আল্লাহ মানুষকে যতগুলো নিয়ামত দান করেছেন তার মধ্যে জিভ অন্যতম। জিভ না থাকলে একজন মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করেত পারে না। মানুষ ব্যক্তি হিসেবে যা ভাবে এবং চিন্তা করে তা মুখের মাধ্যমে প্রকাশ করে। জিভ মানুষের পরম বন্ধু আবার জিভই মানুষের চরম শত্রু। মানুষ কথার মাধ্যমে শত্রুকেও বন্ধুতে পরিণত করতে পারে। আবার জিভের কারণে মানুষের বন্ধুত্বও নষ্ট হয়। তাই জিভের সঠিক ব্যবহার কাম্য। আমরা অনেক মানুষকে প্রত্যক্ষ করি যারা কাজে-কর্মে অত্যন্ত ভালো এবং মানবদরদী কিন্তু তার মুখের ভাষার কারণে কাছের বন্ধুও শত্রুতে পরিণত হয়। কথার মাধ্যমে মানুষের ব্যক্তিগত চরিত্র এবং মন-মানসিকতা অনুধাবন করা যায়। তাই কথা বলার সময় সর্বদাই সংযমী এবং পরিমিতি বোধ থাকা দরকার। বিশেষ করে নেতা-নেত্রীদের বক্তব্য উপস্থাপনকালে পরিমিতি বোধের পরিচয় দিতে হয়। অন্যথায় ভুল বুঝাবুঝির আশঙ্কা থাকে। কিন্তু আমাদের দেশের একশ্রেণির মানুষের মধ্যে কথা বলা অর্থাৎ জিভের ব্যবহারের ক্ষেত্রে সৌজন্যবোধের অভাব পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে নেতা-নেত্রীরা কথা বলার সময় প্রায়শই লিমিট ক্রস করে ফেলেন। এতে তারা সমালোচিত হন। জাতি হয় বিভ্রান্ত। কথায় বলে, ডাক্তারের ভুলে একজন রোগী মারা যেতে পারে। কিন্তু নেতার ভুলে পুরো জাতি বিভ্রান্ত এবং পথভ্রষ্ট হতে পারে।

ক’দিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একজন উঠতি নেতার বক্তব্য শুনে আমি যারপর নেই বিস্মিত হয়েছি। লোকটি এমনিতেই বেশি এবং আবেগপ্রবণ কথা বলেন বলে জানতাম কিন্তু তিনি যে এতটা বাচাল তা আগে বুঝতে পারিনি। তিনি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেন, ‘আমাকে দায়িত্ব দেয়া হলে আমি তিন মাসের মধ্যে পাচারকৃত তিন লাখ কোটি টাকা দেশে ফিরিয়ে আনতে পারবো।’ তার এ বক্তব্য শ্রবণ করে আমার মনে হচ্ছিল লোকটি কি পাগল নাকি মাতাল? বিশ্বব্যাপী অর্থপাচার একটি জটিল সমস্যায় পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো থেকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ নানা প্রক্রিয়ায় বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। অর্থপাচার বলতে আমরা এমন একটি কর্মকে বুঝি যেখানে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তার উপার্জিত অর্থ (অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ) উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের যথাযথ অনুমোদন ব্যতিরেকেই এক দেশ থেকে অন্য দেশে নিয়ে যাওয়া হয়। বৈধ এবং অবৈধ উভয় প্রকার অর্থই পাচার হতে পারে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশ ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ থেকে মোট ২৩ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার সমতুল্য ২৮ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে।

