হেনা শিকদার
একবিংশ শতাব্দীর ভূ-রাজনীতির মঞ্চে যদি কোনো একটি আখ্যান প্রধান হয়ে ওঠে, তবে তা হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং গণচীনের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান প্রতিদ্বন্দ্বিতা। বিশ্লেষকরা একে প্রায়ই বিংশ শতাব্দীর সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার মধ্যকার স্নায়ুযুদ্ধের সাথে তুলনা করে ‘নতুন ঠাণ্ডা যুদ্ধ’ বলে অভিহিত করছেন। কিন্তু এ নতুন দ্বন্দ্বের স্বরূপ কি সত্যিই পুরোনো ঠাণ্ডা যুদ্ধের মতো? নাকি এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন, আরও জটিল এবং গভীর এক সংঘাতের নাম, যা আগামী দশকগুলোতে বিশ্বের ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ধারণ করে দেবে?
‘শীতল যুদ্ধ’ নাকি ভিন্ন কিছু?
প্রথমেই বোঝা দরকার, এ তুলনাটি কতটা যৌক্তিক। পুরোনো শীতল যুদ্ধ ছিল দুটি সম্পূর্ণ বিপরীত আদর্শের (পুঁজিবাদ বনাম সাম্যবাদ) এবং দুটি বিচ্ছিন্ন অর্থনৈতিক ব্লকের (ন্যাটো বনাম ওয়ারশ প্যাক্ট) সামরিক ও পারমাণবিক প্রতিযোগিতা। সেখানে অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা ছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। বিপরীতে, আমেরিকা ও চীনের বর্তমান প্রতিদ্বন্দ্বিতা এক ভিন্ন বাস্তবতার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এ দু’শক্তি অর্থনৈতিকভাবে পরস্পরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। চীন একসময় আমেরিকার ‘বিশ্ব কারখানা’ ছিল, এবং এখনো মার্কিন ট্রেজারি বণ্ডের অন্যতম বৃহৎ ধারক। এ গভীর অর্থনৈতিক আন্তঃনির্ভরশীলতা (“Chimerica”) একটি পূর্ণাঙ্গ বিভাজনকে অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং জটিল করে তোলে। তবুও, ‘ঠাণ্ডা যুদ্ধ’ শব্দটি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে কারণ এ দ্বন্দ্ব কেবল বাণিজ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি ছড়িয়ে পড়েছে প্রযুক্তি, সামরিক প্রভাব, বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থা এবং সর্বোপরি, আদর্শগত ক্ষেত্রে।
প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রধান ক্ষেত্রসমূহ
এ নতুন বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার প্রধান যুদ্ধক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করা জরুরি
প্রযুক্তিগত আধিপত্য: এ দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দু হলো প্রযুক্তি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), ৫জি নেটওয়ার্ক, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, এবং বিশেষ করে সেমিকন্ডাক্টর (চিপস) নিয়ে যে লড়াই চলছে, তাকে ‘প্রযুক্তির স্নায়ুযুদ্ধ’ বলা চলে। আমেরিকা চাইছে চীনের প্রযুক্তিগত উত্থানকে (যেমন হুয়াওয়ে) প্রতিহত করতে এবং তার সংবেদনশীল সাপ্লাই চেইনকে সুরক্ষিত রাখতে (যেমন ‘চিপস অ্যাক্ট’)। অন্যদিকে, চীন ‘মেড ইন চায়না ২০২৫’ নীতির মাধ্যমে প্রযুক্তিগত আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনে মরিয়া। যে এ দৌড়ে জিতবে, সে-ই একবিংশ শতাব্দীর অর্থনৈতিক ও সামরিক মানদণ্ড নির্ধারণ করবে।
অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক দ্বন্দ্ব : ট্রাম্প প্রশাসনের শুরু করা বাণিজ্য যুদ্ধ এখনো ভিন্নরূপে অব্যাহত আছে। শুল্ক আরোপ, রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ এবং বিনিয়োগে নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে আমেরিকা চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি কমানোর চেষ্টা করছে। এর জবাবে, চীন তার ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (ইজও)-এর মাধ্যমে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ জুড়ে অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত প্রভাব বলয় তৈরি করছে। এটি পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (যেমন বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ) প্রতি একটি সরাসরি চ্যালেঞ্জ।
ভূ-রাজনৈতিক ও সামরিক উত্তেজনা: দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি, তাইওয়ান প্রণালীতে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা সামরিক সংঘাতের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। এর জবাবে আমেরিকা ‘কোয়াড’ Quad) এবং ‘অকাস’ (AUKUS)-এর মতো সামরিক ও কৌশলগত জোট গঠন করে চীনকে প্রতিহত করার (containment) নীতি গ্রহণ করেছে।
আদর্শগত বিভাজন : এ লড়াইয়ের একটি গভীরতম দিক হলো আদর্শিক। একদিকে রয়েছে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা উদারনৈতিক গণতন্ত্র, মুক্তবাজার এবং মানবাধিকারের ধারণা। অন্যদিকে রয়েছে চীনের ‘রাষ্ট্র-পরিচালিত পুঁজিবাদ’ (State-led Capitalism) এবং প্রযুক্তিগত নজরদারির মাধ্যমে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের মডেল, যা অনেক উন্নয়নশীল দেশের কাছে দ্রুত উন্নয়নের বিকল্প পথ হিসেবে আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে।
বিশ্বের ভবিষ্যৎ : এক বিভক্ত পৃথিবী?
