জাফর আহমাদ

দেউলিয়া বলতে আমরা বুঝি, কোনো ব্যক্তির কারবারে খাটানো সব পুঁজি যদি নষ্ট হয়ে যায় এবং বাজারে তার পাওনাদারের সংখ্যা এত বেড়ে যায় যে, নিজের সবকিছু দিয়েও সে দায়মুক্ত হতে পারে না, এরূপ অবস্থাকেই সাধারণত দেউলিয়াত্ব বলা হয়। আখিরাতে কাফের মুশরিকদের এ অবস্থা হবে। আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘তোমরা তাঁর ছাড়া আর যাদের ইচ্ছা দাসত্ব করতে থাকো। বলো, প্রকৃত দেউলিয়া তারাই যারা কিয়ামতের দিন নিজেকে এবং নিজের পরিবার-পরিজনকে ক্ষতির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ভালো করে শুনে নাও, এটিই হচ্ছে স্পষ্ট দেউলিয়াপনা।’ (সুরা যুমার:১৫) এ আয়াতে আল্লাহ তা’আলা কাফের ও মুশরিকদের জন্য এ রূপক ভাষাটিই ব্যবহার করেছেন।

মানুষ এ পৃথিবীতে জীবন, আয়ু, জ্ঞান বুদ্ধি, শরীর, শক্তি, যোগ্যতা উপায় উপকরণ এবং সুযোগ সুবিধা যত জিনিস লাভ করেছে তার সমষ্টি একটি পুঁজি যা সে পার্থিব জীবনের কারবারে খাটায়। কেউ যদি এ পুঁজির সবটাই এ অনুমানের ওপর ভিত্তি করে খাটায় যে, কোনো ইলাহ নেই কিংবা অনেক ইলাহ আছে আর সে তাদের প্রত্যেকের বান্দা। তাকে কারও কাছে হিসাব দিতে হবে না কিংবা হিসাব-নিকাশের সময় অন্য কেউ এসে তাকে রক্ষা করবে, তাহলে তার অর্থ হচ্ছে সে ক্ষতিগ্রস্ত হলো এবং নিজের সবকিছু খুইয়ে বসলো। এটা হচ্ছে তার প্রথম ক্ষতি। তার দ্বিতীয় ক্ষতি হচ্ছে, এ ভ্রান্ত অনুমানের ভিত্তিতে সে যত কাজই করলো সেসব কাজের ক্ষেত্রে সে নিজেকেসহ দুনিয়ার বহু মানুষ, ভবিষ্যৎ বংশধর এবং আল্লাহর আরো বহু সৃষ্টির ওপর জীবনভর জুলুম করলো। তাই তার বিরুদ্ধে অসংখ্য দাবি আসলো। কিন্তু তার কাছে এমন কিছুই নেই যে, সে এসব দাবি পূরণ করতে পারে। তাছাড়া আরো একটি ক্ষতি হচ্ছে, সে নিজেরই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হলো না, বরং নিজের সন্তান-সন্ততি, প্রিয়জন ও আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধু-বান্ধব ও স্বজাতিকেও তার ভ্রান্ত শিক্ষা দীক্ষা এবং ভ্রান্ত দৃষ্টান্ত দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত করলো।

সে শুধু নিজেই দেউলিয়া হলো না বরং সে নিজের চরিত্র দ্বারা তার পারিপার্শ্বিক লোকদেরকে দেউলিয়া করে এবং এটিকে আল কুরআন সবচেয়ে বড় জুলুম হিসাবেও চিহ্নিত করেছে। সে নিজে সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কারণে তার পরিবার, তার সমাজ কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়। এটি পরিবার ও সমাজের প্রতি সুষ্পষ্ট জুলুম। আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘আর কে তার চেয়ে বড় জালেম, যাকে রবের আয়াত শুনিয়ে উপদেশ দেয়ার পর সে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং সে খারাপ পরিণতির কথা ভুলে যায় যার সাজ-সরঞ্জাম সে নিজের জন্য নিজের হাতে তৈরি করেছে? (যারা এ কর্মনীতি অবলম্বন করেছে) তাদের অন্তরের ওপর আমি আবরণ টেনে দিয়েছি, যা তাদের কুরআনের কথা বুঝতে দেয় না এবং তাদের কানে বধিরতা সৃষ্টি করে দিয়েছি। তুমি তাদের সৎপথের দিকে যতই আহ্বান কর না কেন এ অবস্থায় কখনো সৎপথে আসবে না।’ (সুরা কাহাফ : ৫৭) এ ধরনের লোকেরা উপদেশ বাণীর মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ করে না বরং ধ্বংসের গর্তে পড়ে যাবার পরই এদের নিশ্চিত জন্মে যে এরা যে পথে এগিয়ে চলছিল সেটিই ছিল তাদের ধ্বংসের পথ। তার এ কর্মনীতির ফলে তার পরিবার ও সমাজ নীতিগতভাবে তার অনুসরণ করে।

