মো. রিশাদ আহমেদ
ধরুন, এক বিশাল সমুদ্রের মতো আমাদের সমাজ। সমুদ্রের তলে অনেক অদৃশ্য ঢেউ চলে আর আমাদের চোখে যা দৃশ্যমান, তা শুধু তার শীর্ষভাগ। সে অদৃশ্য ঢেউগুলোর মধ্যে একটি হলো দরিদ্রতা। দরিদ্রতা শুধু অর্থের অভাব নয়, এটি জীবনের সম্ভাবনার ঘাটতি, শিক্ষার সীমাবদ্ধতা, স্বাস্থ্যসেবার অভাব এবং কখনও কখনও মানুষের আত্মমর্যাদার ক্ষয়ও বয়ে আনে। এ গভীর, অদৃশ্য সমস্যা মোকাবিলায় আমাদের সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এনজিওগুলো। তারা যেন সে নাবিক, যারা ঝড়ঝাপটে থাকা মানুষের জীবনের নৌকা ঠিক পথে পরিচালনা করছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে দেখা যায়, দারিদ্র্য এখনও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। জাতীয় পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ প্রায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ- দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এ বঞ্চনার ফলে শিশুদের শিক্ষা অসম্পূর্ণ থাকে, স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধি পায়, আর নারীর স্বাধীনতা সীমিত হয়। গ্রামীণ অঞ্চলের মানুষদের জীবনধারা প্রায়ই মৌসুমি কৃষি কাজের ওপর নির্ভরশীল। যখন ফসল ভালো হয়, তখন আয় হয়, আর খারাপ মৌসুমে পুরো পরিবার অনাহারে থাকে। এ অনিশ্চয়তা দরিদ্রতার চক্রকে আরও জটিল করে তোলে।
সমীক্ষা থেকে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এনজিওগুলোর কার্যক্রমে দরিদ্রদের জীবনে প্রকৃত পরিবর্তন এসেছে। উদাহরণস্বরূপ, গ্রামীণ ব্যাংক শুধু অর্থায়নেই সীমাবদ্ধ নয়, তারা ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে মানুষের স্বাবলম্বিতা বৃদ্ধি করেছে। মাইক্রোফিন্যান্সের এ পদ্ধতিতে মানুষ নিজে ব্যবসা শুরু করতে পারছে, যা দরিদ্রতার চক্র ভাঙতে সাহায্য করছে। অন্যদিকে ব্র্যাক, সুন্দরবনের দূরবর্তী অঞ্চলে নারী ও শিশুর শিক্ষা ও স্বাস্থসেবায় সরাসরি কাজ করছে। তাদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে অংশ নেয়া মানুষের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং তাদের জীবনের মানও উন্নত হয়েছে। এ ধরনের উদাহরণ দেখায় যে, এনজিও শুধুমাত্র অর্থ বিতরণ করছে না, বরং সামাজিক ও মানবিক পরিবর্তনও ঘটাচ্ছে। এত দূর পর্যন্ত এনজিওগুলোর সাফল্যের পিছনে প্রধান কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, তারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করে, অর্থাৎ মানুষের জীবনের প্রেক্ষাপটের সাথে সরাসরি যুক্ত। সরকারের নীতিমালা এবং বড় বড় পরিকল্পনার চেয়ে এ প্রাসঙ্গিকতা অনেক বেশি ফলপ্রসূ। দ্বিতীয়ত, তারা মানুষের প্রয়োজন বুঝতে চেষ্টা করে, তাদের কণ্ঠকে গুরুত্ব দেয় এবং স্থানীয়ভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করে। তৃতীয়ত, এনজিও সাধারণ মানুষকে ক্ষমতায়ন করে। অর্থাৎ তারা শুধু সহায়তা দেয় না, বরং মানুষকে শেখায় কিভাবে নিজের জন্য কাজ করতে হয়, কিভাবে আত্মনির্ভরশীল হতে হয়। কিন্তু সমস্যা শুধুই সম্পদের অভাব নয়। অনেক সময় দরিদ্র মানুষ নিজেই পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত নয়। সংস্কৃতি, সামাজিক বাধা, এবং বিশ্বাসের কারণে তারা সাহায্য গ্রহণ করতে দ্বিধা করে। আবার, কিছু ক্ষেত্রে, এনজিওগুলোর কার্যক্রম দীর্ঘস্থায়ী হয় না। এছাড়া সীমিত পরিসরে অর্থায়ন, প্রশাসনিক জটিলতা এবং স্থানীয় সরকারের সঙ্গে সমন্বয়ের অভাবও কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করে। এসব বাধা মোকাবিলা করা না গেলে দরিদ্র বিমোচনে প্রকৃত পরিবর্তন আনা কঠিন হয়ে যায়।