পাচারকৃত অর্থের যে পরিসংখ্যান অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক গঠিত শ্বেতপত্র কমিটি প্রদান করেছে তাকে পূর্ণাঙ্গ চিত্র বলা যাবে না। কারণ যারা অর্থ পাচার করে বা মানি লন্ডারিং এবং অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করেন তাদের একটি সাধারণ চরিত্র হচ্ছে তারা উপার্জনের সূত্র এবং অর্থের পরিমাণ কারো কাছে প্রকাশ করেন না। অবৈধ অর্থের হিসাব সংরক্ষণের জন্য কোনো বৈধ প্রতিষ্ঠান এখনো গড়ে উঠেনি। তাই কেউই বলতে পারবেন না কত টাকা প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী পাচার হচ্ছে। শ্বেতপত্র কমিটি অর্থ পাচারের যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে প্রকৃতপক্ষে পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ আরো অনেক বেশি হবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

যাক টাকা পাচারের পরিমাণগত বিতর্কে না গিয়ে আমরা সংশ্লিষ্ট নেতার বক্তব্য বিশ্লেষণ করি। তিনি বলেছেন, তাকে দায়িত্ব দেয়া হলে তিন মাসের মধ্যে তিন লাখ কোটি পাচারকৃত টাকা ফিরিয়ে আনতে পারবেন। তিনি কী ধরনের ক্ষমতাসহ দায়িত্ব চান তা বললে ভালো হতো। কোনো দেশে অর্থ পাচার হয়ে গেলে সে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনা অত্যন্ত জটিল একটি কাজ। পাচারকৃত টাকার যে গন্তব্য অর্থাৎ যে দেশে পাচার করা হয় সেই দেশের সরকার যদি আন্তরিক না হন তাহলে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনা কোনোভাবেই সম্ভব হয় না। কোনো কোনো দেশ আছে যারা রাষ্ট্রীয়ভাবে অর্থ পাচারকে উৎসাহিত করে থাকে। আপনি সেসব দেশ থেকে কিভাবে পাচারকৃত অর্থ ফেরৎ আনবেন? মালয়েশিয়া তাদের বহুল আলোচিত ‘সেকেন্ড হোম’ প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের পাচারকৃত টাকা তাদের দেশে নিয়ে যাচ্ছে। কোনো বিদেশি যদি মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোমে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করে তাহলে সংশ্লিষ্ট অর্থ পাচারকারীকে নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম প্রকল্পে বাংলাদেশিদের ৩হাজার ৬০০টি এবং দুবাইতে ৫৩২টি বাড়ি বা ফ্লাটের সন্ধান পাওয়া গেছে। চাইলেই কি এসব প্রকল্পে বিনিয়োজিত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনা যাবে? তুরস্ক গত বছর থেকে মালয়েশিয়ার অনুকরণে সেকেন্ড হোম প্রকল্প চালু করেছে। ২০০ বাংলাদেশি নাগরিক তুরস্কের সেকেন্ড হোমে অন্তর্ভুক্ত হবার জন্য আবেদন করেছেন বলে পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। যে যুব নেতা পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন তাকে দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। তাকে এটাও বলে দেয়া যেতে পারে যত ধরনের ক্ষমতা প্রয়োজন হয় তাকে দেয়া হবে। একই সঙ্গে পাচারকৃত যে পরিমাণ অর্থ তিনি তিন মাসের মধ্যে ফিরিয়ে আনতে পারবেন তাকে সেই অর্থের অর্ধেক প্রদান করা হবে। আর যদি তিনি একাজে সফল না হন তাহলে তার পিঠের চামড়া তুলে ফেলা হবে। মনে রাখতে হবে জিভ এবং মুখ থাকলেই যে কোনো কথা বলা যায় না। নিজের ওজন বুঝে কথা বলতে হয়।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বর্তমানে ভারতে পালতক শেখ হাসিনা চাটুকারিতা খুব পছন্দ করতেন। ইসলামি ফাউন্ডেশনের এক সভায় শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে একজন খ্যাতিমান আলেম বলেছিলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি তো একজন জান্নাতি মানুষ। ভাবতে অবাক লাগে একজন আলেম কিভাবে একজন স্বৈরাচারি প্রধানমন্ত্রীকে জান্নাতি মানুষ হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারেন। কোনো মানুষ কি নিশ্চিতভাবে একজন মানুষকে জান্নাতি মানুষ বলে সার্টিফিকেট দিতে পারেন? শেখ হাসিনা যদি সেদিন সে মাওলানাকে অনুষ্ঠান স্থল থেকে বের করে দিতেন তাহলে ভবিষ্যতে আর কেউ তাকে এভাবে চাটুকারিতা করতে সাহস পেতো না। কথায় বলে, যারা সামনাসামনি প্রশংসা করেন তারা সাধারণত ভালো মানুষ নন। যারা সামনে সমালোচনা করতে পারেন তারাই প্রকৃত বন্ধু। কিন্তু আমরা বেশির ভাগ সময় প্রশংসাকারী এবং তোষামোদকারকে চিনতে ভুল করি। যারা সমনে প্রশংসা করেন তারা বিশেষ কোনো স্বার্থ উদ্ধারের জন্যই এটা করে থাকেন। বিগত সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে স্বৈরাচারি শেখ হাসিনাকে এক শ্রেণির মানুষ যেভাবে প্রশংসায় ভাসাতেন তা শুনলেও লজ্জা করতো। তাকে মানবতার জননী, গণতন্ত্রের মানস কন্যা, উন্নয়নের রূপকার হিসেবে আখ্যায়িত করা হতো। এটা শুনে শেখ হাসিনা যারপর নেই আনন্দিত হতেন। এমনকি কোনো কোনো ব্যক্তি এটাও বলে বেড়াতেন যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেতে যাচ্ছেন। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, শেখ হাসিনা তার শাসনামলে যে দুর্নীতি এবং দুঃশাসন কায়েম করেছিলেন তা বিশ্বের ইতিহাসে নজীরবিহীন। তার আমলে দেশের মানুষ তিনটি নির্বাচনে ভোটদানের অধিকার হারিয়েছিলেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কখনোই এভাবে সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়া হয়নি। বিশ্বের অনেক দেশে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন থাকে। নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে বলে বিরোধী দল অভিযোগ করেন। কিন্তু বিগত সরকার আমলের মতো ভোটারবিহীন নির্বাচন, দিনের ভোট রাতে হওয়া অথবা ডামি নির্বাচন অনুষ্ঠানের নজীর নেই।