সবচেয়ে বড় দেউলিয়া হলো, শয়তান। আল্লাহর হুকুম মানতে অবাধ্য হওয়ায় সে কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হলো। আল্লাহর হুকুমের সামনে সে যুক্তি পেশ করলো যে, আমি আদম থেকে শ্রেষ্ঠ, কারণ আমাকে তুমি আগুন থেকে সৃষ্টি করেছো এবং আদমকে মাটি থেকে। তার যুক্তি অগ্রাহ্য হলে সে হতাশ হয়ে পড়লো। এ জন্য তার আরেক নাম হলো, ইবলিস। ইবলিম শব্দের অর্থ চরম হতাশ। আর পারিভার্ষিক অর্থে এমন একটি জিনকে ইবলিস বলা হয় যে আল্লাহর হুকুমের নাফরমানি করে আদম ও আদম সন্তানদের অনুগত ও তাদের জন্য বিজিত হতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। মানবজাতিকে পথভ্রষ্ট করার ও কিয়ামত পর্যন্ত তাদের ভুল পথে চলার প্রেরণা দান করার জন্য সে আল্লাহর কাছে সময় ও সুযোগ প্রার্র্থনা করেছিল। যাই হোক, সে তার যুক্তি আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্যতা না পাওয়ায় সে হতাশ হলো। আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘তিনি বললেন: ‘ঠিক আছে তুই এখান থেকে নিচে নেমে যা। এখানে অহংকার করার অধিকার তোর নেই। বের হয়ে যা। আসলে তুই এমন লোকদের অন্তর্ভুক্ত, যারা নিজেদের লাঞ্ছিত করতে চায়।’ (সুরা আরাফ : ১৩) এভাবে সে দেউলিয়াত্ব জীবন নিয়ে ফিরে যায়।

পক্ষান্তরে হযরত আদম (আ:) শয়তান কর্তৃক প্রতারিত হওয়ার পর যখন নিজের ভুল বুঝতে পারলেন, তখন আল্লাহর ব্যাপারে আরো বেশী আশাবাদী হয়ে উঠলেন। অর্থাৎ তিনি শয়তানের মতো হতাশ না হয়ে আল্লাহর ক্ষমার ব্যাপারে বেশী আশাবাদী হয়ে উঠলেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘তারা দু’জন বলে উঠলো: ‘হে আমাদের রব। আমরা নিজেদের ওপর জুলুম করেছি। এখন যদি তুমি আমাদের ক্ষমা না করো এবং আমাদের প্রতি রহম না করোম তাহলে, তাহলে নিঃসন্দেহে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত বা দেউলিয়াদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবো।’ (সুরা আরাফ : ২৩) এই দু’আর ফলে তিনি ক্ষমাপ্রাপ্তই হন এবং শয়তানের দেউলিয়াত্ব থেকেও রক্ষা পান এবং পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষদের অন্তর্ভুক্ত হন। অর্থাৎ তিনি আল্লাহর রাসুল ও নবীতে পরিণত হলেন।

প্রকৃতপক্ষে শয়তানের পথই হলো দেউলিয়াপনার পথ। আল্লাহর বন্দেগি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তাঁর মোকাবিলায় বিদ্রোহের পতাকা উত্তোলন করা, সতর্ক করা সত্ত্বেও সগর্বে নিজের বিদ্রোহাত্মক কর্মপদ্ধতির ওপর অটল হয়ে থাকা এবং যারা আল্লাহর আনুগত্যের পথে চলে তাদেরও বিভ্রান্ত ও প্ররোচিত করে গোনাহ ও নাফরমানির পথে টেনে আনার চেষ্টা করাই হচ্ছে শয়তানের পথ বা ক্ষতিগ্রস্ত বা দেউলিয়াপনার পথ। পক্ষান্তরে বা বিপরীত পক্ষে মানুষের উন্নতি সমৃদ্ধিশালীর পথ হচ্ছে: প্রথমত: শয়তানের প্ররোচণা ও অপহরণ প্রচেষ্টার মোকাবিলা করতে হবে। তার সকল প্রচেষ্টায় বাধা দিতে হবে। শয়তান মানবতার শুত্রু। তাই নিজের শুত্রুর চাল ও কৌশল বুঝতে হবে এবং তার হাত থেকে বাঁচার জন্য সবসময় সতর্ক থাকতে হবে; কিন্তু এরপর যদি কখনো তার পা আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্য থেকে সরেও যায় তাহলে নিজের ভুল উপলব্ধি করার সাথে সাথেই লজ্জায় অধোবদন হয়ে তাকে নিজের রবের দিকে ফিরে আসতে হবে এবং নিজের অপরাধ ও ভুলের প্রতিকার ও সংশোধন করতে হবে। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অধিকতর সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। ইসলামের দৃষ্টিতে এটিকেই তাওবা বলে।

