জাফর আহমাদ

সারা পৃথিবীর মানুষ যদি একত্র হয়ে কারও ক্ষতি করতে চায়, আল্লাহ না চাইলে পারবেন না। বিপরীত দিকে দুনিয়ার সব শক্তি একত্র হয়ে যদি কারও উপকার করতে চায় তবুুও আল্লাহ না চাইলে কিছুই করতে পারবে না। আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘আল্লাহ মানুষের জন্য যে রহমতের দরজা খুলে দেন তা রুদ্ধ করার কেউ নেই এবং যা তিনি রুদ্ধ করে দেন তা আল্লাহর পরে আর কেউ খোলার নেই। তিনি পরাক্রমশালী ও জ্ঞানী।’ (সুরা ফাতির : ১) হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, কোনো এক সময় আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) এর পেছনে ছিলাম। তিনি বললেন: হে তরুণ! আমি তোমাকে কয়েকটি কথা শিখিয়ে দিচ্ছি- তুমি আল্লাহ তা’আলার (বিধি-নিষেধের) রক্ষা করবে, আল্লাহ তা’আলা তোমাকে রক্ষা করবেন। তুমি আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টির প্রতি লক্ষ্য রাখবে, আল্লাহ তা’আলাকে তুমি কাছে পাবে। তোমার কোনো কিছু চাওয়ার প্রয়োজন হলে আল্লাহ তা’আলার নিকট চাও, আর সাহায্য-প্রার্থনা করতে হলে আল্লাহ তা’আলার নিকটেই কর।

আর জেনে রাখো, যদি সকল উম্মতও তোমার কোনো উপকারের উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হয় তাহলে ততটুকু উপকারই করতে পারবে, যতটুকু আল্লাহ তা’আলা তোমার জন্যে লিখে রেখেছেন। অন্যদিকে যদি সকল ক্ষতিই করতে সক্ষম হবে, যতটুকু আল্লাহ তা’আলা তোমার তাকদিরে লিখে রেখেছেন। কলম তুলে নেয়া হয়েছে এবং লিখিত কাগজসমূহও শুকিয়ে গেছে। (তিরমিযি: ২৫১৬, কিতাবুস সিফাতিল কিয়ামাহ ওয়ার রিকাক... পরিচ্ছদ, ৫৯, আবু ঈসা বলেছেন হাদীসটি হাসান ও সহীহ, মিশকাত: ৫৩০২)

মুগীরাহ (রহ:) আবু সুফইয়ানের পুত্র মু’আবিয়াহ (রা:)-এর নিকট এক পত্রে লিখেন যে, নবী (সা:) প্রত্যেক সালাতে সালাম ফিরানোর পর বলতেন: আল্লাহ ব্যতীত আর কোনো মা’বুদ নেই। তিনি একক। তাঁর কোনো শরিক নেই। মূলক তাঁরই, প্রশংসা তাঁরই। তিনি সব কিছুর ওপর সর্বশক্তিমান। হে আল্লাহ! আপনি কাউকে যা দান করেন তাতে বাধা দেয়ার কেউ নেই। আর আপনি যাকে কোনো কিছু দিতে বিরত থাকেন তাকে তা দেয়ার মতো কেউ নেই। ধনীর ধন তাকে তোমার হতে উপকার দিতে পারে না। (বুখারী: ৬৩৩০, ৮৪৪ কিতাবুল দা’ওয়াত, বাবু দুয়ায়ি বা’দাস সালাত, আ.প্র. ৫৮৮৫, ইফা:৫৭৭৮)

মানুষ মনে করে, আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে কেউ তাদের রিযিকদাতা, কেউ সন্তানদাতা এবং কেউ রোগ নিরাময়কারী। কিন্তু এ ধারণা একবারেই ভিত্তিহীন এবং নির্ভেজাল সত্য শুধুমাত্র এতটুকু যে, বান্দাদের কাছে যে ধরনের রহমতই আসে নিছক মহান ও মহিমান্বিত আল্লাহর অনুগ্রহেই আসে। অন্য কারওএ রহমত দান করার ক্ষমত্ওা নেইও এবং রোধ করার শক্তিও কারওনেই। এ বিষয়টি কুরআন মাজীদ ও হাদীসের বহু স্থানে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এভাবে মানুষ দ্বারে দ্বারে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বেড়াবার এবং সবার কাছে হাত পাতার গ্লানি থেকে রেহাই পাবে। এ সংগে সে এ বিষয়টিও ভালভাবে বুঝে নেবে যে, তার ভাগ্য ভাংগা গড়া এক আল্লাহ ছাড়া আর কারওইখতিয়ারে নেই। কারণ মহান আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী অর্থাৎ তিনি সবার ওপর প্রাধান্য বিস্তারকারী ও পূর্ণ সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধিকারী। তার সিদ্ধান্ত প্রয়োগ করার পথে কেউ বাধা দিতে পারে না। এছাড়া তিনি মহাজ্ঞানীও বটে। যে ফায়সালাই তিনি করেন পুরোপুরি জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ভিত্তিতেই করেন। কাউকে দিলে সেটিই জ্ঞান ও প্রজ্ঞার বলেই দেন এবং কাউকে না দিলে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার দাবি বলেই দেন না।

