॥ অধ্যাপক লিয়াকত আখতার সিদ্দিকী ॥

মহান আল্লাহর অমোঘ বিধানে সৃষ্টিকুল এর আগমণ প্রস্থান। মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত এবং মরণশীল। কিন্তু তাদের মধ্যে কতিপয় ব্যক্তির প্রস্থান- দেশ, জাতি ও সমাজের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি বয়ে আনে। তাদের স্থান পূরণ হয় না। আমার ভাতিজা, সুহৃদ, সাহিত্য ও সাস্কৃতিক জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র ড. আ.জ.ম ওবায়েদুল্লাহ তাদেরই মধ্যে অন্যতম একজন। তিনি ১০ মে ২০২৫ শনিবার মধ্যে রাতে আমাদেরকে ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমান। তার আকস্মিক এ প্রস্থান আত্মীয়-স্বজন, সহযোদ্ধা, শুভাকাক্সক্ষী ও শুভানুধ্যায়ীদের জন্য বজ্রপাত তুল্য। তিনি ছিলেন শিক্ষাবিদ, সাহিত্য সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক, বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি, জামায়াতে ইসলামী চট্টগ্রাম মহানগরীর সিনিয়র নায়েবে আমীর। অন্যতম সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও লেখক।

ড.আ.জ.ম ওবায়েদল্লাহর পিতা আমাদের বড় ভাই মোজাম্মেল হক চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় স্টীল মিলের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ল্যাব কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন। ভোলার চরফ্যাশন পৌরসভার আদর্শ পাড়ার বাসিন্দা মোজাম্মেল হকের আট সন্তান সন্ততির বড় সন্তান ড.আ.জ.ম ওবায়েদল্লাহ। সে সুবাদে জীবনের শুরুতে সাত বছর বয়সে চলে আসেন চট্টগ্রামের পতেঙ্গায়। ভর্তি হয় কোতায়ালী থানাধীন চট্টগ্রাম সরকারি মুসলিম হাই স্কুলে। বাল্য জীবন, কৈশোর জীবন পার হয়ে বেড়ে হয়ে উঠেন চট্টগ্রামেই। চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগ হতে মাস্টার্স করেন। মেধার কারণে সুপরিচিত হন চট্টগাম বিশ^বিদ্যালয়ের স¦নাম ধন্য প্রফেসর ড.আনিসুজ্জামান স্যার এর সাথে। স্যার তাকে বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক পেশায় সম্পৃক্ত করার স্বপ্ন দেখতেন যা পূরণ হয়নি। আ.জ.ম ওবায়েদুল্লাহ ছাত্রজীবন হতে লেখাপড়ার সাথে সাংগঠনিক কাজে জড়িয়ে পড়েন। চট্টগ্রামে শিশু সংগঠন ঝিংঙ্গে ফুল, ফুল কুড়ি আসরের পরিচালক হন। ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের র্নিদেশে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যেতে হয়। অধ্যয়ন, শিক্ষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতির জগতে প্রচুর সময় দেয়া ছাড়া তাকে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্বও পালন করতে হয়। মৃত্যুকালে বৃদ্ধ পিতা-মাতা, স্ত্রী, দুই পুত্র ও তিন কন্যা রেখে যান। মোজাম্মেল হক সাহেব চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন ছিলেন। স্টীল মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর গোল্ডেন শেখ নিয়ে বর্তমান ভোলায় দেশের বাড়িতে আছেন। যার কারণে আ.জ.ম ওবায়েদুল্লাহ চট্টগ্রামে প্যারেড ময়দানে প্রথম জানাযার পর সুদূর ভোলায় দ্বিতীয় জানাযা শেষে গভীর রাতে পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয়।

