ঈদ আসেনি তাদের তরে, যারা পরেছে নতুন বেশ খোদার ভয়ে পূর্ণ যে মন, তারই তরে ঈদের রেশ।

ঈদুল ফিতর মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। আনন্দ উচ্ছ্বাস ছাড়া উৎসব অর্থহীন। এটা চিন্তা করা কঠিন যে নিরানন্দভাবে উৎসব উদযাপিত হবে। আর আনন্দের সাথে প্রাপ্তিযোগের একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে। ঈদের আনন্দ-উচ্ছ্বাস সবচেয়ে বেশি দেখা যায় শিশুদের মধ্যে। কারণ, এ সময় তারা নতুন পোশাক-পরিচ্ছদ ও খাবার-দাবারসহ নানা রকম উপহার সামগ্রী পেয়ে থাকে। বড়রাও যারা চাকরি-বাকরি করেন, তারা ঈদ উপলক্ষে বোনাস বা উৎসব ভাতা পেয়ে থাকেন। তবে এসবই বস্তুগত। বাড়িতে ভাল রান্না-বান্নার আয়োজন বা নতুন পোশাক-পরিচ্ছদ তো অন্য অনেক সময়ই কেনা হয়, কিন্তু ঈদের মত উৎসবের আমেজ কি আর পাওয়া যায়? ফিলিস্তিনের মুসলিমদেরকেও আমরা দেখেছি ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও ঈদের নামায পড়তে; তাদের প্রাপ্তিটা কী? আসলে ঈদের প্রকৃত আনন্দটা অপার্থিব। যারা সারা মাস সিয়াম সাধনা করেন আল্লাহর নৈকট্য ও গুনাহ মাফের আশাজনিত প্রশান্তি লাভ করেন ঈদের প্রকৃত আনন্দটা তারাই উপভোগ করেন।

পবিত্র কুরআন মজিদে আল্লাহ তায়ালাও আনন্দ-উৎসব করতে বলেছেন এবং শুধু মুসলিমদেরকে নয়; পুরো মানব জাতিকেই আনন্দ-উৎসব করতে বলেছেন ; কারণ মানব জাতির জন্য তিনি তাঁর পক্ষ থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান উপহার ও অনুগ্রহটি পাঠিয়ে দিয়েছেন। আর সেটা হল মহাগ্রন্থ আল কুরআন। আল্লাহ বলেন-

‘হে মানবজাতি! তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে উপদেশ(কুরআন) এসে গেছে; এতে রয়েছে (তোমাদের) অন্তরের রোগের পূর্ণ নিরাময়; আর যে তা কবুল করবে (ঈমান আনবে) তার জন্য নির্দিষ্ট রয়েছে পথনির্দেশ এবং রহমত। (হে নবী) বল: এটা আল্লাহ’র অনুগ্রহ ও অপার করুণা যে, তিনি এই প্রত্যাদেশ নাযিল করেছেন। এজন্য তো লোকদের আনন্দ-উৎসব করা উচিত। এটা সেসব থেকে উত্তম, যা লোকেরা সংগ্রহ ও আয়ত্ত করে থাকে।- [সূরাহ ইউনুস: আয়াত ৫৭-৫৮]

মূলত রমযান মাসের বড়ত্ব, গুরুত্ব ও মাহাত্ম্যের মূলে রয়েছে আল্লাহ’র কালাম আল কুরআন নাযিল হওয়া। আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন পবিত্র রমযান মাসে পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ করেন। আল্লাহ’র কালাম আল কুরআনকে বুকে ধারণ করার কারণেই এ মাস এত পবিত্র এবং এ কারণেই এর এত মর্যাদা, এত গুরুত্ব। কারণ আল্লাহ’র কালাম হল সমগ্র মানবজাতির জন্য মুক্তির পয়গাম। এটি সঠিক পথের দিশা ও অন্তরের রোগের নিরাময়কারী, যে অন্তরের রোগ সমস্ত অশান্তির মূল কারণ। কুরআন হল পরশ পাথরের ন্যায়; যে তার স্পর্শ পায় সে মর্যাদাবান হয়ে ওঠে। আর আল কুরআন হচ্ছে পৃথিবীতে একমাত্র ঐশীগ্রন্থ যা তার অকৃত্রিম, অবিকৃত ও আসল রূপে বিদ্যমান। মানবজাতির জন্য এটি এক বিরাট ঘটনা এবং আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনের সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ। কারণ, এ ঐশীগ্রন্থের কল্যাণেই আমরা স্রষ্টার সাথে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করার সুযোগ পেয়েছি।