সমাধানের জন্য প্রথমেই দরকার নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে এনজিওগুলোর সমন্বয়। শুধু এনজিওর ওপর নির্ভরশীল না থেকে, সরকারি প্রকল্পের সঙ্গে সমন্বিতভাবে দরিদ্র বিমোচনের কার্যক্রম চালানো উচিত। দ্বিতীয়ত, দরিদ্রদের সচেতনতা বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ বুঝতে পারবে, সাহায্য গ্রহণের মাধ্যমে তারা কীভাবে স্বাবলম্বী হতে পারে। তৃতীয়ত, এনজিওর কার্যক্রমকে আরও দীর্ঘমেয়াদি এবং টেকসই করতে হবে। অর্থাৎ শুধু ক্ষুদ্র ঋণ বা সাময়িক সহায়তা নয়, বরং মানুষের আয়-উন্নয়ন, শিক্ষার সুযোগ, এবং স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। চতুর্থত, নারীর ক্ষমতায়নকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। সমাজে নারীর অবস্থান উন্নত হলে পুরো পরিবার এবং সম্প্রদায়ের জীবনমানও উন্নত হয়। এনজিওর কার্যক্রমকে আরও মানবিক ও প্রভাবশালী করতে পারে স্থানীয় মানুষের অংশগ্রহণ। প্রকল্পের পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন এবং মূল্যায়নে স্থানীয়দের অন্তর্ভুক্ত করলে কার্যক্রমের প্রভাব স্থায়ী হয়। এছাড়া প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষকে আরও স্বল্প সময়ে সহায়তা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, মোবাইল ব্যাংকিং বা ডিজিটাল প্রশিক্ষণ কার্যক্রম দরিদ্রদের দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে। মতামত হিসেবে বলা যায়, দারিদ্র্য বিমোচনে এনজিওর ভূমিকা অনস্বীকার্য। তারা সমাজের সে অংশে পৌঁছায়, যেখানে সরকার বা বড় প্রতিষ্ঠান পৌঁছাতে পারে না। তবে শুধু সহায়তা দেওয়াই যথেষ্ট নয়; দরকার মানসিক, সামাজিক, এবং সাংগঠনিক পরিবর্তনও। সমাজের শক্তিশালী অংশকে সাথে নিয়ে, মানুষকে ক্ষমতায়িত করে, এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে এনজিওরা দরিদ্রতার বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে লড়তে পারে। দরিদ্র মানুষের জীবনমান উন্নত করার জন্য এনজিও ও সমাজের সমন্বিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য। আমাদের দায়িত্ব হলো এ প্রচেষ্টা সমর্থন করা এবং দরিদ্রদের তাদের স্বপ্ন পূরণের জন্য সুযোগ তৈরি করা।
অতএব, এনজিওর ভূমিকা কেবল সহায়তার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তারা সামাজিক ন্যায়, মানবিক মর্যাদা এবং সমতার চেতনা প্রতিষ্ঠায় একটি শক্তিশালী সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করছে। দরিদ্রতা বিমোচন শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়, এটি মানুষের সম্ভাবনার মুক্তি, জীবনের মান বৃদ্ধির চাবিকাঠি। সমাজের সকল স্তরের মানুষ যদি এনজিও ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের সাথে সমন্বিতভাবে কাজ করে, তাহলে দরিদ্রতা শুধু একটি অন্ধকার স্মৃতি হয়ে যাবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়