আওয়ামী সরকারের পতন হওয়ার পর নানা ধরনের অপরাধ হঠাৎ করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তার মধ্যে অন্যতম কিশোর গ্যাং। কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা কেন বাড়ছে? সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে দেখা যাবে ফ্যাসিস্ট হাসিনার ল্যাসপেন্সারা নতুন নতুন ইস্যু বানিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিশ্ব নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ইউনূসকে বির্তকিত করা ষড়যন্ত্রের নীল নকশা বাস্তবায়নে কখনো আনসার লীগ, কখনো বিদ্যুৎ লীগ, কখনো রিকশা লীগ, কখনো কিশোর গ্যাং সৃষ্টির মাধ্যমে দেশকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি নতুন তা কিন্তু নয়! অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতার আসার আগেও কিশোর গ্যাং ছিল। ২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় রাজধানীর উত্তরায় কিশোর গ্যাং ডিসকো বয়েজ ও নাইন স্টার গ্রুপ এর আধিপত্যের জেরে স্কুল ছাত্র আদনান কবিরকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা পর সবার চোখে কিশোর গ্যাংয়ের বিষয়টি নজরে আসে। আওয়ামী সরকার ১৬ বছর ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু কিশোর গ্যাং বন্ধে কার্যকরী ভূমিকা পালন করেনি। যদি করতো তাহলে কিশোর গ্যাং এর ভয়াবহতা অনেকাংশেই কমে যেত।

কিশোর শব্দটি শুনতে কার না ভালো লাগে! সবারই ভালো লাগে। কারণ কিশোররাই বিশ্বজয় করে চলেছে। যেখানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস কেউ করে না, সেখানে কিশোর তরুণ তরুণীরা নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিতে কুন্ঠাবোধ করেনি; বরং সত্যের জয়গান গেয়েছেন, যার ভুরি ভুরি উদাহারণ আছে। এ কিশোরদের নিয়ে আল্লামা ইকবাল কত সুন্দর কথাই লিখেছেন- ‘‘আজকের সভ্যতার জমকালো এ জীবন তুমি খুঁজতে যেও না, বিশ্বাসের চূড়ান্ত সীমায় একই পরিতৃপ্তি তুমি পাবে।’’ অথচ চোখের সামনে প্রজাপতির মতো ঘোরে বেড়ানো কিশোর তরুণরা আজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অথচ আমরা কিছুই করতে পারছি না! এ দায় আমাদের, এ দায় আমাদের বিবেকের! আজ না হলেও কোন এক সময় হয়ত আমাদেরকে বিবেকের কাঠগড়ায় আসামীর কাতারে দাঁড়াতে হবে। কারণ মানুষ অপরাধী হয়ে জন্মায় না। সমাজ ও রাষ্ট্র অপরাধী সৃষ্টি করে। অপরাধী বানায়। এ জন্য পরিবার সমাজও সমভাবে দায়ী। কারণ পৃথিবীতে কেউ গ্যাং হিসেবে আবির্ভূত হয়নি। ফুলের মতো সুন্দর হিসেবেই পৃথিবীতে আসে। একটি সমাজ ও রাষ্ট্র কিশোরদের কাঁধে ভর করে উন্নয়নের সোপানে এগিয়ে যায়। তাই কিশোরদের নিয়ে সবাই স্বপ্ন দেখেন। তরুণরা প্রজাপতির মতো ঘুরে বেড়াবে, অন্যায়-অবিচার ও জুলুমের বিরুদ্ধে সভ্যতার বিজয় নিশান উড়াবে। এমনটাই সবার প্রত্যাশা। কিন্তু সে আশা যেন গুড়ে বালি। স্মার্টযুগের কিছু কিশোর সুপথে না হেঁটে বিপথে পা বাড়িয়ে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে উদ্বেগ উৎকন্ঠা সৃষ্টি করছে যা সত্যিই বেদনাদায়ক। কারণ যে সমাজ ও রাষ্ট্রের কিশোররা বিপথগামী হয়ে উঠে, সে সমাজ বা রাষ্ট্র বেশি দূর এগোতে পারে না। ক্ষমতায় টিকে থাকা কিংবা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যে ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা আমরা লক্ষ্য করি তাঁর ছিটেফোঁটাও যদি কিশোরদের সুন্দর জীবন গঠনে করা হতো, তাহলে কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি এভাবে গড়ে উঠতো না।

