চিকিৎসা পাওয়া মানুষের জন্মগত অধিকার- এটি করুণানির্ভর নয়, রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের ন্যায্য দাবি। কিন্তু আজও এ দেশে সে ন্যায্য অধিকারটুকু প্রতিটি নাগরিকের ভাগ্যে জোটে না। চিকিৎসা যেন এক প্রকার বিলাসিতা, যা কেবল ধনীর জন্য সংরক্ষিত। গরিব মানুষের ভাগ্যে কখনো হাসপাতালের বারান্দা, কখনো বা জীবনের সঙ্গে আপস করে বাঁচা। করোনাকালে দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার ভঙ্গুরতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল। আমরা ভেবেছিলাম, এ মহামারি আমাদের চেতনায় আলোড়ন তুলবে, চিকিৎসাখাতের আমূল পরিবর্তন আনবে। কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি। করোনা গেলেও চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়নি। ফ্যাসিস্ট শাসনের পতনের পর সাধারণ মানুষ আশাবাদী হয়েছিল- চিকিৎসা সেবার মান উন্নত হবে। কিন্তু বাস্তবে সে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। তার জ¦লন্ত প্রমাণ উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ট্র্যাজেডি। গত ২১ জুলাই বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান কলেজ ভবনের ওপর বিধ্বস্ত হয়। আগুনে দগ্ধ হয় কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। মৃত্যুবরণ করে অনেক শিশুই, যাদের স্বপ্ন ছিল আকাশ ছোঁয়ার-তারা উড়ে গেল না ফেরার দেশে। দেশজুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে। কিন্তু তা ছিল সাময়িক। আমরা ভুলে যাই, ভুলে যেতে বাধ্য করি নিজেদের-যেমনটি ভুলে যেতে বসেছি ২৪ জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা দেশে দিন দিন বাড়ছে। পরিসংখ্যান বলছে- প্রতি বছর প্রায় ছয় লাখ মানুষ আগুনে দগ্ধ হচ্ছেন। অথচ চিকিৎসা প্রায় অনুপস্থিত। অন্যান্য রোগের চিকিৎসা কিছুটা পাওয়া গেলেও আগুনে পোড়া রোগীদের চিকিৎসা একমাত্র ঢাকা মেডিকেল কলেজ বার্ন ইউনিট। দেশে কালভার্ট হয়, বড় বড় সেতু হয়, মেট্রোরেল হয়। শুধু হয় না আগুনে দগ্ধ মানুষগুলোর চিকিৎসা। এটা নিয়ে কেউ ভাবেও না। যখন আগুনে দগ্ধ মানুষের চিৎকারে আকাশ ভারী হয়ে উঠে তখন কেবল আলোচনায় আসে বার্ন ইউনিট বাড়ানো দরকার। কিন্তু দিন কয়েক এর ব্যবধানে আবার হারিয়ে যায় এ উদ্যোগ। গত দু দশকে যত বড় অগ্নিকাণ্ড হয়েছে, সবগুলোই একটি প্রশ্ন রেখে গেছে- কেন নেই দেশের বিভিন্ন জেলায় বার্ন ইউনিট। অথচ চিকিৎসাখাতে প্রতিবছর বরাদ্দ বাড়ে। নতুন মেডিকেল কলেজ গড়ে ওঠে। কিন্তু প্রকৃত প্রশ্ন থাকে উপেক্ষিত-সেবা কোথায়? দেশের আটটি বিভাগে একটি করে পূর্ণাঙ্গ বার্ন ইউনিট নেই। নেই পর্যাপ্ত আইসিইউ সুবিধা। অথচ অগ্নিদগ্ধ রোগীর জন্য প্রথম ২৪ ঘন্টা হলো ‘গোল্ডেন আওয়ার’। এই সময়ে চিকিৎসা না পেলে রোগীকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে। পঞ্চগড়ের কোনো রোগী যদি ঢাকায় চিকিৎসার জন্য রওনা দেন তার ঢাকায় আসতে সময় লেগে যায় ২৪ ঘন্টার বেশি। অপরদিকে সবাই ঢাকায় আসতে পারেও না। এ অব্যবস্থার ফলে অসংখ্য মানুষ চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। যার আশু অবসান কাম্য।
অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে বহু লেখালেখি, সেমিনার ও সিম্পোজিয়াম হয়। কিন্তু দুর্ঘটনার মিছিল থামছে না। আগুনের লেলিহান শিখা অসংখ্য মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। নিচে কয়েকটি মর্মান্তিক ঘটনার উল্লেখ করা হলো : ২০০৫ সালে সাভারের স্পেকট্রাম গার্মেন্টসে ৬৪ জন, ২০০৬ সালে চট্রগ্রামের কেটিএস কম্পোজিট টেক্সটাইলে ৯১ জন, ২০১০ সালে গাজীপুরের গরীব এন্ড গরীব সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে ২৫ জন, ২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলীতে ১২৪ জন, ২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশনসে ১১৭ জন, ২০১৯ সালে ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্রায় ৬৭ জন,২০২০ সালে নারায়ণগঞ্জের মসজিদে এসি বিস্ফোরণে ৩৪ জন,২০২১ সালে রূপগঞ্জে হাসেম ফুড ফ্যাক্টরিতে ৫২ জন, ২০২২ সালে বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জন নিহত, ৪৫০ জন মানুষ আহত হয়েছিলেন। গত ১০ বছরে আমরা তাজরিন গার্মেন্টস, রানাপ্লাজা ধ্বস, গুলশান ডিএনসিসি