আমি চট্টগ্রাম ইসলামী সমাজ কল্যাণ পরিষদের অফিস সেক্রেটারির দায়িত্বে থাকাকালে (১৯৭৯-১৯৮৮) পর্যন্ত মোজাম্মেল হক ভাই তার বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে লালদিঘির পুরানো গীর্জাস্থ পরিষদ অফিসে আসতেন। তিনি তফসিরুল কুরআন মাহফিলসহ বিভিন্ন কাজে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। সহজ সরল সাধা মাটা এ লোকটি সর্বদা হাসিমুখে কথাবার্তা বলতেন। পান খেতেন। সে সময়ে সংগঠনের ৬০-৭০ জন শপথের কর্মীদের মধ্যে তিনি ও সংযুক্ত ছিলেন। মোজাম্মেল হক ভাইয়ের সাথে মরহুম সামশুল হক, মাষ্টার আব্দুল মোতালেব, মোহাম্মদ নরুল হুদাসহ বেশ কয়েক জন সাংগঠনিক কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন তার পিতার সাথে আমার ভাইয়ের মত ঘনিষ্ঠতা থাকার কারণে আ.জ.ম ওবায়েদ আমাকে চাচা বলেই সম্মোধন করতেন। মৃত্যু পযর্ন্ত তার মায়াবী সম্মোধন অব্যাহত ছিল। এখনো কানে বাজে তার কন্ঠ “চাচা” অনে ক্যান আছন। চাচী ভাই-বোনদের খবর কী? ২০১৮ সালে অসুস্থ হওয়ার পর দেখা সাক্ষাৎ কম হতো। তার ব্যস্ততা ছিল বেশি। ছাত্রজীবন হতে শিক্ষা সাহিত্য ও সংস্কৃতিক অঙ্গনে তার অবদান প্রশংসনীয়। সাংস্কৃতিক জগতে লোক তৈরির কাজটা অনেকটা তাকেই করতে হয়। চট্টগ্রাম কি ঢাকা সর্বত্র। আবৃতিকার মোশতাক খন্দকার, চৌধুরী গোলাম মাওলা, মরহুম আহসান হাবিব (চকরিয়া) মনিরউদ্দিন, অধ্যাপক মুঈন উদ্দিন সবাই ছিল তার গড়া ব্যক্তিত্ব। মহানগরীর জামায়াতের শিক্ষা সাহিত্য ও সংস্কৃতির দায়িত্বশীল হিসেবে ফুলকুড়ি পাঞ্জেরীসহ বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তুলেন ড.আ.জ.ম ওবায়েদ। তিনি বিশ^বিদ্যালয় পড়া শেষ করে কমলওয়েলথ এক্সিকিউটিভ এম বি এ ডিগ্রি অর্জন করেন। ইন্টারন্যাশনাল সংস্থা ওয়ামীর বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। কর্মজীবনে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালীন রেজিষ্টার, স্টুডেন্টস এফেয়ারস বিভাগের ডিরেক্টর সর্বোশেষে বিশ^বিদ্যালয় ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ছিলেন। ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে তাদের লুটেরাদের হাতে বেশ হেনেস্থার শিকার হতে হয়। উল্লেখ্য যে, আইআইইউসি’র প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি মুরহুম বদিউল আলম মাওলানা মোহাম্মদ শামছুদ্দিন, মাওলানা আবু তাহের, ড. মোহাম্মদ লোকমান ও জনাব আ.ন.ম শামশুল ইসলাম এর পরামর্শক্রমে আ.জ.ম ওবায়েদুল্লাহকে জোর করে ঢাকা হতে নিয়ে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগদেন। ড. মোহাম্মদ লোকমান চবির বর্তমান রেজিষ্টার ড. এনায়েত উল্লাহ পাটোয়ারী ও ড.আ.জ.ম ওবায়েদ উল্লাহ চট্টগ্রাম ইসলামী বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অনেক ত্যাগ স্বীকার করেন।

মোটিভিশনাল স্পিকার হিসেবে বিবেচিত ড. আ.জ.ম ওবায়েদুল্লাহ ঢাকায় মাসিক অঙ্গীকার ডাইজেস্টের সম্পাদক ও হুইল বিজনেস ম্যাগাজিন ও কিশোর কন্ঠের প্রধান সম্পাদক ছিলেন। এসব দায়িত্বের কারণে শিক্ষা সাহিত্য ও সংস্কৃতির অঙ্গনে তার অবস্থান গিয়ে পৌঁছে প্রতিভার আধার” শেকড় থেকে শিখরে উপনীত হওয়ার মত। দেশ রতœ কবি আল মাহমুদ, সৈয়দ আলী আহসান, আব্দুল মন্নান সৈয়দ, ফারুক মাহমুদসহ দেশখ্যাত কবি সাহিত্যিকদের সাহচর্যে এবং তাদের ভালোবাসা আ.জ.ম ওবায়েদুল্লাহর জন্য ছিল বড় পাওয়া। অধ্যক্ষ ইব্রাহীম খাঁ (দক্ষিণ হাওয়া, হুমায়ুন আহমেদ, নার্গিস স্মৃতি বিজড়িত) এর বাণী” অনিন্দ সুন্দর গোলাপ পুষ্প ঘন পত্রান্তরালে বিকেশিত হলেও তার শুভ্র সুগন্ধ যেমন মানব জীবনে লুকায়িত থাকে না তেমনি দেশ রতœ কবি সাহিত্যিকদের সংস্পর্শ ও সাহচর্যে আ.জ.ম ওবায়েদুল্লাহ সংস্কৃতির জগতের ধ্রুবতারায় পরিণত হয়।