বাংলাদেশে নতুন সংকটের নাম কিশোর গ্যাং। এরা কারা? কী তাদের পরিচয়? এ বিষয়গুলো জাতির সামনে উন্মোচন করা প্রয়োজন। কিশোর গ্যাং হলো ১২-১৮ বছর বয়সী একটি দল বা গোষ্ঠী। তারা একত্রিত হয়ে নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। কিশোর গ্যাং সমাজ ও রাষ্ট্রের মারাত্মক ব্যাধি। এমন কোনো হীন অপকর্ম নেই, যা তারা করেনি। ছিনতাই থেকে শুরু করে চুরি, চাঁদাবাজি, মারামারি, মাদক বিক্রি, অপহরণ, খুন, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, ইভটিজিং ও সিনিয়র জুনিয়র সংঘাত ইত্যাদি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। এসব কর্মকাণ্ড সমাজ ও রাষ্ট্রে এক ধরনের অস্থিরতা ও নৈরাজ্য ছড়াচ্ছে। তাছাড়া তাদের একটি অংশ স্কুল-কলেজের গেটে কিংবা রাস্তার মধ্যে দলবদ্ধ হয়ে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। যাদের চাহনিতে এক প্রকার রুক্ষতা, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, মোটরসাইকেলের বিরক্তিকর হর্ন বাজিয়ে মানুষকে উত্ত্যক্ত করে তাদেরকেও ‘কিশোর গ্যাং’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কিন্তু অদ্যাবধি পর্যন্ত এই গ্যাং নিয়ন্ত্রণে কোন কার্যকর ভূমিকা চোখে পড়েনি। ফলে দিন দিন কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা বেড়েই চলেছে।

কিশোর গ্যাংগুলোর নাম শুনলেই বুঝা যায় এটা কিশোর গ্যাং, যেমন : ডিসকো বয়েজ, স্টার বন্ড, লেভেল হাই, নাইন স্টার, বিচ্ছু বাহিনী, একে ৪৭, বয়েজ, ধাক্কা, সুজন ফাইটার, ফাইভষ্টার, তুফান, ক্যাবরা, ভাইপার, নাইন এমএম বয়েজ, জিইউ ইত্যাদি। অথচ কিশোরদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত ও পারিবারক নাম রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে এ কিশোর-তরুণদের কাছে কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে কেন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে দেখা যাবে অবৈধ উপায় অর্থ-বিত্তের মালিক হওয়ার সহজ পন্থা এবং ক্ষমতার হাতছানি। তাই কিশোর তরুণরা কোন ধরনের বাছবিছার না করেই যুক্ত হচ্ছে গ্যাংয়ের সঙ্গে। সমাজবোদ্ধরা মনে করেন মাদকাসক্তির প্রসার, দারিদ্র্য, পারিবারিক ঝগড়া-বিবাদ, মা-বাবার বিচ্ছেদ, হতাশা, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ও ধর্মীয় শিক্ষার অভাব কিশোর গ্যাং সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। তাছাড়া আরও কিছু উল্লেখযোগ্য কারণ রয়েছে। যেমন : একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে যাওয়া, সামাজিক অবক্ষয়, মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ পরিবার থেকে উঠে যাওয়া, পারিবারিক কলহ ইত্যাদি কারণে কিশোর অপরাধপ্রবণতা দিন দিন বাড়ছে।

