষ দশ দিন নাজাতের শ্রেষ্ঠ সময়। এ দিনগুলোতে আল্লাহ বান্দাদের জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন এবং জান্নাতের পথ সুগম করেন। তাই আমাদের উচিত এই মূল্যবান সময়ের সর্বোত্তম ব্যবহার করা, বেশি বেশি ইবাদত করা, কুরআন পড়া, দান-সদকা করা এবং আত্মশুদ্ধির চেষ্টা করা।
এ দশ দিনে আমরা যদি মন থেকে আল্লাহর দিকে ফিরে যাই, তাহলে তিনি আমাদের গুনাহ মাফ করবেন এবং আমাদের জীবনে বরকত দান করবেন। তাই আসুন, আমরা এই শেষ দশ দিনকে যথাযথভাবে কাজে লাগাই এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের সর্বোচ্চ চেষ্টা করি।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে আমাদের প্রার্থনা, তিনি যেন আমাদের ক্ষমা করে নাজাত দান করেন, আমিন।
লেখক : কলাম লেখক।