আসিফ আরসালান
আজ ১৩ জুলাই রবিবার। রক্ত ঝরা জুলাই বিপ্লব শুরু হয়েছিলো গত বছরের এ মাস থেকেই। আর সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে গত বছরের ১৪ জুলাই থেকে বিপ্লবের অঙ্কুরোদগম হয়। এদিন পতিত স্বৈরাচারিনী হাসিনা কোটা আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে রাজাকারের বাচ্চা বলে গালি দিয়েছিলেন। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ১ জুলাই থেকে যে আন্দোলনের শুরু হয়েছিলো সেখানে কিন্তু সরকার পতনের কোনো কথাই ছিলো না। এর ৬ বছর আগেও কোটা আন্দোলন হয়েছিলো। তখনও ছাত্ররা সমাজের বিশেষ শ্রেণীকে ৫০ বছর ধরে অযৌক্তিকভাবে সরকারি চাকরিতে কোটার সুবিধা দেয়া হচ্ছিলো। মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার বা পুত্র কন্যাকে সরকারি চাকরিতে কোটা সুবিধা তো দেয়া হচ্ছিলোই। এবার তাদের নাতি- পুতিদেরকেও দেওয়ার উদ্যোগ হচ্ছিলো। এরই প্রতিবাদে ছাত্ররা কোটা আন্দোলন শুরু করেছিলো। আন্দোলনের দু’সপ্তাহ পর ১৪ জুলাই শেখ হাসিনা রেগে গিয়ে বলেছিলেন যে, মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা কোটা সুবিধা পাবে না; তো রাজাকারের বাচ্চারা পাবে?
এখানে আরো উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ৬ বছর আগে যারা কোটা আন্দোলন করেছিলো এবং ৬ বছর পর ২০২৪ সালে যারা কোটা আন্দোলন শুরু করে তারা কেউই শেখ হাসিনার ভাষায় রাজাকারের বাচ্চা ছিলো না। এভাবে সমগ্র ছাত্র সমাজকে রাজাকারের বাচ্চা বলায় সমস্ত ছাত্রসমাজ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বিক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে ঐ রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত হল একটি গগন বিদারী শ্লোগানে কেঁপে ওঠে। ছাত্ররা শ্লোগান দেয়, “তুমি কে, আমি কে/ রাজাকার রাজাকার”। “কে বলেছে, কে বলেছে/ স্বৈরাচার স্বৈরাচার।” এভাবেই একটি ছাত্রআন্দোলন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এবং ডিক্টেটর শেখ হাসিনার স্বভাবজাত অসংলগ্ন উক্তির ফলে রাজনৈতিক চরিত্র গ্রহণ করতে শুরু করে।
আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী ঘরানা ছাত্রদের এ শ্লোগানকে সংক্ষিপ্ত করে অপপ্রচার চালায়। তারা বলে, ছাত্ররা শ্লোগান দিয়েছে, তুমি কে আমি কে/ রাজাকার রাজাকার। কিন্তু পরবর্তী অংশ, কে বলেছে কে বলেছে/ স্বৈরাচার স্বৈরাচার-এ অংশটুকু তারা বাদ দেয়। বাদ দিয়ে প্রচার করে যে, যারা আন্দোলন করছে তারা সব রাজাকার পরিবারের সন্তান। এই অপপ্রচার চালিয়ে ২৪ ঘন্টার মধ্যে তারা এ আন্দোলনকে পিটিয়ে ঠাণ্ডা করার জন্য ছাত্রলীগ এবং যুবলীগকে হেলমেট পরিয়ে নামিয়ে দেয়। পরদিন আওয়ামী লীগের হেলমেট বাহিনী লাঠিসোটা এবং দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ছাত্রদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেদিন ছাত্ররা তো বটেই, ছাত্রীরাও হেলমেট বাহিনীর হাত থেকে রেহাই পায়নি।
আওয়ামী ছাত্রলীগ ও যুবলীগের হেলমেট বাহিনীর এ সশস্ত্র কিন্তু ভয়াবহ আক্রমণে ঐ মুহূর্তে ছাত্ররা পিছিয়ে যায় বটে, কিন্তু হেলমেট বাহিনীর হামলা ছাত্রসমাজকে প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ করে তোলে। শেখ হাসিনা ছাত্রদেরকে দমন করার জন্য পুলিশ বাহিনীকে মাঠে নামান। পুলিশ বাহিনী ব্যর্থ হলে বিজিবিকে মাঠে নামান। প্রথম প্রথম রাবার বুলেট ছুঁড়লেও দু’তিন দিনের মধ্যেই পুলিশ এবং বিজিবি প্রাণঘাতি বুলেট ছুঁড়তে থাকে। শুরু হয় আন্দোলনকারীদের শহীদ হওয়ার পালা। যতোই দিন যায় ততোই আন্দোলনে ছাত্রদের বাইরেও জনগণ সম্পৃক্ত হতে থাকেন। পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। নামানো হয় সেনাবাহিনীকে। সরকার যতোই নিত্য নতুন বাহিনীকে মাঠে নামাতে থাকে ততোই আন্দোলন দুর্বার গণআন্দোলনে পরিণত হতে থাকে। হাজার হাজার আমজনতা আন্দোলনে শরীক হতে থাকেন।