কিশোর অপরাধ সমাজ ও রাষ্ট্রে আগেও ছিল। ফ্যাসিস্ট বিতাড়িত হওয়ার পরও কিশোর গ্যাং থামছে না। সম্প্রতি রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ছিনতাই ও কিশোর গ্যাং চক্রের দৌরাত্ম্য প্রতিরোধে মশাল মিছিল এবং বিক্ষোভ করেছে স্থানীয় ছাত্র জনতা। হঠাৎ করে মোহাম্মদপুর এলাকায় অস্থিরতা সৃষ্টি হলেও পুলিশের নীরব ভূমিকায় মোহাম্মদপুর থানার ওসির অপসারণ চেয়ে থানার সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে জনতা। (সূত্র : যুগান্তর ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫) কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা কতটা বেপরোয়া তার প্রমাণ তো কবজি কাটা আনোয়ার। কবজি কাটা আনোয়ারকে গ্রেফতারের পর এলাকায় তার অনুসারীরা তাণ্ডব চালিয়েছে। কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে তারা দু’ভাইকে কুপিয়ে জখম করেছে। ৮-১০টি বাড়ি ও দোকানে হামলা-ভাঙচুর করেছে। মঙ্গলবার আদাবরের শ্যামলী হাউজিং ও শেখেরটেক হাউজিং এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। (সূত্র : যুগান্তর, ২০ ফেব্রুয়ারি,২০২৫) ০৭ মার্চ ২০২৫ যুগান্তরের আরেকটি খবর রাজধানীর গেণ্ডারিয়ায় কিশোর গ্যাংয়ের ছুরিকাঘাতে মো. সিয়াম শেখ নামে এক যুবক খুন। শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে গেণ্ডারিয়া ঢালকানগর শহীদ চেয়ারম্যানের বাড়ির সামনে একটি রিকশা গ্যারেজে এ ঘটনা ঘটে। নিহত সিয়াম মাদারীপুর জেলার রাজৈর উপজেলার শ্রীকষ্ণৃদি কবিরাজপুর গ্রামের মো. ইয়াকুব আলী শেখের ছেলে। বর্তমানে গেণ্ডারিয়া সাধনা গলি এলাকায় পরিবারের সঙ্গে ভাড়া বাসায় থাকতেন। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান ছিলেন সিয়াম।

আজকের শিশু-কিশোররাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। সুতরাং ভবিষ্যত প্রজন্মকে সত্যের পথে, আলোর পথে, সমাজ বিনির্মাণে তাদেরকে রক্ষা করতে হবে। নিকট অতীতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক দম্পতিকে ডেকে এনে স্বামীকে আবাসিক হলে আটকে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মোস্তাফিজুর রহমান ও বহিরাগত মামুনুর রশিদের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় ভিকটিমের স্বামী ছয়জনের নামে মামলা করে। তাদের চারজনই বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতা। এ ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয় তো বটেই দেশের জন্যও লজ্জাকর। চোখের সামনে কলিজার টুকরা কিশোরা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। অন্যায়-অবিচার কিংবা পাপে নিমজ্জিত হতেও কুন্ঠাবোধ করছে না। এসব বিপথগামী কিশোরদের বাঁচাতে জাতীয় ঐকমত্যের প্রয়োজন। দেশের স্বার্থে, জাতির স্বার্থে কিছু কিছু জায়গায় আমাদের এক হওয়া প্রয়োজন। আমাদের ভাষা এক, মানচিত্র এক। এক মানচিত্রের নিচে বিভক্তি সুখকর নয়। কারণ তা দেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে না।

যারা কিশোর গ্যাংয়ে জড়িত, তারা কেউ পৃথিবীর অন্য কোন দেশের বাসিন্দা নন; তারা কেউ আমাদের সন্তান, কেউ আমাদের ভাই, কেউ আমাদের প্রতিবেশী, কেউ আমাদের ভ্রাতষ্পুত্র। কিশোর গ্যাং বাবা-মায়ের জন্য অভিশাপ। আধিপত্য বিস্তার, সিনিয়-জুনিয়র দ্বন্দ্ব, প্রেমের বিরোধ নিয়ে কিশোররা খুনের শিকার হচ্ছে। সামাজিক অবক্ষয়ের মূল কারণ এসব কিশোর গ্যাং। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে শুধু ঢাকার শিশু আদালতের বিচারিক কার্যক্রমের নথির ভাষ্য হতে জানা যায় যে, গত ১৫ বছরে রাজধানীতে কিশোর গ্যাংয়ে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে প্রায় ২০০টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে সামগ্রিক কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। বিশেষ করে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য দূর করা প্রয়োজন। প্রয়োজন সামাজিক দ্বন্দ্ব, মারামারি, কলহ, রাজনৈতিক বিভেদ ও পারিবারিক দ্বন্দ্বের অবসান ঘটানো। কারণ এ সমস্ত দ্বন্দ্ব দেখে আমাদের শিশুরা বড় হচ্ছে। ফলে তারাও নানাভাবে অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। কিশোর গ্যাং বন্ধে নৈতিক শিক্ষার প্রসার ও সামাজিক সচেতনতার প্রয়োজন। শুধুমাত্র পুলিশ দিয়ে কিশোর গ্যাং বন্ধ করা সম্ভব নয়। পারিবারিক অনুশাসন ও নৈতিকতার প্রসার বাড়াতে পারলে কিশোর গ্যাং সংস্কৃতির হাত থেকে আমরা মুক্তি পেতে পারি। লেখক : প্রাবন্ধিক