‘আমি আমার রাসূলদেরকে সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ এবং হিদায়াত দিয়ে পাঠিয়েছি। তাদের সাথে কিতাব ও মিজান নাজিল করেছি; যাতে মানুষ ইনসাফের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।’ (সূরা হাদিদ : ২৫)
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এবং পূর্ববর্তী নবী-রাসূলদের পৃথিবীতে আগমনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মানবসমাজে ইনসাফ, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা, ইনসাফভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। সুতরাং ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে নিছক রাজনীতি মনে করা ভুল হবে; বরং এটা নবীওয়ালা কাজ। এ কাজে শুধু সমর্থন ব্যক্ত করে বসে থাকা নয় বরং সক্রিয়ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়া ঈমানের অনিবার্য দাবি। কারণ কোন সমাজে যখন ন্যায় ইনসাফ থাকে না, সুশাসন থাকে না, তখন সেখানে জুলুম নির্যাতন বা ফ্যাসিবাদ জেঁকে বসে।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন : “তোমাদের কী হলো, তোমরা আল্লাহর পথে অসহায় নর-নারী ও শিশুদের জন্য লড়বে না, যারা দুর্বলতার কারণে নির্যাতিত হচ্ছে, তারা ফরিয়াদ করছে, হে আমাদের রব! এ জনপদ থেকে আমাদের বের করে নিয়ে যাও, যার অধিবাসীরা জালেম এবং তোমার পক্ষ থেকে আমাদের কোন বন্ধু, অভিভাবক ও সাহায্যকারী তৈরি করে দাও।” (সূরা নিসা : ৭৫)
যারা বলেন, ইসলামে রাজনীতি নেই তারা মহান আল্লাহর এ নির্দেশ সম্পর্কে কী বলবেন? এখানে তো জালেমের জুলুম নির্যাতন থেকে মজলুমদের রক্ষা করার জন্য জোরালো নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মানবতার জন্য সংগ্রাম করা যদি রাজনীতি হয় তাহলে ইসলামে অবশ্যই রাজনীতি আছে। এমন রাজনীতি অতীতের নবী রাসুলগণও করে গেছেন, তাদের অনুসারীরাও করেছেন। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে: “এর আগে এমন অনেক নবী চলে গেছে যাদের সাথে মিলে বহু আল্লাহওয়ালা লড়াই করেছে। আল্লাহর পথে তাদের ওপর যেসব বিপদ এসেছে তাতে তারা মনমরা ও হতাশ হয়নি। তারা দুর্বলতা দেখানি এবং তারা বাতিলের সামনে মাথানত করেননি। এ ধরনের সবরকারীদেরকে আল্লাহ ভালোবাসেন।” (সূরা আলে ইমরান : ১৪৬) আসলে ইসলাম সম্পর্কে যারা অজ্ঞ তাদের সম্বল হলো মনগড়া কথা বলা। আর এসব মনগড়া বয়ান দিয়ে তারা নিজেদেরকে ও তাদের জাহেল অনুসারীকে বিভ্রান্ত করতে পারলেও সচেতন মুমিনদেরকে বিভ্রান্ত করতে পারে না।
প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত আবুযর গিফারী (রা.) বলেন, একদিন আমি নবীজী (সা.)কে বলেছিলাম, আপনি কি আমাকে প্রাদেশিক গভর্নর বানাবেন? তখন নবীজী হাত দিয়ে আমার বুকে একটা (মৃদু) থাপ্পড় দিয়ে বললেন-আবু যর! তুমি দুর্বল আর এটি আমানত। কিয়ামতের দিন এটি মানুষের লজ্জা ও লাঞ্ছনার কারণ হবে। হাঁ, দায়িত্বটাকে যে ভালোভাবে গ্রহণ করবে এবং অর্পিত দায়িত্বের হক যথাযথ আদায় করবে সে বেঁচে যাবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৮২৫; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, (হাদীস ৩৩২০৭)
সুতরাং ইসলাম শাসনক্ষমতাকে একটি পবিত্র আমানত হিসেবে দেখে এবং একই সাথে এ পবিত্র আমানতকে অসৎ ও অযোগ্য লোকদের হাতে তুলে দেয়াকে দেখে খেয়ানত হিসেবে।
এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের রয়েছে সুস্পষ্ট নির্দেশ: “নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা যাবতীয় আমানতসমূহ সঠিক হকদারদের নিকটে পৌঁছে দাও। আর যখন তোমরা মানুষের মাঝে বিচার ফায়সালা করবে, ন্যায় ও ইনসাফের সাথে সুবিচার করবে। (সূরা নিসা : ৫৮) এ নির্দেশনা বেষ্টিক ও সামষ্টিক সব ক্ষেত্রের জন্যই প্রযোজ্য। অর্থাৎ- একজন মুমিন ব্যক্তিগতভাবে যেমন পারস্পারিক বিষয়ে আমানতদার হবেন তেমনি সামষ্টিক বিষয়েও আমানতদারি রক্ষা করবেন। এ বিষয়টি আল্লাহর রাসূল আরো সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে-হযরত আবু হুরাইরা (রা:) বর্ণনা করেন, একদিন কোন এক মজলিসে রাসূল (সা.) আলোচনা করছিলেন। এমন সময় একজন সাহাবী প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! (সা.) কিয়ামত কখন হবে? রাসূল (সা.) বললেন : যখন আমানতের খিয়ানত করবে তখন তুমি কিয়ামতের অপেক্ষা করো। লোকটি আবারো প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! কিভাবে আমানতের খিয়ানত করা হবে? রাসূল (সা.) বললেন: যখন নেতৃত্ব ও ক্ষমতা অসৎ ও অযোগ্য লোকের হাতে তুলে দেয়া হবে, (আর এটাই আমানতের খিয়ানত) তখন তুমি কিয়ামতের অপেক্ষা করো। (বুখারী শরীফ)
দেখা যাচ্ছে অসৎ লোকদের হাতে শাসন ক্ষমতা তুলে দেয়াকেও আল্লাহর রাসূল সুস্পষ্টভাবে খেয়ানত বলে আখ্যায়িত করেছেন। আর এ খেয়ানতের পরিণতি কী হবে তাও তিনি বলে দিয়েছেন - ‘যখন তোমাদের নেতারা হবে ভালো মানুষ, ধনীরা হবে দানশীল এবং তোমাদের কার্যক্রম চলবে পরামর্শের ভিত্তিতে, তখন মাটির উপরিভাগ নিচের ভাগের চেয়ে উত্তম হবে। আর যখন তোমাদের নেতারা হবে খারাপ লোক, ধনীরা হবে কৃপণ এবং নেতৃত্ব কর্তৃত্ব যাবে নারীদের হাতে; তখন পৃথিবীর উপরের অংশের চেয়ে নিচের অংশ হবে উত্তম।’ (তিরমিজি) সুতরাং শাসন ক্ষমতা যেমন শাসকদের জন্য জনগণের পক্ষ থেকে অর্পিত একটি আমানত, তেমনি শাসক নির্বাচনের ক্ষেত্রে জনগণের ভোটের ক্ষমতাও একটি পবিত্র আমানত। জনগণের দায়িত্ব রয়েছে তাদের ভোটাধিকারকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করার। তাদের ভোটে যদি সৎ লোকেরা ক্ষমতায় যায় তাহলে ন্যায়-ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত হবে আর যদি অসৎ লোকেরা ক্ষমতায় যায় তাহলে দেশে জুলুম ও দুর্নীতি বেড়ে যাবে। তাই এক্ষেত্রে ভোটারদের একটা বিশাল দায় রয়েছে। এ দায়কেই বলা হয় আমানত। প্রত্যেক ভোটারের উচিত এ আমানতের সঠিক প্রয়োগ করা।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককেই (কিয়ামতের দিন) তার দায়িত্ব সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে।-(সহিহ বোখারি ও মুসলিম)
ভোট সাধারণ কোনো ব্যাপার নয়। ভোট দেয়া মানে সাক্ষ্য প্রদান ও সত্যায়ন করা। কাউকে ভোট দেওয়ার অর্থ হলো তার ব্যাপারে এ মর্মে সাক্ষ্য প্রদান করা যে, তিনি সৎ ও যোগ্য। ইসলাম ও দেশের উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা এবং জনগণের অধিকার আদায়ে তিনিই সবচেয়ে উপযুক্ত। প্রার্থী সম্পর্কে জানা-শোনার পরেও অসৎ ব্যক্তিকে ভোট বা সাক্ষ্য দেওয়ার কারণে নির্বাচিত হওয়ার পরবর্তী সময়ে যত অসৎ কর্মকাণ্ড সম্পাদন করবে সেই পাপের অংশে ভোটাররাও শরিক হবে।
