মানবসভ্যতার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে পরিবার। আর পরিবারের মাধ্যমে গড়ে ওঠে একটি সমাজ ও জাতি। স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসা যেমন ভবিষ্যৎ সমাজজীবনকে আলোকিত করে, তেমনিভাবে পরিবারের সুশিক্ষারও সমাজে প্রভাব পড়ে। কিন্তু সে পরিবার আজ ভেঙে যাচ্ছে। একসময়ের একান্নবর্তী পরিবার এখন পাখির বাসার মতো ক্ষণস্থায়ী রূপ নিচ্ছে। একান্নবর্তী পরিবারে স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, দাদা-দাদি, চাচা-চাচি, ফুফু, এক বা একাধিক ভাইবোন ও আত্মীয়-স্বজন একসাথে বসবাস করতো। ফলে পুরো পরিবারে ভালোবাসা ভরপুর ছিল। দাদা-নাতির ভালোবাসা চমৎকার ছিল। দাদাকে ছাড়া নাতির জীবন যেন শূন্যঘর। একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে যাওয়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম ভিনদেশীয় সংস্কৃতি এবং দ্রুত নগরায়ন। একান্নবর্তী পরিবার শহরের তুলনায় গ্রামে বেশি ছিল। গ্রামের পাড়া মহল্লায় একান্নবর্তী পরিবার ছিল। পরিবারের মরুব্বীরা সবকিছুতে নির্দেশনা দিতেন। ভালো মন্দ দেখভাল করতেন। বাড়ির মরুব্বী যা বলছেন তা সবাই পালন করতেন। ইদানীং গ্রাম থেকে একান্নবর্তী পরিবার উঠে যেতে বসেছে। শহরের ঢেউ গ্রামেও লেগেছে। এক সময় পুকুর ভরা মাছ ছিল। গোলা ভরা ধান ছিল। গোয়ালভরা গরু ছিল। কিন্তু আজ এগুলো সবই স্মৃতি। দিন দিন একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে যাচ্ছে। পরিবারের আয়তন ছোট হয়ে আসছে। পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে।

একসময় স্বামী-স্ত্রী, সন্তান, বাবা-মা, ভাই-বোন, চাচা, ফুফু, চাচি, দাদা-দাদি মিলে একটি সাজানো গোছানো একান্নবর্তী পরিবার ছিল। এখন একান্নবর্তী পরিবার খুব একটা দেখা যায় না। দাদা, দাদি, চাচা, চাচি, ফুফু মিলে ২০-৩০ জনের পরিবার খুঁজে পাওয়া যায় না। অধিকাংশ পরিবারে দাদা, দাদি যেন অমাবস্যার চাঁদ। গ্রামে এখনও কিছু পরিবারের দাদা-দাদির দেখা পাওয়া যায়। কিন্তু শহরের পরিবারগুলোতে দেখা পাওয়া মেলা ভার। শহরের পরিবারগুলোর পরিসর দিন দিন ছোট হয়ে আসছে। স্বামী-স্ত্রী মিলে সংসার। উভয়ে আবার চাকরিজীবী। বিপদ-আপদে কাউকে পাওয়া যায় না। নিচ তলার মানুষ দ্বিতীয় তলার বাসিন্দাকে চিনে না। অথচ গ্রামে এখনও একজনের বিপদে অন্যজন এগিয়ে আসে। যা শহরে চিন্তাই করা যায় না। গ্রামের একটি পরিবারে একজন শিশু জন্ম গ্রহণ করলে তাকে দেখভাল করা মানুষের অভাব হয় না। আর শহরে টোনাটুনির সংসারে শিশু জন্মগ্রহণ করলে তাকে দেখভাল করার কেউ যেন থাকে না। বাসার গৃহকর্মী-ই একমাত্র ভরসা। গৃহকর্মীর জিম্মায় নাড়িছেঁড়া ধনকে রেখে যেতে হয়। অনেক সময় গৃহকর্মীরা রেখে যাওয়া শিশুকে নির্যাতন করে, যা মাঝে মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখা যায়। আর বাবা-মায়ের সাহচর্যের অভাবে বেড়ে ওঠা শিশুটি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে বড় হচ্ছে। ফলে তারা দাদা-দাদির ভালোবাসা পায় না। ভালোবাসা মায়া-মমতা কি জিনিস তাও তারা বোঝে না। তারা শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবে, অন্যকে নিয়ে, পরিবারকে নিয়ে ভাবার সময় তাদের হয় না। যার বিরূপ প্রভাবে কিশোর গ্যাং সৃষ্টি হচ্ছে।

