মাহবুবউদ্দিন চৌধুরী
বাংলাদেশে ইউনেস্কো ক্লাবের জাতীয় সংগঠন ১৯৮৫ সাল থেকে ইউনেস্কোর একটি অলাভজনক অংশীদার সংস্থা হিসেবে কাজ করে আসছে। বাংলাদেশ জাতীয় ইউনেস্কো কমিশন (বিএনসিইউ), শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সরকারের তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠিত সংস্থাটি তৃণমূল পর্যায়ে ইউনেস্কোর দক্ষতার ক্ষেত্রে কাজ করার উদ্দেশ্যে জাতীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের সদস্য হয়ে উঠেছে।
ইউনেস্কো ক্লাব এবং সমিতিগুলির ফেডারেশন হল স্বেচ্ছাসেবক-ভিত্তিক সংস্থা যা স্থানীয়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইউনেস্কোর শান্তি, আন্তর্জাতিক বোঝাপড়া এবং টেকসই উন্নয়নের আদর্শ প্রচার করে। শিক্ষা, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি এবং যোগাযোগ সম্পর্কিত কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। ইউনেস্কোর আদর্শ প্রচারের কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে শিক্ষামূলক কর্মশালা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সম্প্রদায় পরিষেবা প্রকল্প এবং শিক্ষা, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি এবং যোগাযোগ সম্পর্কিত সচেতনতামূলক প্রচারণা। জাতীয় পর্যায়ে, ক্লাব ফর ইউনেস্কো নাগরিক সচেতনতাকে উৎসাহিত করে যা বিশেষ করে তরুণদের তাদের সামাজিক দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত করে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে আমরা বিশ্বজুড়ে ইউনেস্কোর ক্লাবগুলির মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ইউনেস্কো ক্লাবের কার্যক্রমকে শক্তিশালী করার জন্য দৃঢ়ভাবে কাজ করে আসছি। ইউনেস্কোর ক্লাবগুলির লক্ষ্য এখন টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, যা সে সময়ের বৈশ্বিক অগ্রাধিকার, তার চারপাশে কাজ করে।
আমরা লক্ষ্যমাত্রার দ্বারপ্রান্তে থাকায়, আমাদের আরও গতিশীল গতিতে এগিয়ে যেতে হবে। ইতিমধ্যে, আমরা অনেক মূল্যবান কিন্তু অপরিহার্য কর্মকাল হারিয়ে ফেলেছি কিন্তু বিশ্বব্যাপী সহানুভূতিশীল সম্পর্কের স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান পতন লক্ষ্য করেছি যা বিশ্ব শান্তির জন্য প্রয়োজনীয় ভিত্তির উপর বাধা তৈরি করেছে। বছরের পর বছর ধরে আমরা যে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পেয়েছি তার মধ্যে একটি হল অংশীদারিত্বের মূল্য। বিস্তৃত বৈশ্বিক দূষণ এবং উষ্ণায়নের অভিজ্ঞতায়, টেকসই স্থিতিস্থাপকতার প্রয়োজনীয়তা আবারও বিশ্বজুড়ে সর্বত্র অনুভূত হয়েছে। পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, আমাদের কর্মের স্থায়িত্বের উপর মনোনিবেশ করা দরকার এবং দেশগুলির মধ্যে সংহতি বাড়ানোর জন্য আঞ্চলিক ক্লাবগুলিকে এখন সেই অনুযায়ী পুনর্গঠিত করা উচিত। পরিবর্তিত চ্যালেঞ্জগুলির জন্য সদস্য ক্লাবগুলিকে পুনর্গঠন শুরু করেছে এবং ইউনেস্কো এবং জাতীয় কমিশনগুলিকে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
ইউনেস্কো হচ্ছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা (United Nations Educational Scientific and Cultural Organization)। প্রকারান্তরে যাকে বলা যায়, একটি আদর্শের নাম। আর এ জন্যই ১৯৪৫ সালের ১৬ নবেম্বর ইউনেস্কোর প্রতিষ্ঠা হলেও মূলত ১৯৪৬ সালের ৪ নবেম্বর থেকে ইউনেস্কোর কার্যক্রম পূর্ণাঙ্গভাবে শুরু হয় এবং এ যাবৎ ইউনেস্কো যা কিছু করে এসেছে এবং করছে, তা সবই হচ্ছে মানবজাতির মনে শান্তির আন্দোলনকে জোরদার করার অভীষ্ট প্রয়াস। ইউনেস্কো জাতিসংঘের বিশেষ ১৪টি সংস্থার মধ্যে অন্যতম। শুধু শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেই সীমায়িত নয়। গণমাধ্যম ও সমাজবিজ্ঞানের কর্মসূচিতেও পরিব্যাপ্ত।
ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের বিশ্ববিখ্যাত আইফেল টাওয়ারের সন্নিকটে অবস্থিত ইউনেস্কোর সদর দফতর অবস্থিত এবং মিস অদ্রি আজুলা সংস্থাটির বর্তমান মহাপরিচালক। ইউনেস্কো একটি আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংস্থা, শুধু সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলোই এর সদস্য হওয়ার যোগ্য। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই ১৯৭২ সালে ইউনেস্কোর সদস্যপদ লাভ করে। ইউনেস্কো সর্বাগ্রে যে বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল, তা হচ্ছে শিক্ষা। বর্তমানে ইউনেস্কোর দায়িত্বভার বহুগুণে বেড়ে গেছে। আজকের দিনে শিক্ষাকে অন্যতম মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে এবং লক্ষ্য হচ্ছে পৃথিবীর সর্বত্র প্রতিটি মানব সন্তানের জন্য শিক্ষা লাভ নিশ্চিত করা। গঠনতন্ত্র অনুসারে ইউনেস্কোর কর্তব্য হচ্ছে, ভাষা ও ছবির মাধ্যমে ভাবগত ধ্যান-ধারণার অবাধ বিনিময় নিশ্চিত করা। ইউনেস্কো তার সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে তাদের নিজ নিজ সংস্কৃতি নীতিগুলো প্রণয়নে সহায়তা এবং শিল্প, কৃষ্টি ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগের প্রসার ঘটিয়ে সংস্কৃতি অঙ্গনে ব্যক্তি অধিকারের শাশ্বত বিষয়টিকে বাস্তব করে তুলতে সাহায্য করে।
ইউনেস্কো সব দেশের নিজস্ব সংস্কৃতি সংরক্ষণের জন্য কাজ করে আসছে। ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কর্মতৎপরতার সবচেয়ে বেশি পরিচিতি যে জন্য সেটা হচ্ছে, সংস্কৃতি মুষ্টিমেয় কিছু লোকের সম্পত্তি নয়, সংস্কৃতি সবার-এই উপলব্ধিবোধ জাগ্রত করতে বিশ্বব্যাপী অবদান রাখার জন্য। ইউনেস্কো বিজ্ঞানের পূর্ণাঙ্গ বিকাশে আগ্রহী। বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় ইউনেস্কোর অবদান যথেষ্ট। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ-পরবর্তীকালে পুনর্গঠন ছিল ইউনেস্কোর গোড়ার দিকের প্রাথমিক দায়িত্ব।
ইউনেস্কোর সাহায্যের মাধ্যমে বাংলাদেশে পাহাড়পুর বৌদ্ধ পুরাকীর্তি ও বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ সংরক্ষণ এবং সংস্কারের কাজ করা হয়। এছাড়া পুরাকীর্তি সংরক্ষণে ইউনেস্কোর মাধ্যমে বাংলাদেশকে মূল্যবান সরঞ্জামাদি ও কারিগরি সাহায্য প্রদান করা হয়েছে। অ্যাসোসিয়েট স্কুল প্রোগ্রাম, প্রাথমিক শিক্ষা, বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ প্রকল্প, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রকল্প, গণযোগাযোগ ও বিভিন্ন সামাজিক কর্মসূচিতে ইউনেস্কোর উদার সাহায্য ও সহযোগিতায় বাংলাদেশ উপকৃত হচ্ছে। দেশের ঐতিহ্যমণ্ডিত ও গৌরবময় ইতিহাস এবং অতীত সংস্কৃতির বিকাশে এর সংরক্ষণে ইউনেস্কো বাংলাদেশকে এ যাবৎ যথেষ্ট সাহায্য ও অনুদান দিয়ে আসছে। ‘সুন্দরবন’কে এরই মধ্যে ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এছাড়াও ইউনেস্কো বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) এবং প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি) প্রতিষ্ঠার কাজে আর্থিক ও কারিগরি সাহায্য দিয়েছে। প্রতি দু’বছর অন্তর পার্টিসিপেশন প্রোগ্রামের আওতায় ইউনেস্কোতে বাংলাদেশ ইউনেস্কো জাতীয় কমিশনের (বিএনসিইউ) মাধ্যমে এনজিও এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য আর্থিক অনুদানের আবেদন করে থাকে। এ প্রকল্পগুলোতে ইউনেস্কো যথাক্রমে শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও যোগাযোগ এবং ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ, পরিবেশ, নারী, উন্নয়ন, মাদক ও এইচআইভি এইডস প্রতিরোধ, লাইব্রেরি উন্নয়নসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে অর্থ জোগান দিয়ে থাকে। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশে ইউনেস্কোর নিজস্ব অফিস খোলা হয়। ইউনেস্কো ঢাকা অফিস খোলার মাধ্যমে এর গুরুত্ব বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যদিও ইউনেস্কো কোনো অনুদান বা সাহায্যদাতা সংস্থা নয়, তবুও ফান্ড কোথায় পাওয়া যেতে পারে এর সঠিক তথ্য ইউনেস্কো সংগ্রহ করে দিয়ে থাকে। বাংলাদেশে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ ইউনেস্কো জাতীয় কমিশন (বিএনসিইউ) ইউনেস্কোর সরকারিভাবে সব ধরনের কার্যক্রম পরিচালিত করে থাকে।