সুতরাং বিপদের-আপদে আল্লাহর ওপর ভরসা ও বিশ্বাস রাখা উচিত। যার যা প্রয়োজন, তা মহান দাতা, মহান প্রভু, মহান তত্ত্বাবধায়ক, মহান বন্ধু আল্লাহ তা’আলার কাছেই চাওয়া উচিত। আল্লাহ তা’আলা মহত্তম বন্ধু ও প্রেমময়। তিনি আল ওয়াদুদ। তিনি নিজের সৃষ্টির প্রতি কোনো শুত্রুতা পোষণ করেন না। অযথা তাদের শাস্তি দেয়া তাঁর কাজ নয়। বরং নিজের সৃষ্টিকে তিনি ভালবাসেন। তাকে তিনি কেবল তখনই শাস্তির ব্যবস্থা করেন যখন সে বিদ্রোহাত্মক আচরণ করা থেকে বিরত হয় না। যে বান্দারা নিজেদের নশ্বর জীবনকে তাঁর জন্য বিসর্জন দেয়, তাদের জীবনের মর্যাদা কত উন্নিত হতে পারে ভেবে দেখার দাবি রাখে। পার্থিব জীবনের যে ক্ষণস্থায়ী যুলুম-নির্যাতনকে তার প্রিয় বান্দারা হাসি মুখে বরদাশত করে, আল্লাহর এক ফোটা স্নেহ, মমতা ও প্রীতির সামনে তা যে কত তুচ্ছ ও নগন্য, বলে বুঝানো কঠিন। দুনিয়ার কোনো মানুষের গোলাম বা চাকর মনিবের মুখ থেকে একটি অতি ক্ষুদ্র উৎসাহবর্ধক বাক্য নির্গত হলে কিংবা তার মুখে বিন্দুমাত্র সন্তোষের লক্ষ ফুটে উঠলে তার জন্য জীবন বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত হয়ে যায়। অথচ সে আল্লাহর একজন বান্দা এবং তারাও তাঁরই বান্দা। তাহলে আল্লাহ মমতাময় ব্যাপারটির চিন্তা কতদুর পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারবো। অফুরন্ত ও সীমাহীন এ মমতা।

আল্লাহ তা’আলা মানুষের বিপদেরও বন্ধু। কারণ তিনি ওয়াকীল বা মহাপ্রতিনিধি, তত্ত্বাবধায়ক। আল্লাহ তা’আলা বলেন: ‘আর যাদেরকে লোকেরা বললো: ‘তোমাদের বিরুদ্ধে বিরাট সেনা সমাবেশ ঘটেছে। তাদেরকে ভয় করো।’ তা শুনে তাদের ঈমান আরো বেড়ে গেছে এবং তারা জবাবে বলেছে: ‘আমাদের জন্য আল্লাহ যতে’ এবং তিনি সবচেয়ে ভালো তত্ত্বাবধায়ক।’ (ইমরান : ১৭৩) এ তো আল্লাহ তোমাদের রব! তিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ্ নেই। সবকিছুর তিনিই সৃ’া। কাজেই তাঁর বন্দেগি করো। তিনি সব কিছুর তত্ত্বাবধায়ক।’ (আনয়াম ১০২) ওহোদ থেকে ফেরার পথে আবু সুফিয়ান মুসলমানদের চ্যালেঞ্জ দিয়ে গিয়েছিল, আগামী বছর বদর প্রান্তরে আমাদের সাথে তোমাদের আবার মোকাবিলা হবে। কিন্তু নির্ধারিত সময় এগিয়ে এলে আর তার সাহসে কুলালো না। তাই সে মান বাঁচাবার জন্য একটি কৌশল অবলম্বন করলো। গোপনে এক ব্যক্তিকে মদীনায় পাঠিয়ে দিল। সে মদীনায় পৌঁছে মুসলমানদের মধ্যে এ খবর ছড়াতে লাগলো যে, এ বছর কুরাইশরা বিরাট প্রস্তুতি নিয়েছে। তারা এত বড় সেনাবাহিনী তৈরী করছে যার মোকাবেলা করার সাধ্য আরবের কারওনেই। এ ঘোষণার পর রাসুলের (সা:) দৃঢ়তায় মুসলমানদের ঈমান আরো বেড়ে গেল। পনেরো শত প্রাণ উৎসর্গকারী মুজাহিদ বদরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। তারা বলে উঠলো আমাদের জন্য আল্লাহই যতে’ এবং তিনি সবচেয়ে ভালো তত্ত্বাবধায়ক। ঠিকই নবী (সা:) তাঁদের নিয়ে বদরে হাজির হলেন। ওদিকে আবু সুফিয়ান দু’হাজার সৈন্য নিয়ে এগিয়ে আসতে থাকলো। কিন্তু দুদিন পথ চলার পর সে সাথীদের বললো, এ বছর যুদ্ধ করা সংগত হবে না। আগামী বছর আমরা আসবো। কাজেই নিজের সেনাবাহিনী নিয়ে সে ফিরে গেল। নবী (সা:) আটদিন বদর প্রান্তরে অপেক্ষা করলেন। কাফেররা ফিরে গেছে এ খবর পাওয়ার পর তিনি সংগী-সাথীদের নিয়ে মদীনায় ফিরে আসেন।