গত ১৫ মে একটি জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম-দেশে পরিবারের আকার ছোট হয়ে আসছে। শহর কিংবা গ্রামের বাড়িতে এখন বড় পরিবার খুঁজে পাওয়া ভার। আকার ছোট হয়ে এলেও পরিবারের সংখ্যা প্রতিদিন বেড়ে চলেছে। পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে প্রতিদিন ২ হাজার ২০০ নতুন পরিবার যোগ দিচ্ছে পারিবারিক জীবনে। বাবা-মা, ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে, দাদা-দাদি, চাচা-চাচি নিয়ে একসাথে বসবাস করার মতো পরিবার কমে যাচ্ছে। (সূত্র: প্রথম আলো, ১৫ মে, ২০২৫) বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২৩ সালের বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস অনুসারে দেশের পরিবারগুলোতে গড় সদস্য সংখ্যা ৪ দশমিক ২। তবে একজন জনসংখ্যাবিদ বলেছেন, বর্তমানে সদস্য সংখ্যা ৪ বা তার চেয়ে সামান্য কম। পরিবারের আকার যে ছোট হয়ে আসছে তা বিবিএসের পরিসংখ্যানেও দেখা যায়। প্রায় ২৮ বছর আগে ১৯৯৪ সালে পরিবারে গড় সদস্য সংখ্যা ছিল ৫ দশমিক ৪ আর ২০০৪ সালে ছিল ৫। এ সংখ্যা ২০২২ সালে কমে ৪ জনে দাঁড়িয়েছে। ১৯৯৪ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, শহরের পরিবারগুলোর আকার ছোট হওয়ার প্রবণতা গ্রামের চেয়েও কিছুটা বেশি। এভাবে যদি একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে ভেঙে ছোট হতে থাকে, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে একান্নবর্তী পরিবার থাকবে না। এক সময়ে যে পরিবারে সদস্য সংখ্যা ১০ থেকে ১২ জন ছিল। এখন তা কমে ৪ জনে নেমেছে। একান্নবর্তী পরিবার একটা সময় গর্বের বিষয় ছিল। যে পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেশি ছিল সে পরিবারে সুখ ও ভালোবাসা ভরপুর ছিল। ইদানীং দ্রুত নগরায়ন এবং ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধে একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে যাচ্ছে। অধিকাংশ মানুষ একান্নবর্তী পরিবারের কথা শুনলে নাক ছিটকায়। কেউ কেউ বড় পরিবার দেখে আত্মীয়তা পর্যন্ত করতে অনীহা প্রকাশ করে। অথচ একান্নবর্তী পরিবার সবার জন্য কল্যাণকর। যারা শহরে বসবাস করনে তারা কিছুটা টের পান।

পারিবারিক ও সামাজিক অস্থিরতা বাড়ার পেছনেও পরিবারের ভূমিকা রয়েছে। পারিবারিক কলহ পরিবার ভাঙতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করছে। কারণ অধিকাংশ পরিবার ইসলাম ও শরিয়াহর আলোকে গড়ে উঠছে না। ভিনদেশীয় সংস্কৃতির প্রভাবে পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন হচ্ছে। আকার ছোট হয়ে আসছে। ‘‘যুক্তরাষ্ট্রের সুজু মিগেল ‘হাউ টু বি আ গুড মাদার ইন ল’ নামে একটি বই লিখেছেন - ভালো শাশুড়ি হওয়ার কোনো আইন, নিয়মকানুন আমি পাইনি। তবে আমার শাশুড়িকে দেখে শিখেছি। আর এখন দুই পুত্রবধূর শাশুড়ি হওয়ার পর প্রতিনিয়ত হাতে কলমে শিখছি। নিজে ভালো শাশুড়ি হওয়ার কোনো বই পাইনি। তাই তিনি নিজের অভিজ্ঞতা লিখেছেন। তার ভাষ্যমতে, ভালো শাশুড়ি হওয়ার জন্য একবাক্যে বলতে গেলে নিজের জীবনে, নিজের কাজে মনোযোগী হওয়া, প্রত্যাশা না রাখা, পরিবারে নতুন সদস্যকে সর্বোচ্চ ইতিবাচকতার সঙ্গে গ্রহণ করা, সহানুভূতিশীল হওয়া, ক্ষমা করা আর উপহার দেয়ার কোনো বিকল্প নেই। ছেলে বা মেয়ের সংসার এখন তাদের প্রথম অগ্রাধিকার। তাদেরকে নিজেদের দায়িত্ব বুঝে নিতে দিন। সময়টাকে উপভোগ করতে দিন। নিজেদের বোঝাপড়ার পূর্ণ সুযোগ দিন। তাদের উপার্জিত অর্থ তারা কী করবে বা কোন খাতে খরচ করবে, সেটা একান্তই তাদের ব্যাপার। কবে তারা সন্তান নেবে বা আদৌ নেবে কি না, সে সিদ্ধান্ত একান্তই তাদের।

