মো: গোলাম ফারুক
আজ ২২ অক্টোবর ২০২৫ জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস। সড়ক পরিবহন খাতে বিভিন্ন সংগঠন ও সরকার এ দিবসটি। যথাযথভাবে পালন করছে। এ খাতে অন্যতম সংগঠন বাংলাদেশ অটোরিক্সা হালকাযান পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন ও অনেক কর্মসূচী পালন করছে। অনেক প্রাণের বিনিময়ে দিবসটি জাতীয়ভাবে পালনের স্বীকৃতি লাভ করেছে। যাদের প্রাণের বিনিময়ে ও অক্লান্ত পরিশ্রমে দিবসটি জাতীয়ভাবে পালনের স্বীকৃতি লাভ করেছে তাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। একটি দেশের উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে সময় উপযোগী উন্নত সড়ক ব্যবস্থাপনা। যে দেশে যোগাযোগ ব্যবস্থাপনা যত আধুনিক সে দেশ তত উন্নত। বাংলাদেশের পরিবহন খাতে বিভিন্ন যানবাহনের মধ্যে অটোরিক্সা হালকাযান পেট্রোল, অকটেন, ডিজেল, সিএনজি, এলপিজি দ্বারা গাড়ী চলাচল করে থাকে। এসব যানবাহনের সংখ্যা প্রায় ৪০ লক্ষ। যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের স্বল্প সময়ে গন্তব্যে পৌছে দেওয়ার ক্ষেত্রে এসব হালকাযানবাহন খুবই কার্যকর। এ হালকাযানের শ্রমিকগণ ১৯৫৬ সাল থেকে গ্রাম ও শহরে দিন রাত যাত্রী ও পন্য পরিবহন সেবা প্রদান করে আসছে। এসব হালকাযানের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ ‘ডোর টু ডোর সেবা পেয়ে আসছে। অসুস্থ রোগী ও জরুরী সেবার ভিত্তিতে দ্রুত হাসপাতালে পৌছে দেওয়ার একমাত্র পরিবহন হালকাযান।
এ পরিবহন ‘গরীবের এম্বুলেন্স’ বলে স্বীকৃতি লাভ করেছে। জাতীয় রাজনীতি ও সংগ্রামে এই পরিবহনের শ্রমিকদের অনেক ভূমিকা রয়েছে। ১৯৬৯ সালে মরহুম মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে গণ আন্দোলনসহ তৎকালীন লাট ভবন (বর্তমানে বঙ্গভবন) ঘেরাও কর্মসূচিতে এ শ্রমিকেরা অংশগ্রহণ করেছে। ১৯৭১ সালে এ শ্রমিকগণ মহান মুক্তিযুদ্ধে, ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে রাজপথে অংশগ্রহণ করেছে। সর্বোপরি ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে অনেক চালক হতাহত হয়েছে। কিন্তু পরিবহন শ্রমিকদের এইসব ভূমিকা খুবই কমই মূল্যায়ন করা হয়। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ভাবে তারা অবহেলিত সমাজ এখনও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা নেতিবাচক ভাবে মূল্যায়ন করে। এ কথা ঠিক যে, পরিবহন শ্রমিক ভূল করলে জনগণের অনেক ক্ষতি হয় ফলে সবাই তাদের সমালোচনা করে। পক্ষান্তরে ১ জন ডাক্তার ভুল করলে একজন রোগীর প্রাণহানি ঘটে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে দেশে রাষ্ট্রীয় ভাবে পরিবহন শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। শ্রমিকরা স্বউদ্যোগে প্রশিক্ষিত হয়ে এই পেশায় সেবা দিয়ে আসছে। পরিবহন শ্রমিকরা হচ্ছে সমাজ রাজনীতি অর্থনীতির চালিকা শক্তি ।
নিরাপদ সড়কের জন্য আমরাও আমরাও নিরাপদ সড়ক চাই। অনেক আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে ও দাবী তুলছি। কারণ পরিবহন শ্রমিকগণ ১৬-১৮ ঘন্টা রাস্তায় থাকে, তাই তাদের নিরাপদ সড়ক বেশি জরুরী। সড়ক দুর্ঘটনা নানা কারণে হয়ে থাকে। যেমন গাড়ীর যান্ত্রিক ত্রুটি, সড়ক নির্মানে ত্রুটি, সাইন-সিগনাল ত্রুটি, অতিরিক্ত লোড-ওভার, স্পীড, বৈরী আবহাওয়া, আকাঁ-বাকা সড়ক, শ্রমিকদের, অতিরিক্ত কর্মঘন্টা সড়ক মহাসড়কে ডিভাইডার না থাকা সহ নানা কারণে হয়ে থাকে। এ বিষয়ে অনেক সেমিনার, আলোচনা, টকশো, বিভিন্ন ভাবে প্রচার ও প্রকাশ করা হলেও বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ না করার ফলে সড়ক দুর্ঘটনা থামছে না। বিশেষজ্ঞরা মনে করে সড়ক ও পরিবহন খাতের সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে নিয়ে সড়ক ও পরিবহন ব্যবস্থাপনার বাস্তব সম্মত ও আধুনিক নীতিমালা ও আইন প্রনয়ন এবং পক্ষপাতহীনভাবে আইন বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা।.