মার্কেটে অগ্নিকাণ্ড, চুড়িহাট্টা, বনানীর এফআর টাওয়ার, ইউনাইটেড হাসপাতাল, বঙ্গবাজার, নিউমার্কেটসহ নিমতলী ট্র্যাজেডিতে হাজারো মানুষকে প্রাণ দিতে দেখেছি। সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কাউকে শাস্তি দেয়া হয়েছে এমন নজির চোখে পড়েনি। একেকটি দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠিত হয়, কিন্তু সেসব তদন্ত প্রতিবেদন জাতির সামনে প্রকাশ করা হয় না। উল্লিখিত ঘটনার অধিকাংশতেই দেখা গেছে প্রাথমিক চিকিৎসা অবহেলা, অবকাঠামোর অভাব, আইসিইউ সংকট এবং প্রশিক্ষিত চিকিৎসকের ঘাটতির কারণে দগ্ধ রোগীদের মৃত্যু ঘটেছে। ঢাকার বাইরের য়ে কয়টি মেডিকেল কলেজে বার্ন ইউনিট আছে, সেগুলোতেও চিকিৎসক, বেড, আইসিইউ নেই, ফলে রোগীদের পোহাতে হয় সীমাহীন কষ্ট। সময়মতো চিকিৎসা না পেয়ে অনেকে মৃত্যুবরণ করেন পথেই।
দেশের বিভাগীয় শহর থেকে শুরু করে জেলা এবং থানা পর্যায়ে মেডিকেল কলেজ আছে। এসব হাসপাতালে অগ্নিদগ্ধ রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেয়ার ব্যবস্থা থাকলে বহু মূল্যবান জীবন বেঁচে যেত। এসব হাসপাতালে অগ্নিদগ্ধ রোগীরা চিকিৎসা পাচ্ছে না। অধিকাংশ রোগীকে ঢাকামুখী হতে হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ যেন একমাত্র ভরসা। দেশের যে কোন স্থানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে রোগীদের চিকিৎসা নিতে রাজধানীতে আসতে হয়। ঢাকার বাইরের যে কয়টি হাসপাতালে বার্ন ইউনিট চিকিৎসা প্রদান করা হয় অধিকাংশগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। বেড, আইসিইউ, চিকিৎসক নেই। ফলে রোগীরা যথাযথ সেবা পায় না। আগুনে দগ্ধ রোগীদের হাসপাতাল পর্যন্ত পৌছতে বহু সময় পথেই নষ্ট হয়ে যায়। যুগ যুগ ধরে ক্ষমতার পালাবদল হয়। কখনো নিয়মে। কখনো অভ্যুত্থানে। কিন্তু স্বাস্থ্যখাতে আশানুরূপ উন্নতি হয়নি; বরং উন্নতির নামে দুর্নীতির চাষাবাদের খবর পত্রিকার পাতায় মুদ্রিত হয়। হাসিনা ২০০৮ সাল থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল। তাঁর শাসনামলে উন্নয়নের জোয়ার বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু ঠেকাতে পারেনি। উন্নয়নের চাইতে দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতি সর্বত্র ক্যান্সারের ন্যায় ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রকৃতপক্ষে জনগণ কাক্সিক্ষত মানের সেবা পায়নি বরং ড্রাইভার মালেক কেলেংকারির মতো ঘটনায় প্রমাণ হয়েছে- উন্নয়নের নামে দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতির চাষাবাদ হয়েছে। সরকারি কৌশলপত্রে ব্যয় কমিয়ে স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করার কথা বলা হলেও করোনাকালে টিকা কেনা, ওষুধ সংগ্রহ ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণ করে- সরকারি প্রতিশ্রুতি ছিল লোক দেখানো।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী গেল ১৫ বছরে গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার করে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয়েছে। অথচ সেই টাকাগুলোর একটি অংশ ব্যয় হলেই দেশের প্রতিটি জেলায় বার্ন ইউনিট গড়ে তোলা যেত। তার শাসনামলে ২০টি মেডিকেল কলেজের অনুমোদন দেয়া হয়। কিন্তু এগুলো মানুষের উপকারে আসছে না। অধিকাংশ মেডিকেল কলেজ খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে। তাহলে গলদটা কোথায়? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরী। আমরা আর কত মৃত্যু দেখব? আর কত চিকিৎসা না পেয়ে প্রাণ হারানোর খবর শুনব? সময় এসেছে সঠিক প্রশ্ন তোলার এবং কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের। দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ছোট পরিসরে হলেও বার্ন ইউনিট স্থাপন করা সময়ের দাবি। রোগীর চিকিৎসা যেন সময়মতো হয় সেজন্য চিকিৎসক, নার্স, যন্ত্রপাতি ও আইসিইউ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। শুধু কেন্দ্রীয় নয়, স্থানীয় পর্যায়ে প্রতিটি মানুষের চিকিৎসার অধিকার নিশ্চিত করা হোক। পাশাপাশি বার্ন চিকিৎসা সহজলভ্য ও মানসম্মত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উদ্যোগী ভূমিকা পালন করবে, এমনটিই দেশবাসীর প্রত্যাশা।
লেখক : প্রাবন্ধিক।