এইচ এম আব্দুর রহিম

বাজারে চালের দাম বেড়েছে। বাজার অনুসন্ধান করে জানা গেছে, সরু নাজিরশাইল বাজারভেদে বিক্রি হচ্ছে ৭৫ টাকা থেকে ৮৫ টাকা। কাটারি ভোগ ও অন্যান্য সুগন্ধি চালের দাম আরো বেশি। মোটা জাতের স্বর্ণা ও চায়না প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। মাঝারি ব্রিধান ২৯ বিক্রি হচ্ছে ৬১ থেকে ৬৫ টাকা। মিনিকেট নামে সরু চাল ৭০ থেকে ৭৫ টাকা। ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফা লাভের আশায় ইচ্ছামত চালের দাম বাড়িয়ে দেওয়ায় ভোগান্তি শিকার সাধারণ ক্রেতারা। কৃষকরা জানায়, এবার চালের উৎপাদন খরচ একটু বেশি পড়েছে। অর্থাৎ প্রতি কেজি ৪৬ টাকা। এর ওপর বাজারজাত ও মুনাফা খরচ ১৫ শতাংশ যোগ করা হলে প্রতিকেজি চালের মূল্য দাঁড়ায় ৫৩ টাকা।

সেখানে চালের মূল্য মান ভেদে ৭৫ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ সম্পূর্ণ ব্যবসায়ীদের কারসাজি ছাড়া আর কিছু নয়। আমনের রেশ এখন ও কাটেনি। তারপর ও চালের মূল্য বৃদ্ধিতে দেশবাসী বিস্মিত হয়েছে। জাতীয়ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ দপ্তর বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় অভিযান পরিচালনা করছে কিন্তু কাজের কাজ কিচ্ছু হচ্ছে না।

দেশের বাজারে হঠাৎ করে চালের দাম বেড়ে যায়। এর জন্য মজুতদারীকে দায়ী করে সরকার চাল আমদানির ঘোষণা দিয়েছে। বাজারভেদে গত এক মাসে চিকন চালের দাম বেড়েছে ৫ টাকা থেকে ৭ টাকা এবং মোটা চালের দাম দুই থেকে ৩ টাকা বেড়েছে। কৃষিবিপণন অধিদপ্তরের তথ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, ব্রিধান-২৮ এর মতো মধ্যম মানের চাল পাইকারি বাজারে কেজি প্রতি ৪৮ থেকে ৫৪ টাকা এবং খুচরা বাজারে ৫২ থেকে ৫৮ টাকা বিক্রি হচ্ছে। যদিও বাজারে ৬০ টাকার নীচে ব্রি-২৮ বা ২৯ পাওয়া যাচ্ছে না। চাল কল মালিক ও ব্যবসায়ীরা বিভিন্নভাবে ধান সংগ্রহ সংরক্ষণ করছে বিধায় বাজারে চালের সরবরাহ কমে গেছে। মিল গেটে ইচ্ছামতো চালের দাম বাড়ানো হচ্ছে। করপোরেট হাউসগুলোর দৌরাত্ম্য বেশি দেখা যাচ্ছে। এর সাথে যোগ দিয়েছে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা এবং ছোট ও মাঝারি মিল মালিকরা। এরা বিভিন্নভাবে যোগসাজস করে চালের মূল্য বাড়িয়ে দিয়ে ব্যবসার নির্মল পরিবেশটা কলুষিত করছে।

চালের মূল্যবৃদ্ধির কারণ চালের উৎপাদন কম হয়েছে। বন্যার কারণে আউশ ধানের উৎপাদন মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। সাথে সাথে আমনের উৎপাদনও ভাল হয়নি। আগের তুলনায় আমনের আবাদী এলাকা মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। আর যথা সময় বীজতলা তৈরি না করতে পারায় ধানের ফলন কম হয়েছে। সূত্রমতে, এবার আউশ ও আমন মিলে উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৮০ লাখ টন চাল। আমন ও আউশ মিলে মোট উৎপাদনের ৪৬ শতাংশ চাল সরবরাহ করা হয়। তার আগে অর্থাৎ গত বছর মে-জুনে বোরো মওসুমে উৎপাদনকৃত চালের পরিমাণ ২ কোটি ৬ লাখ টন। ২০২৪ সালে উৎপাদন দাঁড়ায় ৩ কোটি ৮৬ লাখ টন। বছরে আমাদের দেশে খাদ্য চাহিদা রয়েছে ৩ কোটি ৭০ লাখ টন। কৃষক, ভোক্তা, ও ব্যবসায়ীদের কাছে ১০ শতাংশ মজুদ আছে। বর্তমানে সরকারি গুদামে চালের মজুদ মাত্র ৮ লাখ টন। চালের ঘাটতি বিবেচনায় নিয়ে সরকার চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শুল্কহার কমিয়ে আমদানি উৎসাহিত করা হয়েছে। এর বিপরীতে সাড়া পওয়া গেছে কম। অন্তর্বর্তী নতুন সরকার চালের দাম কমাতে আমদানি শুল্ক অনেকটাই কমিয়েছে। সরকারিভাবে চাল ক্রয়ের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু দাম নিয়ন্ত্রণে আসেনি। কারণ, আমদানি ততটা হয়নি। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, গত ১ জুলাই থেকে ২রা জানুয়ারি পর্যন্ত লাখ ১৭ হাজার টন চাল আমদানি হয়েছে। বেসরকারি খাতে যতেষ্ট পরিমাণ চাল আমদানি না হওয়ার কারণ মার্কিন ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় চাল আমদানি খরচ বেশি পড়ছে। সরকার নিজস্ব উদ্যোগে ভিয়েতনাম, ভারত, পাকিস্তান ও মিয়ানমার থেকে চাল আমদানির চেষ্টা চলছে।