এককথায় অন্যের সংসারে নাক গলাতে যাবেন না। সেটা আপনার ছেলে বা মেয়ে হলেও না! কেননা ব্যক্তিগত স্পেস’কে সম্মান করতে হবে। নয়তো জটিলতা তৈরি হবেই।’’ পরিবারের সবার ভেতর ত্যাগের মনমানসিকতা বিরাজ করলে বহু সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। সন্তান বড় হলেও মায়েরা মনে করে সে বড় হয়নি। আর বিয়ের পর তো মনে করে ছেলে আমার বউ পাগল হয়ে গেছে। অথচ একজন মা ইচ্ছে করলে একটু বিবেক বুদ্ধি খাটিয়ে সংসারে সুখের বীজ বপন করতে পারেন। পরিবারে ঝগড়া হওয়া স্বাভাবিক বিষয়। পাতিলের সাথে পাতিল রাখলে শব্দ হয়। এমন কোন পরিবার নেই যেখানে ঝামেলা নেই। ঝামেলা আছে বলেই তো পরিবার। সুতরাং কেউ ঝগড়া বা খারাপ আচরণ করলে সম্পর্ক কাটআপ করা ঠিক না। ঝগড়া বা খারাপ আচরণ দিয়ে কাউকে বিচার করা ঠিক না। সংসারের সবাই আপজন। প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু অবদান রয়েছে। সুতরাং সবারই মনে রাখা প্রয়োজন বাড়াবাড়িতে কোন কল্যাণ নেই।

একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে গেলে আমাদের অসুবিধা কোথায়? আমাদের অসুবিধার জায়গাটি হচ্ছে আমাদের নীতি নৈতিকতা কিংবা সামাজিকতা দিন দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দিন দিন লিভ টুগেদার, সিঙ্গেল মাদার বা বৃদ্ধাশ্রম নামক যন্ত্রণা বাড়ছে। অথচ একটা সময় আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক কত মধুর ছিল। কত সুন্দর ছিল, যা আজকের যুগে মনের আয়নাতে শুধু কল্পনাই করা যায়। আমাদের পারিবারিক জীবন নষ্ট হওয়ার পেছন আকাশ সংস্কৃতি অনেকাংশেই দায়ী। আকাশ সংস্কৃতির বিরূপ প্রভাবের কারণে পারিবারিক বিরোধ, সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও বিয়েবিচ্ছেদ বাড়ছে। বিয়ে বিচ্ছেদ এমন হারে বাড়ছে, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। বাংলাদেশে বিবাহ বিচ্ছেদের হার কত? এমন প্রশ্ন যে কারও মনে জাগ্রত হতে পারে। হওয়াটাই স্বাভাবিক।

তবে ২০২৫ সালে এ পর্যন্ত বিবাহ বিচ্ছেদের হার সম্পর্কিত কোন পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়নি। তবে এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ২০২৩ সালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৭ হাজার ৩০৬টি এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ৬ হাজার ৩৯৯টি বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এর ভাষ্য অনুসারে ২০২৩ সালে বিবাহ বিচ্ছেদের হার ১.১ শতাংশে নেমে এসেছিল যা ২০২২ সালে ছিল ১.৪ শতাংশ। বর্তমানে কী অবস্থা তা জানা সম্ভব হয়নি। পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানকে সরল সোজা পথে রাখার স্বার্থে নিজেদের ইতিহাস ঐহিত্য, সামাজিক মূল্যবোধ, মানবিক মূল্যবোধ ও ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রচার প্রসার বাড়ানো প্রয়োজন। পাশাপাশি পরিবার ও পারিবারিক জীবনকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে একান্নবর্তী পরিবার প্রথা ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে স্কুল কলেজের পাঠ্যবইয়ে একান্নবর্তী পরিবারের সুফলগুলো তুলে ধরা প্রয়োজন। যেন কোমলমতি শিশু-কিশোররা একান্নবর্তী পরিবার সম্পর্কে ভালো ধারণা পেতে পারে। এটা করতে পারলে আমাদের পরিবার ও সমাজ ভালো থাকবে, ভালো থাকবে দেশ।

লেখক : প্রাবন্ধিক