পবিত্র কুরআনুল কারীমে মহান আল্লাহ এরশাদ করেন, ‘যে লোক সৎকাজের জন্য কোনো সাক্ষ্য দেবে, তা থেকে সেও একটি অংশ পাবে। আর যে লোক মন্দ কাজের জন্য সুপারিশ করবে, সে তার পাপের একটি অংশ পাবে।’ (সুরা নিসা, আয়াত-৮৫) কুরআনুল কারীমে আরো এরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকো এবং ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্যদান করো, তাতে তোমাদের নিজের কিংবা পিতা-মাতার অথবা নিকটবর্তী আত্মীয়-স্বজনের যদি ক্ষতি হয় তথাপিও।’ (সুরা নিসা, আয়াত-১৩৫) আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরো এরশাদ করেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্যদানের ব্যাপারে অটল থাকবে এবং কোনো সম্প্রদায়ের আক্রোশের কারণে কখনো ন্যায়বিচার পরিত্যাগ করো না।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত-৮) আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কালামে পাকে আরো এরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন যে, যাবতীয় আমানত তার উপযুক্ত লোকদের নিকট অর্পণ করো।’ (সুরা নিসা, আয়াত-৫৮৩)
আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা ইনসাফের সঙ্গে আল্লাহর জন্য সাক্ষী হয়ে দাঁড়াও।’ (সুরা নিসা আয়াত-১৩৫) কুরআনে আরো এরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা জেনেশুনে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সাথে ওয়াদা ভঙ্গ করো না এবং নিজেদের আমানতের খেয়ানত করো না। (সুরা আনফাল, আয়াত-২৭) যোগ্যতার মানদণ্ডে প্রার্থী হবার যোগ্য নয়, ফাসিক, অসৎব্যক্তি যিনি দলীয়ভাবে লবিং অথবা আর্থিকভাবে প্রভাব বিস্তার করে নির্বাচনে পদপ্রার্থী হয়েছেন এমন প্রাতিদ্বন্দ্বীকারী ব্যক্তিকে ভোট দেয়া হারাম। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান থেকে বিরত থাকো।’ (সুরা হজ্ব, আয়াত-৩০) রাসুল (সা.) উম্মতকে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করা থেকে সতর্ক করেছেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘সাবধান! মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া সর্বাপেক্ষা বড় গুনাহ।’ হজরত আয়মান বিন আখরাম (রা.) বলেন, একদিন নবীজি খুতবায় দাঁড়িয়ে বললেন, ‘হে লোক সকল! মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া আর আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করা একই রকম’। (তিরমিযি, হাদিস নং-২২৯৯) হজরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুল (সা.)কে একবার কবীরা গোনাহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলো। তিনি উত্তরে বললেন, ‘আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করা, মাতাপিতার অবাধ্য হওয়া, মানুষ হত্যা করা এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া।’ (বুখারি, হাদিস নং-২৫১০)
বর্তমানে নির্বাচনে টাকার ছড়াছড়ি ও বিভিন্ন প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে অনেক প্রার্থী ভোট সংগ্রহ করেন, যা সম্পূর্ণ হারাম। যেসব পদপ্রার্থী ভোটারদের আপ্যায়নের নামে বিভিন্নভাবে ঘুষ দিয়ে নিজেদের পক্ষে ভোট সংগ্রহ করে ঘুষতন্ত্র চালু করেছেন সেটা ইসলামের দৃষ্টিতে মহাপাপ। আর যেসব ভোটারগণ প্রার্থীদের যোগ্যতা যাচাই-বাছাই না করে স্বজনপ্রীতিমূলক, সাময়িক সম্পর্ক, সস্তা প্রতিশ্রুতি ও ঘুষ খেয়ে ভোট প্রদান করে আমানতের খেয়ানত করার কারণে পরকালে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। তাই সৎ ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রার্থীকে ভোট দেয়া নৈতিক দায়িত্ব।
মহান আল্লাহ পাক ঈমানদারদের উদ্দেশে বলেছেন : হে ঈমানদারগণ! ইনসাফের পতাকাবাহী ও আল্লাহর সাক্ষী হয়ে যাও, তোমাদের ইনসাফ ও সাক্ষ্য তোমাদের নিজেদের অথবা তোমাদের বাপ-মা ও আত্মীয়-স্বজনদের বিরুদ্ধে গেলেও। (সূরা নিসা : ১৩৫)