অবস্থা বেগতিক দেখে সরকার সারা দেশে কারফিউ বা সান্ধ্য আইন জারি করে। সরকারের দমনপীড়ন যতোই বাড়তে থাকে, যতোই পুলিশ, বিজিবি ও মিলিটারির গুলীতে ছাত্রজনতার রক্ত ঝরতে থাকে ততোই আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। দেখতে দেখতে জুলাই শেষ হয়ে অগাস্ট মাস আসে। ১লা অগাস্ট থেকে ছাত্র জনতার দুর্বার আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। আর ঐ যে প্রথম বলেছিলাম যে কোটা আন্দোলন ধীরে ধীরে রাজনৈতিক চরিত্র গ্রহণ করতে থাকে সেটি জুলাইয়ের শেষ দিকে এসে পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়। অগাস্ট মাসের প্রথম থেকে এ রাজনৈতিক আন্দোলন গণঅভ্যুত্থান তথা গণবিপ্লবে রূপান্তরিত হয়।
এর মধ্যে ২ অগাস্ট জাতিসংঘ থেকে বাংলাদেশ সরকারের কাছে এ মর্মে সাবধান বাণী আসে যে, যদি অবিলম্বে ছাত্রজনতার এ বিপ্লবে হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা না হয় তাহলে জাতিসংঘ শান্তি বাহিনীতে বাংলাদেশের অংশ গ্রহণ পুনর্বিবেচনা করা হবে। এটি ছিলো বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি জাতিসংঘের প্রত্যক্ষ হুমকি। এর সাথে যুক্ত হয় সশস্ত্র বাহিনীর সাধারণ সদস্য এবং মধ্যম সারির অফিসারদের উদ্বেগ। সশস্ত্র বাহিনীতে গুঞ্জন শুরু হয় যে, তারা এবং পুলিশ, বিজিবি কাদের মারছে? যাদের মারছে তারা তো কোনো বিদেশী নয়, তারা তো আমাদেরই ভাই, আমাদেরই সন্তান। কেনো মারা হচ্ছে? কার জন্য মারা হচ্ছে? যাদের জন্য মারা হচ্ছে তারা তো শাসক দল আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখার জন্য আমরা কেনো অস্ত্র ধরেছি?
একদিকে জাতিসংঘের হুমকি অন্যদিকে সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরে উদ্বেগ। এ অবস্থায় ৩ অগাস্ট সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ্জামান সেনাবাহিনীর সর্বস্তরের অফিসার ও জওয়ানদের সভা ডাকেন। প্রত্যেককে সামরিক পোশাক পরিধান করে সভায় আসার নির্দেশ দেয়া হয়। যারা ঢাকার বাইরে আছেন তাদেরকে অনলাইনে যুক্ত হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। ঐ সভায় সাধারণ সদস্য থেকে কর্নেল এমনকি দু’একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পর্যন্ত সাহস করে বলেন যে, তারা আর নিজ দেশের ছাত্র জনতার ওপর গুলী চালাতে প্রস্তুত নন। সেনাবাহিনীর সর্বশ্রেণীর সদস্যদের এ স্পষ্ট মতামত পাওয়ার পর জেনারেল ওয়াকার সিদ্ধান্ত নেন যে, আন্দোলনরত ছাত্রজনতার ওপর আর গুলী চালানো হবে না।
আসলে ৩ অগাস্ট সেনাবাহিনীর এ সিদ্ধান্তের পরই শেখ হাসিনার জালিম শাহীর মৃত্যুঘণ্টা বেঁজে ওঠে। ঐ দিকে ছাত্রজনতাও ভাবতে থাকেন যে এখন তো আর তাদের এ আন্দোলন ছাত্রদের কোটা আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এখন এটি রাজনৈতিক আন্দোলনে পর্যবসিত হয়েছে। এখন আর এটি আন্দোলন নয়, গণঅভ্যুত্থান বা গনবিপ্লবে পরিনত হয়েছে। এটি সশস্ত্র বিপ্লব নয়, কিন্তু কোটি কোটি জনগণের প্রত্যক্ষ অংশ গ্রহণের ফলে পরিণত হয়েছে এক নিরস্ত্র বিপ্লবে। এ বিপ্লবে তো সাধারণ মানুষের নিশ্চয়ই একটি আকাক্সক্ষা বা অভিপ্রায় রয়েছে।