ভোলার চর ফ্যাশনে জন্মগ্রহণ, চট্টগ্রাম বেড়ে ওঠা ও ঢাকায় বিকিশিত হওয়া ড.ওবায়েদুল্লাহ সাংস্কৃতিক অঙ্গনের এক নক্ষত্র বৈ আর কিছুই নয়। তার লেখা বইয়ের মধ্যে তরুণ তোমার জন্য ও স্বপ্নের সাহসী ঠিকানা বেশ জনপ্রিয়। চট্টগ্রামে ইসলামী আন্দোলনের সাহিত্য ও শিক্ষা ও সংস্কৃতির দায়িত্বশীল আ.জ.ম ওবায়েদুল্লাহ সাংগঠনিক ও পেশাগত জীবনে বহু ব্যস্ততার মাঝে ও ইসলামী সমাজ কল্যাণ পরিষদের তফসিরুল কুরআন মাহফিল স্মারক মঞ্জিল সম্পাদনা, মরহুম মাওলানা সামছুদ্দিন (রহঃ) স্মারক এবং কেন্দধীয় সংগঠনের তত্ত্ববধানে প্রকাশিত এসিট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যক্ষ মাওলানা আবু তাহের স্মৃতিতে অমলিন স্মারক গ্রন্থের সম্পাদক ছিলেন। মরহুম আ.জ.ম ওবায়েদুল্লাহ সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ইকামতে দ্বীনের আন্দোলন এগিয়ে নেয়ার কাজে নিরলস পরিশ্রম করেন তার পরপারে পাড়িদান এ অঙ্গনে এক অপুরণীয় ক্ষতি। আ.জ.ম ওবায়েদুল্লাহ কর্ম ও আচরণ, ইসলামীর সংস্কৃতির বিকাশে, ইসলামী ছাত্রশিবির ও জামায়াত ইসলামীর জন্য তার ত্যাগ ও কুরবানি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে নেত্রীবৃন্দ ঘনিষ্ঠ জন ও বন্ধু বান্ধবগণ অভিমত ব্যক্ত করেন।

আমীরে জামায়াত ডা: শফিকুর রহমান বলেন, প্রিয় ভাই ড. আ.জ.ম ওবায়েদুল্লাহ মহান রবের ডাকে সাড়া দিয়ে অনন্তকালের পথে যাত্রা শুরু করেছেন সংস্কৃতিক অঙ্গনে ও ইসলামী ধারার নেতৃত্ব ছিল তারই হাতে। আল্লাহ তায়ালা এই হাতের পরিবর্তে আমাদের কে আরও উত্তম হাত দিয়ে সাহয্য করুন। তাকে জান্নাতের আলা মাকামে স্থান দিন তার জীবনে সকল নেক খেদমত কবুল করুন। ভুলত্রুটিগুলো ক্ষমা করে দিন।

এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনেরেল মাওলানা মেহাম্মদ শাহজাহান বলেন, জামায়াত বহুমূখী প্রতিভার অধিকারী এক মেধাবী নেতাকে হারালো। এই শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। চট্টগ্রাম মহানগরী আমীর সাবেক এমপি শাহজাহান চৌধরী বলেন, নায়বে আমীর ড.আ.জ.ম ওবায়েদুল্লাহর ইন্তিকালে আমরা একজন নিবেদিত প্রাণ ভাই কে হারালাম। ইসলামী আন্দোলনের প্রচার প্রসারে তার অনেক অবদান রয়েছে। সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিশু-কিশোরদের নৈতিক চরিত্র উন্নয়নে তিনি আমার ছায়ার মত ছিলেন।

আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ের চেয়ারম্যান শ্রমিক নেতা সাবেক এমপি মাওলানা শামশুল ইসলাম, ভিসি ড. মোহাম্মদ আলী আজাদী বলেন ড.আ.জ.ম ওবায়েদুল্লাহ (আইআইইউসি) ইসলামী বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বিশ^বিদ্যালয়ের একটি অবিচদ্য নাম। এই বিশ^বিদ্যালয়ের প্রভুত উন্নয়নে তার বুদ্ধিবৃত্তিক ও কায়িক অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দান ও নৈতিক মান উন্নয়নে তার মেধা ও শ্রমের কথা গভীর কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করছি।

ড. আ.জ.ম ওবায়েদুল্লাহর পাঁচ দশকের বন্ধু ও গাইড দৈনিক নয়া দিগন্তের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক জনাব মাসুমুর রহমান খলিলি তার ফেজবুক স্ট্যাটাসে বলেন আ.জ.ম ওবায়েদুল্লাহ প্রখর মেধা, স্মৃতি শক্তির অধিকারী ছিলেন। কবি আল মাহমুদের সাথে তার দিনগুলো এখন কেবলই স্মৃতি। আমি পরপারে তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।

চসিক মেয়র ডাঃ শাহাদাত বলেন আ.জ.ম ওবায়েদুল্লাহ সাহেবকে ছাত্রজীবন থেকে চিনতাম। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী দুঃশাসনের আমলে তাকে সভা বৈঠকে কাছে থেকে দেখেছি। তার মেধা মধুর ব্যবহার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আমাকে মোহিত করেছে।

ডা. আ.জ.ম ওবায়েদুল্লাহ আজ পরকালের বাসিন্দা। আমাকে চাচা বলে আর কেউ মমতাময়ী ডাক দেবে না। কিন্তু ইসলামী আন্দোলন ও আন্দোলনের জনশক্তিকে দ্বীনের পথে এগিয়ে নিতে তার নিরলস প্রচেষ্টা, শ্রম, মেধা, আমাদেরকে অনেক দিন ধরে অনুপ্রাণিত করবে। আল্লাহ তায়ালা তার পরিবার পরিজন সন্তান-সন্ততী ও বয়োবৃদ্ধ পিতা মাতার প্রতি সহায় হোন।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও ইসলামী চিন্তাবিদ।