প্রত্যেকটি মানুষের জীবনের অমূল্য সম্পদ তার স্বাস্থ্য। মূলত শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার নামই হচ্ছে স্বাস্থ্য। স্বাস্থ্য ভালো থাকলে মন ভালো থাকে, মন ভালো থাকলে শরীরও ভালো থাকে। অর্থাৎ একটি অপরটির পরিপূরক। সে জন্য প্রত্যেক মানুষের প্রথম ও প্রধান চাওয়া হচ্ছে আল্লাহতায়ালা যেন তাকে সুস্থ রাখেন। একজন মানুষ যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। তাছাড়া কেউ সহজে চিকিৎসকের কাছে যেতে যান না। কারণ চিকিৎসকের প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গাটিতে চির ধরেছে। ফলে কিছু মানুষ সামান্য জ¦র, ঠাণ্ডা কিংবা সামান্য কাশি হলে নিজেই চিকিৎসক সেজে অথবা ফার্মেসি দোকানদারের পরামর্শে ওষুধ কিনে খান। কিন্তু একবারও ভাবেন না, তিনি নিজের কত বড় সর্বনাশ করছেন। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পেরিয়ে গেলেও চিকিৎসা খাতে আশানুরূপ উন্নয়ন হয়নি। ফলে প্রায়ই পত্রিকার পাতায় স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি, অনিয়ম, জনবল সংকট, সরঞ্জাম সংকট, ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি, বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু, ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু এসব খবর মুদ্রিত হয়।

ফ্যাসিস্ট হাসিনা ১৫ বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল। তার শাসনামলে চিকিৎসাখাতে ব্যাপক দুর্নীতির চাষাবাদ হয়েছে। ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পর্দা কেলেঙ্কারি এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শত কোটি টাকার ড্রাইবার মালেকের ঘটনা বেশ আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছিল। তবে আশার কথা হচ্ছে গত ২৩ মার্চ ঢাকার বিশেষ জজ আদালত ৬ এর বিচারক জাকারিয়া হোসেন অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আলোচিত সাবেক গাড়িচালক আব্দুল মালেককে ১৩ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত (সূত্র : যায়যায় দিন, ২৩ মার্চ, ২০২৫) আমাদের স্বাস্থ্যখাতের অবস্থা ভালো নাকি মন্দ তা করোনাকালে একবার জানান দিয়েছিল। আমরা আশা করেছিলাম সরকার স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করবে। কিন্তু করেনি। ৫ আগস্ট পতিত স্বৈরাচার পালিয়ে যাওয়ার পর অর্šÍবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বিশ্ব নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। দায়িত্ব গ্রহণ করার পর পরই তিনি স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নের জন্য সংস্কার কমিশন গঠন করেন। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) গত ১৮ ফেব্রুয়ারি বিবিএসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা স্বাস্থ্য খাত সংষ্কারবিষয়ক কমিশনের কাছে জরিপের প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। বিবিএস এ বছর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে দেশের ৬৪ জেলার শহর ও গ্রামাঞ্চলের ৮ হাজার ২৫৬টি খানার ওপর জরিপ করে। জরিপে প্রতিটি খানা থেকে ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী একজন নারী বা পুরুষের মতামত নেওয়া হয়। জরিপে যে কয়টি বিষয় উঠে এসেছে তার কিছু অংশ পাঠকদের জন্য নিচে তুলে ধরা হলো :

অবহেলা-অযত্নের অভিযোগ : বাংলাদেশে সরকারি বা বেসরকারি সব ধরনের হাসপাতাল-ক্লিনিকে চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ শোনা যায়। অর্থাৎ দেশের ৩৮ শতাংশ মানুষ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে অবহেলা, অযত্ন বা অপচিকিৎসার শিকার হন এবং গ্রামের ৩৬ শতাংশ মানুষ ও শহরের ৪৪ শতাংশ মানুষ এই অভিযোগ করেছেন।

মানুষ কোথায় চিকিৎসা নেন : জরিপে অংশ নেয়া ৬২ শতাংশ গত এক বছরে তাঁরা সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিয়েছেন। তবে সবচেয়ে বেশি মানুষ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এ চিকিৎসা নেয়ার কথা বলেছেন। সুতরাং জরুরি ভিত্তিতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোকে আধুনিকায়ন করার পাশাপাশি ২৪ ঘন্টায় চিকিৎসক রাখার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

চিকিৎসার জন্য কত মানুষ বিদেশ যান : দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর আস্থা না থাকায় কিছু মানুষ বিদেশে চিকিৎসা নিতে যান। এটা যেমন সত্য। তেমনিভাবে এটাও সত্য যে, শুধু আস্থার বিষয়টি নয়, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ব্যয় বহন করার সাধ্য যাদের আছে তাদের একটি অংশ বিদেশে চিকিৎসা নেন। জরিপে ২ দশমিক ৪ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, গত ৫ বছরে তিনি নিজে বা পরিবারের অন্য কোনো সদস্য চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে গেছেন। তবে উত্তরদাতারা ১১টি রোগের চিকিৎসার জন্য বাইরে যাওয়ার কথা বলেছেন যেমন : হৃদরোগ, কিডনির রোগ, ক্যানন্সার, ডায়াবেটিস, চোখের সমস্যা, স্নায়ুরোগ, সড়ক দুর্ঘটনা ও আগুনে পোড়া, অর্থোপেডিক, মানসিক সমস্যা ও শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত রোগ। তবে সবচেয়ে বেশি মানুষ ৩টি রোগের জন্য বিদেশে পাড়ি দেন। যেমন: হৃদরোগের জন্য ২৯.৮ শতাংশ, কিডনির জন্য ১৭.৩ শতাংশ এবং ক্যান্সারের জন্য ১৪.৮ শতাংশ।

