আসিফ আরসালান

ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ না হলেও তার সমস্ত কার্যক্রম দলটির বিচার না হওয়া পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ঐ দিকে দল হিসাবে আওয়ামী লীগের বিচার করার কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে এখন পর্যন্ত জানা যায় নি। আওয়ামী লীগের সমস্ত কার্যকলাপ নিষিদ্ধ হওয়া এবং আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়া বস্তুত একই বিষয়। এখন প্রশ্ন হলো, সংগঠন হিসাবে আওয়ামী লীগের বিচার কবে হবে? প্রশ্নটি এ সময় তোলার অত্যন্ত যৌক্তিক একটি কারণ রয়েছে।

ড. ইউনূস গত ৫ অগাস্ট সরকারিভাবে ঘোষণা দিয়েছেন যে, পবিত্র রমযান মাসের পূর্বেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম ১৫ দিনের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ঐ সময় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে (সিইসি) একটি চিঠিও দিয়েছেন। নির্বাচন সম্পর্কে এ সরকারের সম্ভবত আর কিছু করার নেই। অবশ্য বিরোধী দল এটা নিয়ে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছে। সেসব কথায় একটু পরে আসছি। সিইসি ঐ চিঠি পাওয়ার পর বলেন, ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তারা এখন থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি আরো বলেন, ডিসেম্বরের শেষের দিকে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করা হবে। নির্বাচন কমিশনের এক সদস্য আরেক ডিগ্রি এগিয়ে আছেন। তিনি বলেছেন, চেষ্টা করলে নভেম্বর মাসের শেষের দিকেও নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করা যেতে পারে।

নভেম্বরে হোক আর ডিসেম্বরে হোক, যখন নির্বাচনী তফসিল ঘোষিত হবে তার পর এ সরকারের সমস্ত নির্বাহী ক্ষমতা বলতে গেলে চলে যাবে। সরকার শুধুমাত্র দৈনন্দিন রুটিন কার্যকলাপ চালিয়ে যাবেন। অবশিষ্ট সব কাজ তথা পুলিশ বাহিনীর দায়িত্ব নির্ধারণ, সেনাবাহিনীর দায়িত্ব নির্ধারণ থেকে শুরু করে সব কাজ সিইসিই করবেন। তাই স্বভাবতই প্রশ্ন আসে যে দল হিসাবে আওয়ামী লীগের বিচার যদি করতে হয় তাহলে সে মামলাটি রজু করতে হবে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার আগেই। যদি তফসিল ঘোষণার পূর্বেই দল হিসাবে আওয়ামী লীগের বিচার শুরু না হয় তাহলে ইলেকশন না হওয়া পর্যন্ত এ বিচার আর শুরু হতে পারবে না। তারপরেও কথা আছে। নির্বাচনের পর নতুন যে সরকার আসবে তাদের আদর্শ এবং এজেন্ডা কী হবে এটি এ মুহূর্তে সঠিকভাবে বলা যায় না। যে দলটি ক্ষমতায় যাবে বলে মোটামুটি প্রকাশ্যে বলে বেড়াচ্ছে তারা যে দল হিসাবে আওয়ামী লীগের বিচার করবে সে ব্যাপারে খুব একটা নিশ্চয়তা দেয়া যায় না। কারণ যখন আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি ওঠে তখন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেছিলেন যে, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হবে কিনা, সেটি আমরা ঠিক করার কে? সেটি তো ঠিক করবেন এদেশের জনগণ। কিন্তু এদেশের জনগণ কোন তরিকায় সেটি ঠিক করবেন তা অবশ্য মির্জা ফখরুল বাতালাননি।

সুতরাং আওয়ামী লীগের বিচার যে আপাতত ঝুলে গেলো সেটি মনে হয় নির্ধিদ্বায় বলা যায়। এর মধ্যে অবশ্য একটি ইস্যু আছে যেটি কেউই টাচ করছেন না। বিষয়টি কিছুটা আলোচনা করা দরকার। কিছুদিন আগে হাইকোর্ট সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করেছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ত্রয়োদশ সংশোধনী, অর্থাৎ ১৩ নম্বর সংশোধনী বাতিল হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, পঞ্চদশ সংশোধনীতে শুধুমাত্র ১৩ নম্বর সংশোধনীই ছিলো না। আরো ছিলো কতগুলো রাজনৈতিক বিষয়। যেমন ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সাবেক রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবের ভাষণ পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ঐ ভাষণটিকে সংবিধানের অংশ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পঞ্চদশ সংশোধনীর পঞ্চম তফসিলে শেখ মুজিবের ভাষণটি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে কি শেখ মুজিবের ঐ ভাষণটিও সংশোধন থেকে বাদ হয়ে গেলো?