এ নতুন চিন্তুা মাথায় নিয়ে ছাত্র নেতৃবৃন্দ আরো বীরদর্পে শেখ হাসিনার রক্তপানের নেশাকে প্রতিরোধ করার জন্য এগিয়ে যান। ৪ অগাস্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলীতে ৯৮ জন আন্দোলনকারী শহীদ হন। ৫ অগাস্ট শহীদ হন ১০৪ জন আদম সন্তান। ৫ অগাস্ট অপরাহ্নে ১৪ শত শহীদ এবং আওয়ামী হেলমেট বাহিনী, পুলিশ ও বিজিবির বুলেটে আহত ২৬ হাজার আন্দোলকারীর তাজা রক্তের ভেতর দিয়ে উদিত হয় জুলাই অগাস্ট বিপ্লবের লাল সূর্য।
এ হলো জুলাই বিপ্লবের ৩৬ দিনের রক্তক্ষয়ী ইতিহাস। এটিকে ৩৬ জুলাই বিপ্লবও বলা হয়। কারণ জুলাই মাসের ৩১ দিন এবং অগাস্ট মাসের ৫ দিন- মোট ৩৬ দিন। তাই এটা ৩৬ জুলাই। এ বিপ্লবে কোটি কোটি মানুষ অংশ গ্রহণ করেছেন। কিন্তু বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছেন ছাত্র ও ছাত্রীরা। এদের কারো বয়সই ৫ অগাস্ট পর্যন্ত ২৫ এর ঊর্ধ্বে যায়নি। তাই এদেরকে বলা হয় জেন-জেড বা জেন-জি।
একথা সত্য যে ২০০৯ সালের ৫ জানুয়ারি ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই, বিশেষ করে ২০১১ সাল থেকেই বাংলাদেশের প্রায় সমস্ত বিরোধী দল বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, অন্যান্য ইসলামী দল, নাগরিক ঐক্য, জাসদ, গণসংহতি আন্দোলন, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, ছাত্রদল, ইসলামী ছাত্রশিবির সহ সকলেই শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। সে ২০১১ সাল থেকে শুরু করে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১৫ বছর নির্মম দমন নীতি দিয়ে প্রতিটি আন্দোলনকে স্তব্ধ করা হয়েছে। সমস্ত বিরোধী দলের সম্মিলিত লক্ষাধিক নেতাকর্মীকে বিভিন্ন সময় কারাগারে নিক্ষেপ থেকে শুরু করে আয়না ঘর সহ বিভিন্ন বন্দীশালায় নির্যাতন করা হয়েছে। ক্রসফায়ারের নামে ৩ হাজারের ওপর মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এতকিছু করেও কিন্তু শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচারকে ক্ষমতা থেকে নামানো যায়নি। অন্যান্য কারণের মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ ছিলো জুলুম নির্যাতন সহ্য করেও নেতাকর্মীরা ঘুরে দাঁড়ায়নি। জালিমের জুলুমকে মোকাবেলা করার জন্য রুখে দাঁড়ায়নি।
কিন্তু নাহিদ ইসলাম, হাসনাত আব্দুল্লাহ, আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়া, সারজিস আলম প্রমুখ ছাত্রনেতাদের নেতৃত্বে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রুখে দাঁড়িয়েছিলো। তাই সাধারণ মানুষ তাদের নেতৃত্বে আস্থা স্থাপন করতে পেরেছিলেন বলেই তারা লাখে লাখে কোটি কোটিতে ঘর থেকে বেরিয়ে ছাত্রনেতাদের হাতকে শক্তিশালী করেছিলেন। এ যে তারা ঘর থেকে বেরিয়ে তাজা বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়েছিলেন তার প্রাথমিক উদ্দেশ্য অবশ্যই ছিলো শেখ হাসিনার স্বৈরাচারের পতন। কিন্তু এর পরের বৃহত্তর উদ্দেশ্য ছিলো হাসিনার পতনের পর এমন একটি শাসনব্যবস্থা কায়েম হবে যার ফলে স্বৈরাচার আর কখনো বাংলাদেশের মাটিতে ফিরে আসবে না। আর একটি উদ্দেশ্য ছিলো ভারতীয় প্রভুত্বের শৃঙ্খল থেকে পিতৃভূমি বাংলাদেশকে চিরতরে মুক্ত করা।
এ দ্বিবিধ লক্ষ পূরণ হলেই জুলাই বিপ্লব সার্থক হবে। কিভাবে সেটি পূরণ হবে সেটি একটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। বারান্তরে সে আলোচনার ইচ্ছা রইলো।