কলাম
কিশোর-কিশোরীদের প্রয়োজন বংশবৃক্ষের ছায়া
ঈদের ছুটিতে কিশোর-কিশোরীরা যখন বাবা-মায়ের সাথে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যায়, তখন বংশবৃক্ষের একটা টান অনুভব করে।
Printed Edition
ঈদের ছুটিতে কিশোর-কিশোরীরা যখন বাবা-মায়ের সাথে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যায়, তখন বংশবৃক্ষের একটা টান অনুভব করে। দাদা-দাদি, চাচা-চাচি, ভাই-বোন ছাড়াও অনেক আপনজনের সাথে দেখা হয়ে যায় সে মিলনমেলায়। উঠানের চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা বড়ই, পেয়ারা ও নারকেল গাছগুলোও আত্মীয়তার হাতছানি দেয়। বিনে পয়সার এমন আপ্যায়ন শুধু ভালোবাসার মাত্রাই বাড়ায় না, অধিকারবোধের বার্তাও দেয়। চারপাশের বৃক্ষলতা ও পাখ-পাখালি যেন সুর তুলে বলে- ওগো, এতদিন কোথায় ছিলে তোমরা? কিশোর-কিশোরীরা ওদের ভাষা বোঝে। সহসাই মিশে যায় প্রকৃতির সাথে। ওরা সূর্যের লালিমার সাথে কথা বলে, দৌড়ে যায় সরষে ক্ষেতের মাঝখানে। ওদের সাথে তখন খেলা করে হরেক রঙের প্রজাপতি ও ফডিং। খেলতে খেলতে যখন ক্লান্ত হয়, তখন পুকুর পাড়ের ছায়াঘেরা পরিবেশ ডাক দেয় ওদের। কাছেই কদম-কেয়া, আম্রমুকুল, বৈচি-কুরচি-কাঞ্চন যত। হঠাৎ উড়ে গেল হট্টিটি পাখি। এমন পরিবেশে কেমন যেন চুপ হয়ে যায় অতিথি কিশোর-কিশোরীরা। ওদের মাথার ওপর সুনীল আকাশ, হঠাৎ কে যেন গান শোনায়-সে যে কৃষ্ণকোকিল।
কিশোর-কিশোরীরা শুধু প্রকৃতির সাথেই কথা বলে না, কথা বলে দাদা-দাদি ও গাঁয়ের আপনজনদের সাথেও। উপলব্ধি করে নতুন কিছু। আপন ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির স্পর্শে স্পন্দন জাগে হৃদয়ের গভীরে। জানতে চায় নিজের পরিচয়। আমরা আসলে কারা? নগর জীবন ও গ্রামীণ জীবনের মধ্যে এত পার্থক্য কেন? আমাদের বংশবৃক্ষের চূড়ায় অবস্থান করছেন দাদা-দাদিরা, আমাদের অবস্থান কোথায়? নগরে থাকার কারণে কী আমাদের মধ্যে Cultural Fusion ঘটে গেছে। সাংস্কৃতিক মিশ্রণের কারণেই কি আমাদের মধ্যে তারতম্য ঘটে গেছে? খাদ্য, পোশাক, রুচি, বিনোদন ও ধর্ম-কর্মে পার্থক্য ঘটে গেলে বংশবৃক্ষ টিকে থাকবে তো? জাতীয় ঐক্য অটুট থাকবে তো? সময়ের এসব প্রশ্নের জবাব প্রয়োজনÑকিশোর-কিশোরীদের জন্য, বড়দের জন্যও।
বংশবৃক্ষের টানে আমাদের কিশোর-কিশোরীরা কখনো কখনো গ্রামে গেলেও তাদের বসবাস তো শহরেই। শহরে ওরা কেমন আছে? কাক্সিক্ষত স্বাভাবিক জীবন কি সবাই পাচ্ছে? আপন ধর্ম-দর্শনের আলোকে বিকশিত হওয়ার পরিবেশ আছে কি? ডিজিটাল কালচার, ফেসবুক-টিকটক আমাদের কিশোর-কিশোরীদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা কেমন? ফেসবুক-টিকটকে প্রেমের যে ফাঁদ পাতা হয়, তাতে তো সর্বনাশ ঘটছে কিশোরীদের। এমন বাতাবরণ সম্পর্কে আমাদের অভিভাবকরা কতটা সচেতন? শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো কাক্সিক্ষত ভূমিকা পালনে কতটা সমর্থ? গণমাধ্যমের সম্পাদকীয় নীতিমালা কেমন? সরকার কি বিষয়টির গভীরতা উপলব্ধি করতে পারছে? আসলে কাক্সিক্ষত ভূমিকা পালনে আমরা প্রস্তুত নই। ঘটনা ঘটে গেলে আমরা দুঃখ প্রকাশ করি এবং আবেগমথিত কথা বলি। কিন্তু আমাদের থাকে না অব্যাহত যৌক্তিক কর্মসূচী। নৈতিক চেতনায় আমরা যে খুবই দুর্বল। ফলে আমাদের সমস্যার মাত্রা বেড়েই চলেছে। যাদের কিশোরী সন্তান আছে, এমন মা-বাবারা এখন আতঙ্কের এক পরিবেশে বসবাস করছেন। রাজধানী ঢাকায় সংঘটিত পরপর দু’টি ঘটনা তাদের