আমেরিকা-চীন এ দ্বন্দ্বের সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ছে বিশ্বের প্রতিটি কোণে। এর ভবিষ্যৎ পরিণতি কী হতে পারে?
দ্বি-মেরুকরণ ((Bifurcation) : বিশ্ব দুটি প্রধান ব্লকে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। একটি আমেরিকাকেন্দ্রিক এবং অন্যটি চীনকেন্দ্রিক। দেশগুলোকে ক্রমবর্ধমানভাবে পক্ষ বেছে নেওয়ার জন্য চাপের মুখে পড়তে হচ্ছে। এটি প্রযুক্তির জগতেও বিভাজন আনছেÑ একটি ‘আমেরিকান ইন্টারনেট’ (গুগল, ফেসবুক) এবং একটি ‘চাইনিজ ইন্টারনেট’ (উইচ্যাট, বাইদু)।
মধ্যম শক্তিগুলোর উত্থান : অনেক দেশই (যেমন- ভারত, ব্রাজিল, তুরস্ক, সৌদি আরব) কোনো একটি নির্দিষ্ট পক্ষ নিতে নারাজ। তারা এ প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে চাইছে এবং একটি ‘বহু-মেরুকরণের’ Multipolar) বিশ্বব্যবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা : জাতিসংঘ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা WTO),, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর মতো বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানগুলো এ দু’শক্তির লড়াইয়ের ফলে অকার্যকর ও দুর্বল হয়ে পড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক মহামারি বা পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের মতো অতি জরুরি বৈশ্বিক সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা ব্যাহত হচ্ছে।
সাপ্লাই চেইনের পুনর্গঠন : বিশ্বায়ন এখন বিপরীতমুখী। দেশগুলো আর সস্তা উৎপাদনের জন্য কেবল একটি দেশের ওপর নির্ভর করতে চাইছে না। ‘ডিকাপলিং’ (বিচ্ছিন্নকরণ) বা ‘ডি-রিস্কিং’ (ঝুঁকি কমানো) এর নামে সাপ্লাই চেইনগুলো বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে, যা বৈশ্বিক বাণিজ্যের খরচ বাড়াবে এবং মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিতে পারে।
বাংলাদেশের মতো দেশের চ্যালেঞ্জ : বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো পড়েছে এক জটিল কূটনৈতিক সংকটে। একদিকে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের প্রধান বাজার আমেরিকা ও ইউরোপ। অন্যদিকে, দেশের বৃহত্তম অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর (যেমন- পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল) প্রধান অংশীদার চীন।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূলমন্ত্র ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়’। কিন্তু এ নতুন ঠাণ্ডা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এ ভারসাম্য রক্ষা করা কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি এবং বিআরআই-উভয় উদ্যোগেই বাংলাদেশকে কাছে টানার চেষ্টা চলছে। এ ভূ-রাজনৈতিক দাবার চালে যেকোনো একটি ভুল পদক্ষেপ দেশের সার্বভৌমত্ব ও অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে পারে।
আমরা এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছি। এটি বিংশ শতাব্দীর ঠান্ডা যুদ্ধের কার্বন কপি নয়, বরং তার চেয়েও জটিল। কারণ এখানে শত্রু-মিত্রের বিভাজন স্পষ্ট নয় এবং অর্থনৈতিকভাবে সবাই সবার সাথে জড়িত। এ ‘নতুন ঠাণ্ডা যুদ্ধ’ কোনো আদর্শিক বিজয়ের মাধ্যমে শেষ হবে না, বরং এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রতিযোগিতা যা একটি ‘নতুন ভারসাম্য’ (New Equilibrium) খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত চলতে থাকবে।
বিশ্বের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এ দু’পরাশক্তি তাদের এ অনিবার্য প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে কীভাবে পরিচালনা করে তার ওপর। তারা কি সরাসরি সংঘাতের দিকে যাবে, নাকি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় ন্যূনতম সহযোগিতার একটি ক্ষেত্র খুঁজে পাবে? এর উত্তরের মধ্যেই নিহিত রয়েছে একবিংশ শতাব্দীর বৈশ্বিক শান্তি ও সমৃদ্ধির চাবিকাঠি।
লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়