আল্লাহ তায়ালা ওয়াসিউ বা মহাবিস্তারক। এটি আল্লাহ তা’আলার ছিফাতি নাম। যা ব্যাপকতার অর্থে ব্যবহৃত হয়। মুলে ‘ওয়াসে’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। কুরআনে সাধারণত তিনটি জায়গায় এ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। এক, যেখানে কোনো একটি মানবগোষ্ঠীর সংকীর্ণমনতা ও সংকীর্ণ চিন্তার উল্লেখ করা হয় এবং আল্লাহ তাদের মতো সংকীর্ণ দৃ’ির অধিকারী নন, এ কথা তাদের জানিয়ে দেবার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। দুই, যেখানে কারওকৃপণতা, সংকীর্ণমনতা এবং স্বল্প সাহস ও হিম্মতের কারণে তাকে তিরস্কার করে মহান আল্লাহ যে উদার হস্ত এবং তার মতো কৃপণ নন, একথা বুঝাবার প্রয়োজন হয়। তিন, যেখানে লোকেরা নিজেদের চিন্তার সীমাবদ্ধতার কারণে আল্লাহর ওপরও এক ধরনের সীমাবদ্ধতা আরোপ করে থাকে। এ ক্ষেত্রে এ কথা জানাবার প্রয়োজন হয়ে পড়ে যে, আল্লাহ তা’আলা সকল প্রকার সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে, তিনি অসীম। তিনি হিসাব ছাড়াই রিযিক দান করেন। সুতরাং বেশী পাওয়ার জন্য অযথা সব আজে-বাজে জায়গায় দৌড়াদৌড়ি বেহুদাই।

আল্লাহ তা’আলা মানুষের প্রতিটি বিষয় সম্পর্কেই জ্ঞাত। প্রতিটি প্রয়োজন, যা ব্যক্তির মনের গহিনে লুপ্ত আছে, যার বহি:প্রকাশ এখনো ঘটেনি, তাও আল্লাহ তা’আলা জানেন। কারণ তিনি মহাজ্ঞানী, অতিশয় জ্ঞাত। তিনি অনুমান ও ধারণার ভিত্তিতে কোনো কথা বলেন না, বরং তিনি প্রতিটি বস্তু সম্পর্কেই সরাসরি জ্ঞানের অধিকারী। তিনিই একমাত্র জানেন কোনো জিনিষে মানুষের উন্নতি এবং মানুষের কল্যাণের জন্য কোনো নীতিমালা, আইন-কানুন ও বিধি-নিষেধ আবশ্যক। তাঁর প্রতিটি শিক্ষা সঠিক কৌশল ও জ্ঞানভিত্তিক যার মধ্যে ভুল-ভ্রান্তির কোনো সম্ভবনা নেই। ‘অবশ্যই আল্লাহ অন্তরের গোপন কথাও জানেন।’ (লুকমান : ২৩) তিনি আলিমুম বিজাতিছ ছুদুর ও আল্লামুল গুয়ুব। যিনি গোপন সত্যের জ্ঞান রাখেন। (বিভিন্ন অনুগ্রহের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে) আল্লাহ যখন বলবেন, ‘হে মারয়াম পুত্র ঈসা! তুমি কি লোকদের বলেছিলে, ‘আল্লাহকে বাদ দিয়ে আমাকে ও আমার মাকে ইলাহ হিসেবে গ্রহণ করো ?’ তখন সে জবাব দেবে, ‘সুবহানাল্লাহ! যে কথা বলার কোনো অধিকার আমার ছিল না সে ধরনের কোনো কথা বলা আমার জন্য অশোভন ও অসংগত। যদি আমি এমন কথা বলতাম তাহলে আপনি নিশ্চয়ই তা জানতে পারতেন, আমার মনে যা আছে আপনি জানেন কিন্তু আপনার মনে যা আছে আমি তা জানি না, আপনি তো সমস্ত গোপন সত্যের জ্ঞান রাখেন। (মায়েদা : ১১৬) আল্লাহ আলিমুল গায়িব সকল প্রকার অদৃশ্য বস্তুর জ্ঞান তিনি রাখেন। হযরত ঈসার (আ:) জবাব থেকেই এর সুষ্পষ্ট ধারণা আমরা পাই। মানুষের মনের অন্ধকার কুঠুরিতে কী আছে, আল্লাহর কাছে তা দিবালোকের মতোই সুস্পষ্ট।

লেখক : ব্যাংকার