আসিফ আরসালান
ইরানে আমেরিকা ও ইসরাইলের সামরিক অভিযানের উদ্দেশ্য কি সফল হয়েছে? এর স্পষ্ট উত্তর হলো ‘না’। কারণ মার্কিন-ইসরাইলি হামলার উদ্দেশ্য ছিলো দ্বিবিধ। প্রথমটি হলো অবশ্যই রেজিম চেঞ্জ। অর্থাৎ ইরানের বর্তমান সরকারের পরিবর্তন এবং আমেরিকার একটি তাবেদার সরকারকে বসানো। এ উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়েছে। কারণ ইরানের সুপ্রিম লিডার আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে হত্যার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। ইরানের শীর্ষ স্থানীয় সামরিক নেতৃবৃন্দ এবং শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যার পর হানাদারদের টার্গেট ছিলেন আলী খামেনি। আলী খামেনি এবং তাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেটি বুঝতে পেরেছিলো। তাই হামলার দ্বিতীয় কী তৃতীয় দিনে তিনি এমন একটি বাঙ্কারে আশ্রয় নিয়েছিলেন যেটি ভূগর্ভের অনেক নীচে এবং তার ওপর এবং চার ধার লোহা এবং ইস্পাত দিয়ে মোড়ানো।
দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিলো, ইরানের পারমাণবিক শক্তি এমনভাবে ধ্বংস করে দেয়া যাতে করে আগামী ৩/৪ দশকে পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রচেষ্টা থেকে ইরান বিরত থাকতে বাধ্য হয়। দ্বিতীয় উদ্দেশ্যও সফল হয়নি। কারণ আলী খামেনি ১৩ জুন ইসরাইলের প্রথম হামলার পূর্বেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, ইসরাইল হোক আর আমেরিকা হোক, উভয় দেশই ইরানের সামরিক শক্তির সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে। তাই তিনি ১৩ জুন ইসরাইলের হামলার পূর্বেই ফের্দো, নাতাঞ্জ এবং ইসফাহান থেকে পারমাণবিক বোমা (যদি ইতোমধ্যেই তৈরি হয়ে থাকে) অথবা বোমা তৈরির উপকরণ অর্থাৎ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম এবং সেন্ট্রিফিউজ পূর্বাহ্নেই সরিয়ে ফেলেছিলেন। এএফপি, রয়টার্স প্রভৃতি বিশ্বখ্যাত নিউজ এজেন্সির সংবাদদাতারা বলছেন যে, ঐ ৩টি শহর অর্থাৎ ফের্দো, নাতাঞ্জ এবং ইসফাহানে সাংবাদিকদেরকে ওসবের ধারে পাশেও যেতে দেওয়া হচ্ছে না। তাই ঐ ৩টি স্থানে মার্কিন হামলায় কী পরিমান ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সেটি নিরূপন করাও সম্ভব হচ্ছে না।
তবে মার্কিন হামলার ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে খোদ মার্কিন প্রশাসনেই দু’রকম মতামত রয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সুরে সুর মিলিয়ে মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা বা সিআইএ বলছে যে, মার্কিন হামলায় ইরানের পারমাণবিক বোমা বানানোর সম্ভাবনা সম্পূর্ণ বিনষ্ট করা হয়েছে। আগামী কয়েক বছরে তারা আর এ দিকটি বিবেচনা করার সাহস পাবে না। পক্ষান্তরে তুলশি গ্যাবার্ট যেসব গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক তারা বলছেন যে, ইরান আণবিক বোমা তৈরির উদ্দেশ্যে বিপুল পরিমাণ ইউরেনিয়াম সংগ্রহ করেছিলো, এ কথা যেমন সত্য, তেমনি একথাও সত্য যে তারা ঐসব ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের কাজে অনেক দূর এগিয়েও গিয়েছিলো। কিন্তু বোমা বানানোর কাজ থেকে তারা বেশ কয়েক বছর দূরে ছিলো।