পঞ্চদশ সংশোধনীর ৭ম তফসিলে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তারিখে মুজিবনগর সরকারের জারিকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এখন এটির সাংবিধানিক স্ট্যাটাস কী? এটি কি এখনো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে? নাকি বাতিল হয়েছে? সংবিধানের ৬ষ্ঠ তফসিলে শেখ মুজিবুর রহমান কর্র্তৃক প্রদত্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাও সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ ঘোষণা মাফিকই বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস হিসাবে পালিত হচ্ছে ২৬ মার্চ। এখন ঐ ৬ষ্ঠ তফসিল অর্থাৎ শেখ মুজিব কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণাটি এখনো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত আছে কিনা। হাইকোর্ট পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করেছে। সম্পূর্ণ নাকি আংশিক সেটি পরিষ্কার নয়। হতে পারে পূর্ণাঙ্গ রায়ে সেটি পরিষ্কার করা হয়েছে। তবে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় পড়ার সুযোগ আমার হয়নি। এদিকে ঐ রায়ের পর বলা হয়েছে, সুপ্রীম কোর্টে অর্থাৎ আপিল বিভাগের পঞ্চদশ সংশোধনীর বিরুদ্ধে একটি অথবা দুইটি রিভিউ পিটিশন রয়েছে। সেগুলোর শুনানি এখন পর্যন্ত হয়নি। তাহলে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল হয়েছে এমন কথা সাংবিধানিকভাবে বা আইনগতভাবে বলা যায় কি? পঞ্চদশ সংশোধনীতে কেয়ারটেকার সরকার বাতিল করা হয়েছে। হাইকোর্টের রায়ে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল হয়েছে। তাহলে কি কেয়ারটেকার সরকার আবার ফিরে আসবে? অথবা এলো? এ মুহূর্তে আসুক, অথবা দুদিন পরেই আসুক, তখন ড. ইউনূসের ইন্টারিম সরকারের স্ট্যাটাস কী হবে? নাকি আসন্ন নির্বাচনের আগে ঐ রিভিউ পিটিশনের শুনানি হবে না? সেটি কি নির্বাচন পর্যন্ত পেন্ডিং থাকবে?

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সমানে ম্যারাথন সেশন করে চলেছেন। এখন আবার কমিশনের কার্যকালের মেয়াদ আরো এক মাস বাড়ানো হয়েছে। এখন ঐকমত্য কমিশনকে তাদের কাজ সম্পন্ন করতে হবে ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে। ঐকমত্য কমিশনে বিএনপির ভূমিকা বর্ণনা প্রসঙ্গে এক পর্যায়ে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন যে, ৫ অগাস্ট ড. ইউনূস কর্তৃক পঠিত জুলাই ঘোষণাপত্র সংবিধানের ৭ম তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। তাহলে এখানে প্রশ্ন ওঠে যে, জুলাই ঘোষণাপত্র যদি সংবিধানের ৭ম তফসিলে অন্তর্ভুক্ত হয় তাহলে বর্তমানে ৭ম তফসিলে যেটি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সেটির কী হবে? সেটি তো ছিলো স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মেহেরপুরের আম্রকানন তথা মুজিব নগরে এ ঘোষণাপত্রটি পঠিত হয়।

১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর বাংলাদেশের প্রথম যে সংবিধানটি গৃহীত হয় এবং যেটি একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর কার্যকর হয় সেই সংবিধানে আলোচ্য ঘোষণাপত্রটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। প্রথম সংবিধান চালু হওয়ার ৩৯ বছর পর ২০১১ সালে পঞ্চম সংশোধনীর মধ্যে এই ৭ম তফসিল তথা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অন্তর্ভুক্ত হয়। এ ঘোষণাপত্রের ইংরেজি যদিও করা হয় Declaration, আসলে এটির সঠিক ইংরেজি হলো Proclamation. তাহলে কি সংবিধানের আসন্ন সংশোধনীতে দুটি Proclamation ই থাকবে? অবশ্য একাধিক Proclamation থাকার নজীর বিরল নয়। তেমনি একাধিকবার স্বাধীনতার ঘোষণাও বিরল নয়।