শিক্ষামন্ত্রী বা শিক্ষা উপদেস্টা পদাধিকার বলে বিএনসিইউ’র চেয়ারম্যান আর শিক্ষা সচিব এর মহাসচিব এবং বিএনসিইউ’র নিজস্ব একজন ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল রয়েছেন। বাংলাদেশ ইউনেস্কোর কারিগরি ও আর্থিক সামগ্রিক সাহায্য প্রাপ্তির জন্য কাজ করে থাকে। এছাড়া বেসরকারি এনজিও প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশের ইউনেস্কোর কার্যক্রম দিন দিন বহুলাংশে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়াও ইউনেস্কো কুপনের মাধ্যমে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বই ও শিক্ষা সরঞ্জাম আমদানি করে থাকে। শিক্ষা বিষয়ে নতুন নতুন উদ্ভাবন, চিন্তা ও ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে গবেষণা, নিয়মিত আলোচনা ও সুপারিশ প্রণয়ন এবং সেগুলোর দুনিয়াব্যাপী প্রচার ও বিতরণের কাজ ইউনেস্কো সাধারণত করে থাকে। এছাড়াও অন্যান্য কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে, যুগ যুগ ধরে প্রচলিত ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ, বিভিন্ন ভাষায় শ্রেষ্ঠ সাহিত্য কীর্তি অনুবাদ এবং সৃজনশীল শিল্পীদের শিল্পকর্মের জন্য মর্যাদা ও স্বীকৃতি প্রদান করে থাকে। ইউনেস্কোর যে কোনো প্রকল্প কর্মসূচি ও কার্যক্রম সাধারণত বিএনসিইউ ও বিভিন্ন এনজিও বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে থাকে। ইউনেস্কোর উদ্দেশ্য ও আদর্শ নাগরিক সমাজ তথা যুব সমাজের কাছে তুলে ধরার লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় ইউনেস্কো ক্লাব অ্যাসোসিয়েশন তার কাজ করে আসছে।
বিশ্বশান্তি, মানবাধিকার সংরক্ষণ, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, গণশিক্ষা কার্যক্রম, মাদক ও এইচআইভি এইডস্ বিরোধী আন্দোলন, যোগাযোগ, বিনিময়, গ্রুপ ভ্রমণ, প্রদর্শনী ও প্রতিযোগিতা, কর্মশিবির, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান বিষয়ক সেমিনার, সিম্পোজিয়াম এবং ওয়ার্কশপ এবং জাতিসংঘ দিবসগুলো পালন ও এর কর্মসূচির প্রসার সাধন, মেধাবী অথচ গরিব ছাত্রছাত্রীদের মাঝে বৃত্তি প্রদান এবং সর্বোপরি আদর্শ নাগরিক সৃষ্টি করা ছাড়াও পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখা, বৃক্ষরোপণ, শিক্ষকদের মাঝে ‘সবার জন্য শিক্ষা’, গ্লোবাল মনিটরিং রিপোর্ট বিতরণ ও সেমিনার করে থাকে। এছাড়া ইউনেস্কো ক্লাব সাংবাদিকতা পুরস্কার ও ইউনেস্কো ক্লাব শিশু চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা প্রবর্তনের মাধ্যমে অনেক শিশুশিল্পী ও মিডিয়া কর্মীদের তাদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিভা বিকাশে সুযোগ সৃষ্টি করা হয়ে থাকে। ইউনেস্কো বই এবং প্রকাশনা প্রদর্শনী করা হয়। ইকোবানা বা ফুলের প্রদর্শনী এবং বাংলাদেশে ইউনেস্কো ঢাকা অফিস ও বাংলাদেশ ইউনেস্কো জাতীয় কমিশনের বিভিন্ন প্রোগ্রাম বাস্তবায়নে সহযোগিতা প্রদান ছাড়াও ইউনেস্কো ক্লাব প্যারিসে অবস্থিত ইউনেস্কোর সদর দফতরের সহযোগিতায় শিক্ষা-সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানবিষয়ক কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়ন করা হয়।
বর্তমানে শিক্ষা-সংস্কৃতি ক্ষেত্রে দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপ-জেলাতে বেশ কতকগুলো ইউনেস্কো ক্লাবের শাখা রয়েছে। ইউনেস্কো কর্মক্ষেত্রে যেমন অতল তেমনি মহৎ। ১৯৩ সদস্য রাষ্ট্রে এবং তার বাইরেও এই প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রায় এবং প্রায়ই আমরা তার মূল্যায়ন সঠিকভাবে করতে পারিনি। যে কোনো দেশের, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি চর্চায় ইউনেস্কো যে পরোক্ষ অথচ অমূল্য সহযোগিতা দিয়ে থাকে তার তুলনা নেই। বাংলাদেশে ইউনেস্কো ও ইউনেস্কো ক্লাবের কার্যক্রম দিন দিন আরো ব্যাপকভাবে প্রসারিত এবং প্রশংসিত হবে এটাই সকলের কাম্য।
লেখক : মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইউনেস্কো ক্লাব এ্যাসোসিয়েশন।