কাজেই রমযান মাসের মর্যাদা শুধু এজন্য নয় যে এ মাসে রোজা রাখা হয় এবং কুরআন তেলাওয়াত করা হয়। বরং কুরআন নাযিল করার কারণেই আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন এ মাসটিতে রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন নিজে রমযান মাসকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন এভাবে- ‘রমযান সেই মাস, যে মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে; যা সমগ্র মানবজাতির জন্য হেদায়াত, সুস্পষ্ট পথ-নির্দেশ এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী। তোমাদের মধ্যে যেই এ মাসের সাক্ষাৎ পাবে, সে যেন রোজা রাখে।’ -আল বাকারা: ১৮৫

পবিত্র কুরআনকে বাস্তবিকই হেদায়াতগ্রন্থ এবং আত্মশুদ্ধির উপায় হিসেবে গ্রহণ করার কারণে আরববাসীর জীবনে এসেছিল বিস্ময়কর পরিবর্তন। এ পরিবর্তন ছিল বিরাট ও মৌলিক। কুরআনের এ প্রভাব সম্পর্কে কারো মনে যদি কোন সন্দেহ থেকে থাকে, তাহলে তিনি মহানবীর সাহাবীদের জীবনের দিকেই তাকিয়ে দেখতে পারেন যে তাদের জীবনে কী বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল।

ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে তাদের জীবন ছিল দারুণ দুর্বিষহ এবং ঘোর অন্ধকার ও অজ্ঞতার মধ্যে নিমজ্জিত। কিন্তু কুরআনের স্পর্শ তাদের চরিত্রে কী পরিবর্তনটাই না ঘটিয়ে দিল! মূলত এর মাধ্যমে কুরআনের পরিবর্তন ও পুনর্গঠন ক্ষমতারই প্রমাণ পাওয়া যায়। কুরআনের কারণেই আরবের গরীব, গুরুত্বহীন, নগ্নপদের মরুচারী লোকগুলো নতুন এক আত্মিক-শক্তিতে জেগে উঠল, নতুন ছাঁচে ও নতুন রূপে গড়ে উঠল। তাদের জীবনের দৃষ্টি ও কামনা-বাসনাই বদলে গেল এবং তাদের জীবনবোধ এক উন্নত ও মহান লক্ষ্যপাণে পৌঁছতে সক্ষম হল। তাদের মন-মানসিকতা ও তাদের হৃদয়গুলো এত উন্নত হল যে, তা যেন আল্লাহর আরশকে স্পর্শ করল। মোটকথা কুরআনের স্পর্শে আরবের বর্বর ও ইতর লোকগুলো সোনার মানুষে পরিণত হল এবং এর ফলে আল্লাহর অঙ্গীকারও সত্যে পরিণত হওয়া সম্ভব হল। পবিত্র কুরআন মজিদে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, ‘আল্লাহ ততক্ষণ পর্যন্ত কোন জাতির ভাগ্যের পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করে।’- [আর রা’দ : ১১] এ বিরাট নৈতিক বিপ্লবের কারণেই অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই আরবের ঐ মরুভূমি থেকে এক নতুন শক্তির উত্থান ঘটল, যারা ঐ সময়ের শক্তিশালী সাম্রাজ্যগুলোর অহংকার ধুলায় মিশিয়ে দিতে সক্ষম হল এবং তাদের কাছ থেকে পৃথিবীর নেতৃত্ব নিয়ে নিল।