আতঙ্কের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সাম্প্রতিক দু’টি ঘটনার একটি হলোÑনিখোঁজের ১৭ দিন পর ২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর হাতিরঝিল থেকে ১৩ বছর বয়সী এক কিশোরীর লাশ উদ্ধার। অপরটি হলো, রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে ১১ বছর বয়সী এক কিশোরীর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা। অনেক অভিভাবক আতঙ্কিত হয়েছিলেন এ ভেবে যে, দ্বিতীয় কিশোরীও প্রথম কিশোরীর মত ভয়াবহ পরিণতির শিকার হলো কিনা। তবে সৌভাগ্যক্রমে দ্বিতীয় কিশোরী জীবিত অবস্থায় উদ্ধার হয়েছে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, উদ্ধারের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মেয়েটিও তার পরিবারের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক মন্তব্য ছুঁড়ে দিয়েছেন অনেকে। এভাবেই নাগরিকরা তাদের সামাজিক দায়িত্ব পালন করলেন। বিষয়টি কি সঙ্গত হয়েছে? আসলে এতে প্রমাণিত হলো, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে আমরা এখনো সমর্থ হইনি।
শিশু অধিকার নিয়ে কর্মরত ব্যক্তিরা বলছেন; ফেসবুক, টিকটক, ইনস্টাগ্রাম, ইমোর মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বার্তা আদান-প্রদানকারী অ্যাপের মাধ্যমে খুব সহজেই কিশোরীদের জন্য ‘প্রেমের ফাঁদ’ পাততে সমর্থ হচ্ছে অপরাধপ্রবণ ব্যক্তিরা। বয়স কম থাকায় আবেগপ্রবণ কিশোরীরা আসন্ন বিপদ সম্পর্কে অবগত নয়। ফলে তারা সহজেই ওইসব ফাঁদে পা দেয়। বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক। ওই দুই কিশোরীর সাথে কী হয়েছিল? কিশোরী ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় গ্রেফতার দুই ব্যক্তি বলেন; হাত-পা বেঁধে মুখে কাপড় গুঁজে পাঁচজন মিলে ধর্ষণ করলে কিশোরীর মৃত্যু হয়। গ্রেফতার দু’জনের একজন গাড়িচালক রবিন। সে জানায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে মেয়েটির সাথে পরিচয়।
সে পরিচয়সূত্রে কিশোরীকে মহাখালীর একটি বাসায় ডেকে নেয় সে। পরে ধর্ষণ এবং মৃত্যু। কিশোরীর লাশ বস্তাবন্দী করে একটি রিকশায় নিয়ে হাতিরঝিলে ফেলে দেয় তারা। এ কিশোরী ১৬ জানুয়ারি দোকানে যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল। অন্যদিকে মোহাম্মদপুর থেকে ১১ বছর বয়সী মেয়েটি তার থেকে ১১ বছরের বড় এক তরুণের সঙ্গে চলে যায় ঢাকার বাইরে। ক্যানসার আক্রান্ত মায়ের চিকিৎসার জন্য মেয়েটিসহ পরিবার এসেছিল ঢাকায়। পরিবার ছেড়ে চলে যাওয়া প্রসঙ্গে মেয়েটি বলেছে- বাসায় ভাল্লাগে না, তাই চলে গেছি। উপলব্ধি করা যায়, আমাদের পারিবারিক বন্ধন এখন কোন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। ‘পরিবার’ সম্পর্কে আমাদের সবার ধারণা কি এখন একরকম? নানা বিভ্রান্তি ও বিপর্যয় ঘটে গেছে। ভ্রষ্ট সভ্যতার অভিঘাত আমরা ঠেকাতে পারিনি। আপন ধর্ম-দর্শন ও সাংস্কৃতিক চেতনায় পুষ্ট হলে বাইরের অভিঘাত ঠেকানো যেত। বড়দের পতন ঘটেছে আগেই। মোবাইলে, টিভিতে তাঁরা কী দেখেন? আর তাদের পরকীয়ার ঘটনাতো ছোটদের চোখের সামনেই ঘটছে। অশ্লীলতা ও যৌনবিকৃতির প্রভাবতো অনিবার্য। তাই কিশোরীরা এখন কোনো একজনের হাত ধরে পঙ্কিল পথে পা বাড়াচ্ছে। বলছে, বাসায় ভাল্লাগে না। বাসায় ভালো লাগার মতো আসলেই কিছু নেই। না আছে নৈতিক পরিবেশ, না আছে ভালোবাসা ও দরদী বাতাবরণ। ষড়রিপুর চর্চা যেখানে সহজ হয়ে ওঠে, সেখানে পারিবারিক বন্ধন টিকে থাকবে কেমন করে?