চলতি বছর ৮ই জানুয়ারি পর্যন্ত ১ লাখ ৪১ হাজার টন আমদানি হয়েছে। আন্তর্জাতিক বজারে ডলারের দাম বৃদ্ধি এবং ডলারের অবমূল্যায়ন চাল আমদানির খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে। বর্তমানে প্রতিটন চাল আমদানির মূল্য কমবেশি ৫০০ ডলার। তাতে প্রতি কেজি চাল আমদানিতে প্রায় ৬১ টাকা ব্যয় হয়। এর সঙ্গে পরিবহন খরচও আমদানিকারকদের মুনাফা খরচ যোগ করে দেশের অভ্যন্তরে খুচরা পর্যায়ে চালের দাম প্রতি কেজি ৬৫ টাকার ওপরে। ফলে বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানিতে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। এ সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা অযাচিত মুনাফা নেওয়ার চেষ্টা করছে। এ মুহূর্তে দেশে চালের কোন সংকট নেই। উৎপাদন মৌসুম কেবল শেষ হয়েছে। ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারি পর্যায়ে গমসহ মোট খাদ্যশস্য মজুদ আছে ১২.২৫ লাখ টন। আমন চাল সংগ্রহ করা হয়েছে ২.৬৩ লাখ টন। ধান সংগ্রহ করা হয়েছে ৯ হাজার ৭৪১ টন।

সরকার হয়তবা চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবে কিন্তু ধান সংগ্রহের লক্ষ্য মাত্রা অর্জন করতে পারবে না। ৩.৫ লাখ টন ধান সংগ্রহের সিকিভাগ পূরণ হবে না। কারণ ধান তোলার সাথে সাথে কৃষকরা ধান বিক্রি করে দিয়েছে চাতাল মালিক ও বড় বড় করপোরেট মালিকদের কাছে। এখন বাজার উদ্বৃত্ত ধান সবই বড় ব্যবসায়ী ও চাতাল মালিকদের হাতে কুক্ষিগত। এরাই সরকার কে চাল সরবরাহ করছে, বাজারে চাল পাঠাচ্ছে এবং তারা এককভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। মূল্য নির্ধারণ করছে এবং মূল্য বৃদ্ধিতে কারসাজি করছে। সরকার নির্ধারিত ১৩২০ টাকা দর কৃষকরা কখনই পায় না। পরে যখন মোকামে ধানের দাম বাড়ে তখন কৃষকের হাতে উদ্বৃত্ত থাকে না। তাই চালের দাম বেশি বাড়লে এর ভাগিদার কৃষকরা হন না। এর ফায়দা লোটে অসাধু ব্যবসায়ীরা। গত নভেন্বরে এ দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৩.৮ শতাংশ। ডিসেম্বরে তা নেমে এসেছে ১২.৯২ শতাংশে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে পর্যাপ্ত উৎপাদন না হওয়া, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, মুদ্রামান হ্রাস, বিদেশি মুদ্রা হ্রাসের কারণে অপ্রতুল আমদানি এবং বৈশ্বিক উচ্চমূল্য আমাদের দেশে উচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতির মূল কারণ। গত অর্থ বছরের আগের বছর চাল আমদানি করা হয়ে ছিল প্রায় সাড়ে দশ লাখ টন। তার আগের বছরে ও ১০ লাখ টন চাল আমদানি করা হয়ে ছিল। এ বার ও চাল আমদানি করা প্রয়োজন ১০ লাখ টন। অভ্যন্তরীণ মজুদ বাড়ানো খুবই প্রয়োজন। কমপক্ষে ২৫ লাখ টন চাল মজুদ গড়ে না তুলতে পারলে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব নয়।

চালের মূল্য স্বাভাবিক রাখতে আমাদের ধানের উৎপাদন বাড়াতে হবে। সামনে বোরো মৌসুম এ দেশে ৫৪ শতাংশ চাউল বোরো মওসুমে সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। তবে ধান সেচ নির্ভর। জ¦ালানি তেলের দাম এখনও বেশি। সম্প্রতি জ¦ালানি তেলের মূল্য লিটার প্রতি এক টাকা বেড়েছে। ৬৫ শতাংশ নির্ভর করে জ¦ালানি তেলের ওপর। এখানে ভর্তুকি দেওয়া প্রয়োজন। কৃষকদের নগদ সহায়তা প্রদান করা দরকার। কৃষি উপকরণ পর্যাপ্ত সার নিশ্চিত করতে হবে। গ্যাস সংকটের কারণে কারখানাগুলো উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের আমদানি নির্ভরতা বাড়ছে। ২০১০ সালে বাংলাদেশের মোট খাদ্য চাহিদার ৯.৩ শতাংশ মেটানো হত আমদানির মাধ্যমে। ২০২২ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১২.২ শতাংশ। এরপর আমদানি কমেছে মূলত বিদেশি মুদ্রার সরবরাহ সংকটের কারণে। উচ্চমূল্যস্ফীতির চাপে জর্জরিত স্বল্প আয়ের মানুষের জীবন যাত্রার ব্যয় কমাতে এবং খাদ্যশস্যে মজুদ বাড়ানো প্রয়োজন।

লেখক : সাংবাদিক।