বিগত কয়েক বছরে ঢাকা শহরসহ বিভিন্ন শহরে বিভিন্ন যাতের রিক্সা, ইজিবাইক নানা নামে থ্রি-হুইলার চলাচল করছে। এইসব গাড়ীগলো সড়ক মহাসড়কেও চলাচল করে। এখনও অনেক সড়ক মহাসড়কে ডিভাইডার ও বাইলেন স্থাপিত না হওয়ায় অনেক সময়ে দ্রুতগামী যানবাহন মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে করে ব্যাপক জানমালের ক্ষতিসাধন হয়। এ জানমালের সুরক্ষার জন্য সড়ক ও মহাসড়কে ডিভাইডার ও বাইলেন স্থাপন জরুরী। একই সাথে বাইলেনগুলো হালকা যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত রাখা জরুরী। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের দায়িত্ব পালন করতে হবে। একসময় ঢাকা শহরকে বলা হতো মসজিদের শহর, বর্তমানে ঢাকা শহরসহ সারা দেশে যেভাবে এ থ্রি-হুইলার বিভিন্ন নামে অটোরিক্সাগুলো চলাচল করছে মানুষের হাটার রাস্তা নেই ফুটপাত হকারদের দখলে, রাস্তায় অবৈধ ও অনিবন্ধিত যানবাহনে সয়লাব হয়ে গেছে শহরগুলোতে। কয়েকদিন আগে দেখতে পেলাম সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে। ইঞ্জিন চালিত গাড়ীর মালিকগণ বলছেন এ অবৈধ অনিবন্ধিত গাড়ীগুলোর বিষয়ে সরকার কোন কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে আমরা ট্যাক্স/কর প্রদান থেকে বিরত থাকব। প্রতি বছর ২২ অক্টোবর আসলে সরকার ডাকঢোল পিটিয়ে নিরাপদ সড়কের কথা বলে নিরাপদ সড়ক উদযাপন বা পালন করে। কিন্তু আসলে এতকিছু করে সরকার জনগণের জন্য কতটুকু নিরাপদ সড়ক উপহার দিতে পারলো?
ঢাকা শহর সহ সারা দেশে যানজট একটা প্রকট সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে। কর্মজীবি ঢাকার শহরে বাসা থেকে কর্মস্থলে যাওয়া আশায় প্রায় ১-২ ঘন্টা সময় নষ্ট হয়। ঢাকার শহরে প্রায় কর্মজীবী মানুষ ১ কোটি ২৫ লক্ষ তাতে প্রতিদিন এই কর্মজীবী মানুষের প্রায় ২ কোটি ঘন্টা সময় নষ্ট হচ্ছে। যার ফলে দেশের অর্থনীতি ক্ষতি হচ্ছে এবং কর্মজীবী মানুষের মানসিক চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। এতে অনেক লোক মানসিকভাবে বিপদগ্রস্থ হচ্ছে। বিগত সরকার সংশ্লিষ্ট স্টেক হোল্ডারদের সাথে আলোচনা না করেই সড়ক পরিবহন আইন একতরফাভাবে পাশ করেছে। যার ফলে শ্রমিকগণ এ আইনের বিরোধীতা করে আসছে। আমরা মনে করি শ্রমিকদের শাস্তি ও জরিমানা বৃদ্ধি করলেই সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে না। আমরা সকলের জন্য গণতান্ত্রিক সড়ক পরিবহন আইন চাই। যাতে এই শিল্প ও শ্রমিকের স্বার্থ সুরক্ষা হয় ।
আমাদের প্রস্তাবসমূহ: ট্রাফিক আইন সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করতে হবে, গাড়ী চালকদের প্রশিক্ষণের জন্য সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ ও আধুনিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, একটানা ৫-৬ ঘন্টার বেশি গাড়ী চালানো নিষিধ করতে হবে। ঢাকা শহর সহ প্রধান সড়ক মহাসড়কে রিক্সা মুক্ত করতে হবে। ঢাকা শহরসহ সকল সড়কে অবৈধ ও অনিবন্ধিত ও ফিটনেস বিহীন ও ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন চলাচল বন্ধ করতে হবে। গাড়ী চালানোর সময় চালকদের প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবের পরিবর্তন করতে হবে। মটর সাইকেল ও সাইকেল ও পথচারীদের জন্য আলাদা লেন করতে হবে। জনসাধারণকে ট্রাফিক আইন এককথায় সড়কে চলাচলের জন্য নিয়মকানুন মেনে চলার মিডিয়ার মাধ্যমে আরো বেশি প্রচার প্রচারণা করতে হবে।
পরিবহন শ্রমিকদের জীবন জীবিকার কথা বিবেচনা করে তাদের অধিকার পুনরুদ্ধার করা দরকার। এক্ষেত্রে আমরা সর্বস্তরের মানুষের সহযোগিতা কামনা করছি। পরিবহন একটি সেবামূলক শিল্প। স্বাভাবিক ভাবে এ শিল্পে কর্মরত শ্রমিকরা প্রত্যেকেই একজন সেবক। এসব শ্রমিকরা সারাদিন দেশের উন্নয়নের জন্য গাড়ীর চাকা ঘুরালেও দিনের শেষে চালকদের পরিবারের (সংসারের) চাকা ঘুরে না। এ শ্রমিকরা প্রতিদিন রাস্তায় নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এই শিল্পের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে সরকারের কাছে ইতিপূর্বে ১০ দফা দাবীনামা পেশ করা হয়েছে। দাবী বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম, সাংবাদিক সম্মেলন, বিক্ষোভ মিছিলসহ নানা কর্মসূচী পালন করেও শ্রমিকরা তাদের দাবী বাস্তবায়নে সরকারের কাছ থেকে আশ্বাস ছাড়া কিছুই পায়নি। শ্রমিকদের প্রত্যাশা বর্তমান সরকার সর্বদিক বিবেচনা করে এ পরিবহন শ্রমিকদের ১০ দফা দাবি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আমরাও নিরাপদ সড়ক চাই । একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না অবসান হোক ।
লেখক : প্রাবন্ধিক।