ওষুধের দাম নিয়ে ভাবনা : দ্রব্যমূল্যের মতোই ওষুধের দাম ও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। দ্রব্যমূল্য বাড়লেও সব পণ্য একসাথে বাড়ে না। আর দাম বাড়লে বেশির জায়গায় কম কিনলেও চলে। কিন্তু ওষুধের বেলায় তো এ নিয়ম অচল। যতই দাম বাড়ুক প্রয়োজনীয় ওষুধ কিনতেই হয়। কম কেনার সুযোগ নেই। জরিপে অংশ নেওয়া ১৩ শতাংশ মানুষ মনে করেন দেশে ওষুধের দাম খুব বেশি। ৮৪ শতাংশ মনে করেন দেশে সাশ্রয়ী মূল্যে ওষুধ পাওয়া যায়। তবে ৪৪ শতাংশ মানুষ মনে করেন চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রে ওষুধের মূল্য বা জেনেরিক নাম লেখা উচিত, ১৭ শতাংশ মানুষ মনে করেন কোম্পানির নাম ব্যবহার করা উচিত এবং ৩২ শতাংশ মানুষ মনে করেন চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রে জেনেরিক ও কোম্পানির নাম লেখা উচিত।

চিকিৎসক সময় দেন না : চিকিৎসকরা রোগীদের সময় দেন না। এ অভিযোগ নতুন না, বেশ পুরানো। তবে জরিপে অংশ নেওয়া ২৮ শতাংশ মানুষ মনে করেন একজন চিকিৎসকের চেম্বারে রোগী প্রতি কমপক্ষে ২০ মিনিট সময় দেয়া উচিত। ২৬ ও ১৯ শতাংশ মানুষ মনে করেন ১৫ থেকে ১০ মিনিট সময় দেয়া উচিত।

এত গেল জরিপের ফলাফল। জরিপের ফলাফলের বাইরেও আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অনেক দুর্বলতা রয়েছে যা লিখলে সমাপ্তি টানা যাবে না। দেশের স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নের লক্ষ্যে আমাদের অনেক বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক গড়ে উঠেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ ওইসব হাসপাতাল আর ক্লিনিকে চিকিৎসা করাতে পারছে না। কারণ চিকিৎসা ব্যয় নাগালের বাইরে। অন্যদিকে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যয় কম হলেও রোগীরা বেসরকারি হাসপাতালমুখী। কারণ সরকারি হাসপাতালে সিট পাওয়া মানে সোনার হরিণ পাওয়ার মতো অবস্থা। আর সিট পাইলে চিকিৎসক কখন আসেন তার নেই কোন ঠিক। ফলে অনেক রোগী মনে করে অর্থ যাক, তবু যেন জীবনটা সুস্থ হয়ে উঠে। এমনটিই সবার প্রত্যাশা। আমাদের দেশে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে রোগীরা চিকিৎসা সেবা নেয়ার জন্য ছুটাছুটি করে। যাদের অর্থ বিত্ত আছে তারা বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেন আর যাদের অর্থ বিত্ত নেই তারা সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য রীতিমত যুদ্ধ করেন। কিন্তু চিকিৎসা সেবা সবার ভাগ্যে জুটে না। কারণ সরকারি হাসপাতালের তুলনায় রোগী অনেক বেশি হয়।

ফলে অল্প সংখ্যক জনবল দিয়ে হাসপাতালগুলো সঠিক চিকিৎসা সেবা দিতে পারে না। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে দেশের প্রায় ১৭ কোটি মানুুষের জন্য সরকারি হাসপাতাল ৬৫৪টি, বেসরকারি হাসপাতাল ৫০৫৫টি, সরকারি হাসপাতালে মোট শয্যার সংখ্যা ৫১,৩১৬টি। আর বেসরকারি হাসপাতালে মোট শয্যার সংখ্যা ১ লাখ ৫ হাজার ১৮৩টি। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে দেশে মোট আইসিইউ শয্যা আছে মাত্র ১১৬৯টি। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালে আছে ৪৩২টি (ঢাকায় ৩২২, ঢাকার বাইরে ১১০) আর বেসরকারি হাসপাতালে আছে ৭৩৭টি (ঢাকা মহানগরে ৪৯৪, ঢাকা জেলায় ২৬৭, অন্যান্য জেলায় ২৪৩টি) (সূত্র : প্রথম আলো, ২৮ নবেম্বর ২০২১) ফলে সিংহভাগ হাসপাতালের ধারণ ক্ষমতার বাইরে অন্তত দ্বিগুণ রোগী ভর্তি থাকে। তাই সীমিত এ জনবল দিয়ে চিকিৎসা ব্যবস্থার সংকট দূর করা সম্ভব হচ্ছে না। সুতরাং জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসাখাতে বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার আধুনিকীকরণ করা প্রয়োজন। বিশেষ করে গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবার প্রতি নজর দেয়া প্রয়োজন। যেন রোগীদের ঢাকামুখী হতে না হয়। এটা করতে পারলে চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে এবং দেশীয় চিকিৎসার সুনাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। লেখক : প্রাবন্ধিক