আমেরিকায় স্বাধীনতার ঘোষণা হয়েছে দুবার। অনুরূপভাবে রিপাবলিক বা প্রজাতন্ত্রের ঘোষণাও একাধিকবার হওয়ার নজীর বিরল নয়। ফ্রান্সে বর্তমানে চলছে ৫ম রিপাবলিক বা প্রজাতন্ত্র। এ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে যেসব রাজনৈতিক দল বাংলাদেশে জুলাই বিপ্লবের পর দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করতে চান এবং জুলাই বিপ্লবকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলেন তারা কোনো ভুল বলেন না।

প্রশ্নগুলো অত্যন্ত জটিল। এর সাথে আবার এসেছে জুলাই সনদ। পাঠকদের উদ্দেশে বলছি, জুলাই ঘোষণাপত্র (প্রোক্লামেশন) এবং জুলাই সনদকে (চার্টার) কেউ যেনো গুলিয়ে না ফেলেন। এখন জুলাই চার্টার নিয়ে যে ম্যারাথন আলোচনা শুরু হয়েছে, যেভাবে কিছু ইস্যুতে ঐকমত্য হয়েছে এবং কিছু ইস্যুতে ঐকমত্য হয়নি, সেগুলোর কী হবে? যেগুলোর ঐকমত্য হয়েছে সেগুলো কিভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে? জুলাই ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে যে আগামীতে যে পার্লামেন্ট আসছে তারা কাজ শুরু করার ২ বছরের মধ্যে ঐগুলো সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করবেন। ড. ইউনূসের এ কথাকে বিএনপি লুফে নিয়েছে।

পক্ষান্তরে জামায়াতে ইসলামী, চরমোনাইয়ের পীর সাহেবের ইসলামী আন্দোলন, এনসিপি প্রভৃতি দল ঐ ২ বছরের ফাঁদে পা দিতে রাজি নয়। তাদের দাবি, নির্বাচনের আগেই জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে। নাহিদ ইসলাম গত ১৩ অগাস্ট বুধবার অত্যন্ত পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, অনেক ছাড় দিয়েছি। আর ছাড় নয়। ১%ও ছাড় নয়। এখানে বলা প্রয়োজন যে স্বয়ং ড. ইউনূস অনেকবার বলেছেন যে, জুলাই সনদের ভিত্তিতে পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিভাবে সেটি সম্ভব? অন্তত ৯টি ইস্যু রয়েছে যেগুলো মৌলিক জাতীয় ইস্যু। অথচ এগুলোতে নোট অব ডিসেন্ট আপত্তি দিয়েছে বিএনপি। বিএনপি বলেছে, এগুলো বাস্তবায়নের দায় তাদের নয়। তাহলে এগুলো কাদের দায়?

আজকের মতো একটি প্রশ্ন রেখে শেষ করছি। বিএনপি মনে করছে, তারা মেজোরিটি পাবে এবং সরকার গঠন করবে। কে মেজোরিটি আর কে মাইনোরিটি হবে সেটি নির্ধারিত হবে ইলেকশনে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বিএনপির ধারণা অনুযায়ী তারা যদি মেজোরিটি পায় তাহলেও তারা যে দু তৃতীয়াংশ মেজোরিটি পাবে তার গ্যারান্টি কী? যদি না পায় তখন কী হবে? ড. আলী রিয়াজ জুলাই সনদের জন্য ১৬৬টি ইস্যু বা পয়েন্ট উত্থাপন করেছেন সেগুলোর মধ্যে যেগুলোতে ঐকমত্য হয়েছে সেগুলোতে জনগণ খুব বেশি আগ্রহী নন। জনগণ আগ্রহী সাংবিধানিক ইস্যুগুলোতে। এ সাংবিধানিক ইস্যুতে অন্তত ৯টি মৌলিক পয়েন্টে ঐকমত্যে পৌঁছা সবগুলো রাজনৈতিক দলের পক্ষে সম্ভব হয় নি। তাহলে কি আদৌ কোনো সংস্কার হবে? একটি সোজা পথ ছিলো গণভোটের মাধ্যমে ঐসব জটিল ইস্যুগুলোর নিষ্পত্তি করা। সেটিতেও বিএনপির আপত্তি। তাহলে বিএনপির একক ডিকটেশনে কি আগামী দিনের সংস্কার, সংশোধন ইত্যাদি হবে? যদি হয় তাহলে জাতীয় ঐক্যের যে কথা ড. ইউনূস বারবার বলছেন সেটি তো সোনার হরিণ হয়ে যায়।