অ্যাডভোকেট সাবিকুন্নাহার মুন্নী
শিক্ষাঙ্গনে সৎ, যোগ্য ও একাডেমিশিয়ান প্রার্থীকে ভোট প্রদান করা শিক্ষার্থীদের ঈমানী দায়িত্ব। “যে লোক সৎ কাজের জন্য কোনো সাক্ষ্য দিবে, তা থেকে সেও একটি অংশ পাবে। আর যে লোক মন্দ কাজের জন্য সুপারিশ করবে, সে তার পাপের একটি অংশ পাবে।” [সূরা নিসা: ৮৫]
ভোটের বিষয়টি শুধুমাত্র পার্থিব নয়। পরকালীন জীবনেও আমাদের এ ব্যাপারে মহান আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। শিক্ষার্থীদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে, শিক্ষার মান ও পরিবেশ বজায় রাখতে আদর্শবান, সৎ, যোগ্য একাডেমিশিয়ান প্রার্থীর কাছে দায়িত্ব অর্পণ করার লক্ষ্যে ডাকসু নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করা প্রত্যেক ভোটারের নৈতিক দায়িত্ব। কোনো প্রতিষ্ঠানে ভালো, সৎ , যোগ্য ও নীতিবান লোককে প্রার্থী করা হলে তাকে যেমন ভোট না দিয়ে বিরত থাকা গুনাহর কাজ আবার অসৎ ও অযোগ্য প্রার্থীকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করাও ইসলামের দৃষ্টিতে মারাত্মক গুনাহ।
বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন নির্বাচিত প্রতিনিধি শুধু শিক্ষার্থী ভোটারদের সাথেই নয়, তার নিজস্ব অঙ্গন বিশ্ববিদ্যালয়সহ পুরো জাতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। জাতিগঠন ও মানুষ গড়ার প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ এ আঙ্গিনায় সৎ ও যোগ্য প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে না পারলে শিক্ষার পরিবেশ ব্যহত হবে। গোটা শিক্ষাঙ্গন আবারো অন্ধকারে ঢেকে যাবে। যেমনটা আমরা দেখেছি বিগত স্বৈরাচারের আমলগুলোতো। অসুস্থ রাজনীতি চর্চার চারণভূমিতে পরিণত হয়েছিল শিক্ষাঙ্গণগুলো। মানুষ গড়ার আঙ্গিনা থেকে অমানুষ হয়ে বের হওয়াটাই যেন স্বাভাবিক রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
৯০ এর দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখা মাত্রই চোখের সামনে যে দৃশ্যগুলো দেখেছি তা ভোলার নয়। এ পবিত্র অঙ্গনে দেখেছি অস্ত্রের ঝনঝনানি, রাজনৈতিক দলের তল্পিবাহক হয়ে ছাত্র সমাজকে প্রকাশ্যে অস্ত্রউঁচিয়ে চর দখলের মত হল দখলের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে। একদিন রেজিষ্টার বিল্ডিং চত্ত্বরে বাস ধরতে এসে বৃষ্টির মত গুলীর মুখে পড়ে সেদিন জীবন নিয়ে বাসায় ফিরতে পারবো কিনা উদ্বিগ্ন হয় পড়েছিলাম। চোখের সামনে জসীমউদ্দীন হল আর সূর্যসেন হলের পাল্টাপাল্টি গোলাগুলির মধ্যে ছাত্র নেতা অভি ও নিরুকে অস্ত্রহাতে দৌঁড়াতে দেখেছি। সেদিন চোখের সামনে জাতি প্রত্যক্ষ করেছে- গোলাম কিবরিয়া অভির মত বোর্ড স্টেন্ড করা একজন মেধাবী ছাত্রের ব্রাইট ফিউচারকে কিভাবে ধ্বংস করেছিল ক্ষমতাসীন স্বৈরাচার। ক্ষমতার মসনদকে দীর্ঘায়িত করতে ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্র অঙ্গনকে ধ্বংস করে দিতে কিভাবে স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের দোষররা সারা দেশে ছাত্রদের শিক্ষাজীবন ধ্বংস করে তাদের হাতে বইয়ের বদলে টাকা, নারী, মদ ও অস্ত্র তুলে দিয়েছিল। সেদিন একটি বিষয় এখনোও ভুলবো না, প্রাণভয়ে আমরা মেয়েরা যখন রেজিষ্টার বিল্ডিং এ আশ্রয় নিতে ঢুকেছিলাম, তখন অস্ত্রহাতে দৌড়ানো ছাত্ররা চিৎকার করে আশ্বাস দিচ্ছিল - “মেয়েদের ভয় নেই” বলে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে- ২৪ এসে সেই একই বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী ছাত্রীদের উপরই সর্বপ্রথম আঘাত এলো, রক্তাক্ত হতে হলো নিজের প্রিয় ক্যাম্পাসে। অর্থাৎ ৯০ এর দশকেও শি‣াঙ্গনে নারীদের প্রতি সম্মান মর্যাদা আর নৈতিকতার ন্যূনতম যে মান ছিল আজ ৩৪/৩৫ বছরে সে মান সম্পূর্ণ উবে গেছে। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, এমন পবিত্র শিক্ষাঙ্গনগুলোতেও মিষ্টি খেয়ে ধর্ষণের সেঞ্চুরী পালন করেছিল পতিত সরকারের আমলে তাদের পালিত ছাত্র নামের নরপিশাচেরা। আসন্ন ডাকসু নির্বাচনকে সামনে রেখে স্মৃতির জানালায় তুলনামূলক সেসময়ের দুঃসহ দিনের চিত্রগুলো আজ বার বার ঘুর-পাক খাচ্ছে। একাল-সেকালের সে ব্যবধান ঘুচিয়ে, প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার হারানো সুনাম সুখ্যাতি ফিরিয়ে এনে, মেধা ও নৈতিকতার সে সর্বোচ্চ আসনটি ধরে রাখতে পারবে তো।
মহান আল্লাহ বলেন-“নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন যে, যাবতীয় আমানত তার উপযুক্ত লোকদের নিকট অর্পণ করো।” (সূরা নিসা, আয়াত : ৫৮)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসু নির্বাচনে কোন জোট বা প্যানেল বিজয়ী হলে শিক্ষা বান্ধব, শিক্ষার্থী বান্ধব নিরাপদ পরিবেশ ফিরে পাবে ও একটি সুষ্ঠু ও জবাবদিহীমূলক প্রশাসন নিশ্চিত হবে? কারা দায়িত্ব পেলে প্রশাসন ও শিক্ষকসমাজ রাজনৈতিক কোন চাপে দুর্নীতি করবে না, অন্যায়ের কাছে নতি স্বীকার করবে না?
সচেতন শিক্ষার্থীসমাজকে বিষয়টি মাথায় রেখে গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান মতামতটি প্রদান করতে হবে আজ ৯ সেপ্টেম্বরে। গোটা জাতির জাগ্রত চোখ সেদিকেই নিবিষ্ট হয়ে আছে। ২৪ এ যেমন জেন-জি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে জাতীয় ক্রান্তিকালে জাতিকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়েছিল, আশা করি আজও তাদের গুরুত্বপূর্ণ মতামত প্রদানে সঠিক ও সেরা প্যানেলটিকেই বেছে নেবে। আমাদের সে আশার আলোই বাকী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আলোর মশাল হয়ে পথ দেখাবে ইনশাআল্লাহ।
লেখক : আইনজীবী ও প্রাবন্ধিক।