এটা অনেকটা আমেরিকার ইরাক আক্রমণের মতো। ইরাক আক্রমণের পূর্বে সিআইএ তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশকে এ মর্মে রিপোর্ট করে যে ইরাক ইতোমধ্যেই গণবিধ্বংসী অস্ত্র করায়াত্ত করেছে। ইরাক যাতে এসব অস্ত্র তার শত্রু বিশেষ করে ইসরাইলের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে না পারে তার জন্য এখনই দেশটির ওপর হামলা করে দেশটিকে পদানত করতে হবে। পক্ষান্তরে আমেরিকার অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা বলেছিলো যে ইরাকের হাতে গণবিধ্বংসী কোনো অস্ত্র নেই। এছাড়া জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থা যাদের পারমাণবিক স্থাপনা পরিদর্শন করার অধিকার আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী রয়েছে তারাও বলেন যে, তারা ইরাকে কথিত গণবিধ্বংসী কারখানা এবং এলাকা পরিদর্শন করেছেন। কিন্তু কোনো বিধ্বংসী অস্ত্রের আলামত পাননি। ইরাকে হামলা করার পর দেশটি যখন আমেরিকার পদানত হলো তখন খোদ মার্কিনীরাই গণবিধ্বংসী অস্ত্রের সন্ধানে সে স্থানসমূহ পরিদর্শন করে এবং গণবিধ্বংসী অস্ত্রের কোনো আলামত তারা দেখতে পাননি। মাঝখানে ভুয়া তথ্যের ভিত্তিতে আমেরিকা ইরাক দখল করে এবং ইরাকের বিপুল তেল সম্পদ লুন্ঠন করে। আমেরিকা বাগদাদে যে পুতুল সরকার বসায় তারাও অনুসন্ধান করে গণবিধ্বংসী অস্ত্র পাননি। মাঝখানে ইরাকের মতো একটি শক্তিমান ও সমৃদ্ধশালী দেশ আজ আমেরিকার পুতুল এবং তাদের সাধারণ জনগণ অনেক গরীব হয়ে গেছেন। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন যে, ইরাকে যে উল্লেখিত মরণাস্ত্র নেই সেটা জেনেশুনেই আমেরিকা ইরাক হামলা করে। উদ্দেশ্য ছিলো ইরাকের সম্পদ লুন্ঠন। ইরানের ব্যাপারেও মনে হচ্ছে ইরাকের ফর্মূলাই ফলো করছে আমেরিকা। পারমাণবিক বোমার জিগির তুলে আমেরিকা ইরানকে কব্জা করতে চেয়েছিলো। তবে ইরান ইরাক নয়। আর আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিও সাদ্দাম হোসেন নন।
আমেরিকাকে বাদ দিয়ে এ যুদ্ধ যদি ইসরাইল ও ইরানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো তাহলে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে ইসরাইল সুনিশ্চিতভাবেই পরাজয় বরণ করতো। একথা বলার পরেও বলবো যে ইরান প্রথম দিন যে ৯ জন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা এবং ৯ জন মতান্তরে ১৪ জন শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানীকে হারিয়েছে সেটি তাদের নিজেদের চরম দুর্বল গোয়েন্দা সংস্থার কারণে। কারণ ইসরাইলের তুলনায় ইরান অন্তত ৭৬ গুণ আয়তনে বড় হলেও এ বিশাল দেশটির এখানে-ওখানে ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের স্পাই অপারেটররা প্রশাসন ও সমাজের বিভিন্ন স্তরে ঘাপটি মেরে বসেছিলো। তারা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো। তা না হলে এক রাতে অন্তত ১৮ জন সামরিক অফিসার ও বিজ্ঞানীকে হত্যা করা সম্ভব হতো না। আর এ হত্যাকাণ্ডগুলোও ছিলো প্রেসিশন (Precision) এ্যাটাক। যেসব সেনা অফিসার ১৩ জুন রাত্রে নিহত হয়েছেন তারা হলেন, এ হামলায় নিহত হয়েছেন ইরানের সেনাবাহিনীর উপপ্রধান মেজর জেনারেল গোলাম আলী রশিদ, মেজর জেনারেল আলী সামদানি, ইরানের বিপ্লবী গার্ডের বিদেশী শাখার প্রধান সাঈদ ইজাদি, আল কুদসের বেনহাম শাহারিয়ার, ইসলামী বিপ্লবী গার্ডের প্রধান মেজর জেনারেল, ইরানি সশস্ত্র বাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল বাঘৈরি, মেজর জেনারেল আমীর আলী, হাজী জাদেহ, ইরানের গোয়েন্দা বিভাগের ডেপুটি চিফ জেনারেল গোলাম আমীরজা মেহেরাবী।
এছাড়া প্রথম রাতেই হত্যা করা হয়েছে ইরানের ৯ জন পরমাণু বিজ্ঞানীকে (মতান্তরে ১৪ জন)। এরা হলেন, ফেরদৌন আব্বাসী, মোহাম্মদ মাহাদী, আব্দুল মোতালেবি জাদেহ্, সাঈদ বারি, আহম্মদ রেজা জুলফাগরি দারিয়ানি, আলী বাখৈ ফাক্কানী, আব্দুল হামিদ মিনোসের এবং মনসুর আজগরি। এর আগে হত্যা করা হয়েছিলো ইরানের একজন শীর্ষ স্থানীয় পরমাণু বিজ্ঞানী এবং মধ্য প্রাচ্যের একজন বিশিষ্ট পদার্থ বিজ্ঞানী মোহাম্মদ মেহেদী তেহেরাঞ্চী।