মানুষের একটি বিষয় খুব ভালো করে বদ্ধমূল করে নিতে হবে যে, মানব সৃষ্টির সূচনাকাল থেকে শয়তান মানুষ সৃষ্টিকে কেন্দ্র করে নিজে পথভ্রষ্ট ও ক্ষতিগ্রস্ত বা দেউলিয়া হয়ে গেছে এবং তখন থেকেই তার জোর প্রচেষ্টা হচ্ছে মানুষকে সে দেউলিয়া বানিয়ে ছাড়বে। তাই শয়তানের পথ হচ্ছে দেউলিয়ার পথ। মানুষের প্রকৃত পথ হচ্ছে আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্যের পথ এবং এ পথেই মানুষের উন্নতি ও সমৃদ্ধি রয়েছে। এটিই ইসলামের মৌলিক শিক্ষা। কিন্তু বর্তমান ইসলামের মৌলিক শিক্ষাকে ভুলে গিয়ে নিজেদের আদি ও চিরন্তন দুশমনের ফাঁদে আটকা পড়েছে। তার কাছে পূর্ণ পরাজয় বরণ করেছে। আল্লাহর হিদায়াতের পরোয়া না করে জিন ও মানুষের মধ্যকার শয়তানদের নিজেদের বন্ধু ও অভিভাবকে পরিণত করেছে। ক্রমাগত সতর্ক বাণী উচ্চারণ করার পরও মানুষ নিজেদের ভুলের ওপর অবিচল থাকার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া মূলত নির্ভেজাল শয়তানি কর্মনীতি ছাড়া আর কিছুই নয়। শয়তানের কাছে পূর্ণ পরাজয় বরণ করেছে। তাই শয়তান যে পরিণতির মুখোমুখি হতে চলেছে, মানুষের এ বিভ্রান্তির পরিণামও তাই হবে। কিয়ামতে কঠিন পরিণতি থেকে বাঁচতে হলে নিজেদের ভুল শুধরিয়ে নিতে হবে, অত্যন্ত সতর্ক হতে হবে। আমাদের আদি পিতা আদম (আ:) ও মা হাওয়া (আ:) পরিশেষে যে পথ অবলম্বন করেছিলেন আমাদেরও সেই একই পথ অবলম্বন করতে হবে।

আবু হুরাইরা (রা:) হতে বর্ণিত আছে, রাসুলুল্লাহ (সা:) প্রশ্ন করলেন, তোমরা কি জানো, দেউলিয়া কে? তারা বললেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা:) আমাদের মধ্যে দেউলিয়া হচ্ছে সেই ব্যক্তি যার দিরহামও নেই, কোনো সম্পদও নেই। রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেন: আমার উম্মতের মধ্যে সেই ব্যক্তি হচ্ছে দেউলিয়া যে কিয়ামত দিবসে সালাত, সাওম, যাকাতসহ বহু আমল নিয়ে উপস্থিত হবে এবং এর সাথে সে কাউকে গালি দিয়েছে, কাউকে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে, কারও সম্পদ আত্মসাৎ করেছে, কারও রক্ত প্রবাহিত করেছে, কাউকে মারধর করেছে ইত্যাদি অপরাধও নিয়ে আসবে। সে তখন বসবে এবং তার নেক আমল হতে এ ব্যক্তি কিছু নিয়ে যাবে ও ব্যক্তি কিছু নিয়ে যাবে। এভাবে সম্পূর্ণ বলার আগেই তার সৎ আমল নিঃশেষ হয়ে গেলে তাদের গুণাহসমূহ তার ওপর চাপিয়ে দেয়া হবে, তারপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (তিরমিযি : ২৪১৮, পর্ব কিয়ামত ও মর্মস্পর্শী বিষয়, পরিচ্ছদ : হিসাব-নিকাশ ও প্রতিশোধ প্রসঙ্গে, আবু ঈসা বলেন এ হাদিসটি হাসান সহীহ, মুসলিম: ৬৩৪৩, কিতাবুল বিররে ওয়াস সিলাহ... বাবু তাহরিমুজ জুলমে)

কিয়ামতের দিন এ কঠিন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের কর্মনীতি ও কর্মপন্থার পরিবর্তন করতে হবে। আল্লাহর নির্দেশিত ও রাসুলুল্লাহ (সা:) কর্তৃক প্রদর্শিত পন্থায় কর্মনীতি গ্রহণ করতে হবে। আবু হুরাইরা (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের সম্ভ্রমহানি বা অন্য কোনো বিষয়ে যুলুমের জন্য দায়ী থাকে, সে যেন আজই তার কাছ থেকে মাফ করিয়ে নেয়, সেদিন আসার পূর্বে যে দিন তার কোনো দীনার বা দেরহাম থাকবে না। সেদিন তার কোনো সৎকর্ম না থাকলে তার যুলুমের পরিমাণ তা তার নিকট হতে নেয়া হবে আর তার কোনো সৎকর্ম না থাকলে তার প্রতিপক্ষের পাপ হতে নিয়ে তা তার ওপর চাপিয়ে দেয়া হবে। (বুখারি : ২৪৪৯, কিতাবুল মাজালিম, বাবু মান কানাত লাহু মাজলামাতুন..., বুখারি ৬৫৩৪, আ’প্র. ২২৭০, ইফা : ২২৮৭)

লেখক : ব্যাংকার।