এ নাটকীয় পরিবর্তন কীভাবে সম্ভব হল? সম্ভব হল এ কারণেই যে আল কুরআন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর মাধ্যমে যথাযথভাবে উপস্থাপিত হতে পেরেছিল এবং এবং নবীর নেতৃত্বে তার সাথীরা কুরআনের আহ্বানে যথাযথভাবে সাড়া দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। এত বিরাট পরিবর্তন সম্ভব হয়েছিল, কারণ আরবের লোকেরা কুরআনকে জানতে পেরেছিলেন, উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। এ কারণে তারা কুরআনকে যথার্থভাবে মর্যাদা দিতে পেরেছিলেন, সঠিক মূল্যায়ন করতে পেরেছিলেন। আর রাসূলকে তারা পেয়েছিলেন কুরআনেরই বাস্তব মডেল বা নমুনা হিসেবে।

আল্লাহর রাসূল তাঁর জীবনে কুরআনকে জীবন্ত করে তুলেছিলেন, কুরআনের চেতনাতেই তিনি উজ্জীবিত হয়েছিলেন। তিনি তাই অনুমোদন করেছেন, যার অনুমোদন কুরআন তাঁকে দিয়েছে এবং কুরআন যা নিষেধ করেছে তিনি তাই নিষেধ করতেন। কাজেই মা আয়েশা যখন নবীজির প্রসঙ্গে বলেন যে, তিনি ছিলেন পৃথিবীর বুকে জীবন্ত কুরআন, তখন তাতে অতিশয়োক্তি বা বিস্ময়কর বলে কিছু থাকে না।

তাই এই মহাগ্রন্থের অবতীর্ণ উপলক্ষেই আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনের নির্দেশে মহানবী (সা.) মুসলমানদের জন্য দুটি উৎসব পালনের ঘোষণা দেন। বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘‘প্রত্যেক জাতিরই উৎসব রয়েছে, আমাদের উৎসব হলো ঈদ।’’

ঈদুল ফিতরের আনন্দ-উৎবের সাথে সিয়াম সাধনার একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। আমরা যদি আমাদের প্রধান ঈদ উৎসব ঈদুল ফিতরের ধর্মীয় শিক্ষা ও তাৎপর্যের কথা চিন্তা করি, তাহলে দেখব, একটি সুস্থ ও কল্যাণমুখী সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে তা বিরাট প্রভাব ফেলতে পারে। প্রথমত, দীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধনা ও কুরআন তিলাওয়াত-অধ্যয়ন ও ইবাদত-উপাসনার রোজাদার স্রষ্টার নৈকট্য অনুভব করেন। এর ফলে তাদের মন আগের তুলনায় অনেক নরম হয়, আত্মশুদ্ধির জন্য এই জিনিসটির কোন বিকল্প নেই। আমরা অনেকেই সমাজ বদলের কথা বলি, দিন বদলের কথা বলি। কিন্তু দিন বদলের জন্য সবার আগে যে দিল বদলের প্রয়োজন সে কথাটি ভুলে যাই। মাহে রমযান কিন্তু এই দিল বদলের শিক্ষা ও সুযোগ নিয়েই আমাদের মাঝে হাজির হয়। তাই তো কবি বলেছেন-

ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ

তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।

তোর সোনা-দানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ

দে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ

ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।

সুতরাং এটি গতানুগতিক কোন উৎসব নয়। এ উৎসব মূলত আল্লাহ তায়ালার সবচেয়ে বড় নেয়ামত আল কুরআন পাওয়ার আনন্দের উদযাপন। আমাদের ঈদ উদযাপন ও সংস্কৃতির মধ্যে তাই কুরআন চর্চার প্রভাব থাকা জরুরি। কারণ, সংস্কৃতি হচ্ছে মানুষের জীবনবোধ ও বিশ্বাসের প্রতিরূপ যা তার আচরণের মাধ্যমে ফুটে ওঠে। বলা হয়ে থাকে সংস্কৃতি হল মার্জিত জীবনাচার। একটি জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি কতটা শিষ্ট ও মার্জিত হবে তা নির্ভর করে তার জীবন ও জগৎ সম্পর্কে ধারণা, বিশ্বাস ও মূল্যবোধের ঋদ্ধতার উপর। কেননা, মানুষের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে তাদের ভাবনা বা ভাল-মন্দের বোধ। মানুষের জীবনবোধের বিন্যাসে এবং একটি জাতির মানস গঠনে ধর্মের একটি বিরাট ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। কেননা, ধর্ম জীবন ও জগৎ সম্পর্কে একটি বিশিষ্ট ধারণা বা বিশ্বাস প্রদান করে। কাজেই ঈদ উৎসবে ধর্মীয় আদর্শের একটি প্রভাব থাকা স্বাভাবিক এবং যারা ইসলামের ধর্মীয় আদর্শকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন তাদের উচিত বল্গাহীন উল্লাসে গা ভাসিয়ে না দিয়ে ঈদের ধর্মীয় তাৎপর্যকে স্মরণে রাখা এবং তাকে অনুসরণ করা।

তবে আমাদের মধ্যে খুব কম লোকই ধর্মের প্রকৃত স্পিরিটকে ধারণ করতে পেরেছি। রমযান মাস কুরআনের মাস হলেও আমাদের মধ্যে খুব কম মানুষই এ সময়ে কুরআন অধ্যয়ন করি। আবার আমাদের তারাবির নামাযগুলোতে যে অস্বাভাবিক দ্রুততার সাথে কুরআন তেলাওয়াত করা হয় তাতে আসলে আল্লাহর কালাম নিয়ে এক ধরনের তামাশাই করা হয়। এ কারণেই দেখা যায় রমযান মাসেও আমাদের চেতনার খুব একটা পরিবর্তন দেখা যায় না। বরং দেখা যায় শুধু শুধু জিনিসপত্রের দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতা। অথচ পবিত্র রমযান মাস হলো সিয়াম-সাধনার মাস, আত্মশুদ্ধির মাস। আত্মসংযম ও আত্মসমালোচনার মাস। আল্লাহর রাসূল বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমান ও এহতেশাবের (আত্মসমালোচনা) সাথে সিয়াম পালন করবে তার পূর্বের ও পরের সব গুনাহ মাফ হয়ে যাবে।’ আমরা রোজা রাখি ঠিকই কিন্তু আমাদের মধ্যে এই আত্মসমালোচনাটা নেই। এ কারণেই আমরা রোজাও রাখি আবার মিথ্যা কথাও বলি। অনেককে তো এও দেখা যায় যে, সারাদিন রোজা রাখে, কিন্তু নামায পড়ে না। এর কারণ কী? কারণ ঐ আনুষ্ঠানিকতা। এ কারণেই রোজার নামে তারা আনুষ্ঠানিকতা পালন করে মাত্র, সিয়াম সাধনা নয়, আত্মশুদ্ধি বা আত্মসমালোচনা নয়। এসব যদি থাকতো তাহলে রমযানে জিনিস-পত্রের দাম বাড়ানোর প্রশ্ন আসতো না। অথচ মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও মিথা কাজ পরিত্যাগ করতে পারলো না, তার শুধুমাত্র পানাহার পরিত্যাগে আল্লাহর কোনই প্রয়োজন নেই।’

এ কারণেই রমযানের যে কাক্সিক্ষত প্রভাব আমাদের সমাজ-সংস্কৃতিতে, আমাদের নৈতিক চরিত্রে পড়ার কথা তা আমরা প্রত্যক্ষ করছি না। এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ আমরা রমযান শেষেই পাই। কারণ মসজিদগুলোতে সেই উপচে পড়া ভিড়, সেই মৌসুমী মুসল্লিদের আর দেখা যায় না। রমযান মাসে যারা পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়তেন, রমযান শেষে তাদের অনেককেই আর নামায পড়তে দেখা যায় না। এরও কারণ ঐ আনুষ্ঠানিকতা।