শুধু কিশোরীরা নয়, কিশোররাও পা বাড়াচ্ছে ভুল পথে। ‘কিশোর গ্যাং’ যার এক পরিচায়। ফেসবুক-টিকটক এবং মাদকের এক অস্বাভাবিক ভুবনের বাসিন্দা তারা। লেখাপড়া, কাজকর্ম, পরিবার এখন আর তাদের প্রিয় বিষয় নয়। ক্লাব, আড্ডা, মাদক, যৌনতা এখন তাদের প্রিয় বিষয়। এ জগতে বসবাসের জন্য প্রয়োজন প্রচুর অর্থ ও পাওয়ার। এসবের জোগান দেয়ার লোকও আছে সমাজে। তাদের কেউ ব্যবসায়ী, কেউ রাজনীতিক, কেউ বা মাফিয়া। এরা কিশোরদের আপন স্বার্থে ব্যবহার করে। অপরিণামদর্শী ও আবেগপ্রবণ কিশোর-গ্যাংয়ের সদস্যরা ওদের কথায় মারে এবং মরে। এটা এক অস্বাভাবিক এবং অনাকাক্সিক্ষত সমাজচিত্র। এমন বাস্তবতায় বিশেষজ্ঞরা সুস্থ পারিবারিক পরিবেশের কথা বলছেন। বলছেন, নির্দিষ্ট বয়সের আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আরোপের কথা। অভিভাবকরা যেন সন্তানদের সময় দেন, নজরে রাখেনÑ এই বিষয়গুলোও তাঁরা তুলে ধরছেন।
সংকটের মাত্রা বাড়ার সাথে সাথে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের তালিকা হয়তো আরও বড় হবে। তবে আমরা আবারও বংশবৃক্ষের কথা বলবো। যে বংশবৃক্ষের ছায়াতলে বেড়ে উঠবে আমাদের কিশোর-কিশোরীরা। বংশবৃক্ষের সব সদস্যের হয়তো সবসময় এক সাথে থাকা হবে না। তবে বংশবৃক্ষের ধর্ম-দর্শন, ঐতিহ্য, মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক চেতনা বহতানদীর মত অব্যাহত থাকতে বাধা কোথায়? সমস্যাটা আসলে আমাদের বিশ্বাসে ও মননে। আমরা কি আসলেই মহান স্রষ্টাকে জানি এবং মানি? মহান স্রষ্টাতো মানব-বান্ধব করে এ প্রকৃতি ও পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু মানুষতো বর্তমান সভ্যতায় নিজেই নিজের বান্ধব হতে পারেনি। অন্যের বান্ধন হবে সে কেমন করে? কিশোর বয়সেই সে ক্ষতির পথে পা বাড়ায়, বিয়ের আগেই যৌনসম্পর্ক গড়ে তোলে, মাদকের উত্তেজক জগতে প্রবেশ করে। অথচ কিশোর-কিশোরীদের তো প্রকৃতির মত স্বচ্ছ ভুবনের নাগরিক হওয়ার কথা ছিল। ওদেরকে যারা বিভ্রান্ত করলো, তারা শুধু জাতির নয়, মানবতারও শত্রু। আর অভিভাবকরাও কি নিজেদের ভুলটা বোঝার চেষ্টা করবেন?