আমেরিকার ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে যে, তারা সে প্রবাদ প্রবচনের মতো ‘গরু মেরে জুতা দানের’ নীতি অনুসরণ করতে যাচ্ছে ইরানের বেলায়। তারা ইরানে যে প্রচণ্ড বিমান হামলা করেছে সে হামলার ঘায়ে মলম লাগানোর মতো ইরানকে ৩০ বিলিয়ন ডলার সাহায্যের লোভ দেখাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন যে, তিনি ইরানের ধ্বংস প্রাপ্ত পারমাণবিক কর্মসূচি পুনরায় শুরু করার জন্য এ অর্থ দেবেন। তবে সে কর্মসূচিতে এমন একটি শর্ত থাকবে যে ঐ পারমাণবিক কর্মসূচি দিয়ে যেন শুধু মাত্র জ¦ালানি বিদ্যুৎ ইত্যাদিই উৎপাদন করা যায়, কোনো বোমা নির্মাণ করা যাবে না। এজন্য যেসব উপকরণ সরবরাহ করা হবে সেসব উপকরণ দিয়ে অস্ত্র বানানো যাবে না।
এখানেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একটি কার্পণ্য করেছেন। তিনি চাচ্ছেন যে, এ কমর্সূচির সমুদয় অর্থ আমেরিকা একা বহন করবে না। তিনি চাইবেন সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কাতার প্রভৃতি ধনী দেশ যেনো আমেরিকার সাথে মিলে এক ধরনের কনসোর্টিয়াম গঠন করে এবং ঐ কননেসার্টিয়াম থেকে ঐ কর্মসূচির খরচ বহন করা হয়। তবে টাকার লোভ দেখিয়ে আলী খামেনী বা ইরানে ইসলামী বিপ্লবের রাহবার ইমাম খোমেইনির যোগ্য শীষ্যদের প্রলুব্ধ করা যাবে না বা যাবেও না।
ইরানের বিপ্লবী জনগণকে এবং ইরানী নেতৃত্বকে বিভ্রান্ত করার জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার স্বভাব সুলভ মিথ্যা কথা বলে যাচ্ছেন। গত ২৬ জুন তিনি বলেছেন যে, আগামী ১ সপ্তাহের মধ্যেই ইরান ও আমেরিকার মধ্যে আলোচনা শুরু হবে। তিনি আরো বলেছেন যে, ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা সম্পূর্ণ নির্মূল করা হয়েছে। বিগত ১২ দিনের যুদ্ধে ইরানের সুপ্রিম ধর্মীয় নেতা আলী খামেনি বাহ্যিকভাবে দৃশ্যপটের বাইরে ছিলেন। কিন্তু ট্রাম্পের এ মিথ্যাচারের পর তিনি প্রকাশ্যে বেরিয়ে এসেছেন এবং জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছেন। তিনি স্পষ্ট বলেছেন যে, আমেরিকার সাথে বৈঠকের কোনো আলাপ-আলোচনা এখনো হয়নি। এছাড়া মার্কিন বোমার আঘাতে ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সবকিছুকে অতিরঞ্জিত করে বর্ণনা করছেন। ট্রাম্পের কথার প্রতিধ্বনি করেছেন তার পররাষ্ট্র মন্ত্রী মার্কো রুবিও এবং ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষ দূত উইটকফ।
তাদের বক্তব্যের উত্তরে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরঘাচি বলেছেন, এসব কথা নেহায়েতই জ¦ল্পনা। তিনি ঐসব কথাকে সিরিয়াসলি না নেয়ার আহ্বান জানান। ইরানের উচ্চ মহলের সাথে সম্পর্কিত একাধিক সূত্র বলেছে যে, মার্কিন হামলার পূর্বে ঐ ৩টি পারমাণবিক স্থাপনা থেকে ৪শ’ কিলোগ্রাম বা ৮৮০ পাউন্ড সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ সাংবাদিকরা বলেছেন, মার্কিন হামলা পারমাণবিক বোমা দ্রুত হস্তগত করার জন্য ইরানের জেদকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। ১৯৬৪ সালে চীন আণবিক বোমা এবং ১৯৬৫ সালে হাইড্রোজেন বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটায়। তখন ভারত মনে করে যে, তার অস্তিত্বের স্বার্থে তারও পারমাণবিক বোমা দরকার। তাই ১৯৭৪ সালে তারা এ্যাটম বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। তখন পাকিস্তান মনে করে যে, তার অস্তিত্বের স্বার্থে তারও পারমাণবিক বোমা দরকার। তাই ১৯৯৮ সালে তারা ঘোষণা করে যে পাকিস্তান আণবিক বোমার অধিকারী। এর মধ্যে সংগোপনে ইসরাইলও পারমাণবিক বোমা বানায়। তখন ইরান মনে করে যে, তার অস্তিত্বের স্বার্থে তারও পারমাণবিক বোমা দরকার। মার্কিন হামলার পর ইরানের পারমাণবিক বোমার অধিকারী হওয়ার কাজ এবার বেগবান হবে বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করে।