মানুষের মানবিক গুণাবলি অথবা হিংস্রতা তার মুখের মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে শেখ হাসিনার মুখ থেকে যে ধরনের অশ্লিল বাক্য বর্ষিত হতে তা ছিল নজীরবিহীন। তিনি একবার ড. মোহাম্মদ ইউনূসকে পদ্মা নদীতে ঠুক করে ফেলে দিতে চেয়েছিলেন। তারেক রহমানকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘লন্ডনে বসে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে চলেছে। তিনি আরো বলেন, সাহস থাকলে দেশে ফিরে আয় আমি তোকে একটু দেখি।’ বিগত সরকার আমলে তারেক রহমান দেশে ফিরে এলে তার জীবন সংহার করা হতে পারতো।

মুখের কথা বা জিভের অপব্যবহার একজন মানুষকে কতটা বিপদে ফেলতে পারে তার সর্বশেষ দৃষ্টান্ত হলো সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিদেশে সফরোত্তর সাংবাদিক সম্মেলনে দেয়া প্রশ্নের উত্তর। একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিদের সরকারি চাকরি দেব না তো রাজাকারের নাতি-নাতনিদের চাকরি দেবো? তার এমন গর্হিত মন্তব্য আন্দোলনকারীদের মারাত্মকভাবে উত্তেজিত করেছিল যার পরিণতিতে বৈষম্য বিরোধি আন্দোলন শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে রূপান্তরিত হয়।

জীভ আল্লাহর দেয়া একটি নিয়ামত। এর সঠিক ব্যবহার কাম্য। অন্যথায় যে কোনো সময় বিপদ ঘটতে পারে।

লেখক : ব্যাংকার।