এখন ডিসেম্বর মাস। বিজয়ের মাস, আর আজ ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস। এ দিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে নতুন এক ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে এবং পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামক একটি ভূখণ্ড শত্রু বাহিনী মুক্ত হয়ে স্বাধীন দেশের মর্যাদা পেয়েছে। এ দিবস উপলক্ষে আমি সকল দেশবাসী, শুভানুধ্যায়ী ও শুভাকাক্সক্ষীদের অভিনন্দন জানাই, মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি এবং তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করি ।

স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের বেশকিছু গর্বিত অর্জন রয়েছে। গত ৫৪ বছরে খাদ্যোৎপাদনের দিক থেকে আমরা প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। ১৯৭১ সালে আমাদের দেশে খাদ্যোৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৯৫ লাখ টন, বর্তমানে তা তিন কোটি টন অতিক্রম করেছে। স্বাস্থ্যসেবা বিশেষ করে শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস, সুপেয় পানির সংস্থান, গড় আয়ুর পরিসর বৃদ্ধি, জিডিপি ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, দারিদ্র্য নিরসন ও জীবন যাত্রার মান বৃদ্ধি প্রভৃতি ক্ষেত্রে আমরা ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছি। সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামো সৃষ্টি, শিল্পায়ন এবং অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও আমাদের সাফল্য উল্লেখযোগ্য।

কৃষিখাতে প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশ্ব মন্দার প্রভাব সত্ত্বেও গত কয়েক দশকে আমাদের প্রবৃদ্ধি হারের ওপর খুব একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। খনিজ ও খনন, ম্যানুফ্যাকচারিং, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সরবরাহ এবং নির্মাণ এ চারটি খাতের সমন্বয়ে গঠিত শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধির হার অক্ষুণ্ন রয়েছে। এ সময়ে আমরা দারিদ্র্য নিরসনের লক্ষ্যে একাধিক কৌশলপত্র প্রণয়ন করেছি এবং তার আলোকে বিভিন্ন প্রকল্প ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে দেশে চরম দারিদ্র্য বহুলাংশে হ্রাস করতে সক্ষম হয়েছি। বলা বাহুল্য, দারিদ্র্য নিরসন কৌশলপত্রের মেয়াদকালে সামষ্টিক অর্থনীতির পরস্পর নির্ভরশীল খাতসমূহের যথাযথ স্থিতি ও সঙ্গতিপূর্ণ বিকাশের মাধ্যমে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য নিরসনের লক্ষে কৌশলপত্রে একটি মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক কাঠামো (Medium Term Macroeconomic Framework-(MTMF) সংযোজন করা হয়। এতে জিডিপি রাজস্ব খাত ও মুদ্রা খাত এবং বহিঃখাতের কার্যকর সংযোগ দেখানো হয়েছে। অর্থ বিভাগ মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামো প্রণয়নের লক্ষ্যে এমটিএমএফকে হালনাগাদ করেছে এবং এতে সামষ্টিক অর্থনীতির সাম্প্রতিক গতিধারা এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও অনিশ্চয়তার সাথে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজনীয় বিষয়সমূহ বিবেচনা করে তিন বছর মেয়াদি সামষ্টিক অর্থনীতির কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ চলকের প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। পাশাপাশি পাঁচশালা পরিকল্পনাকেও ফিরিয়ে আনা হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। যারা মনে করতেন যে, বাংলাদেশ এককভাবে তার অর্থনীতি সামাল দিতে পারবে না তারা হতাশ হয়েছেন। দক্ষিণ এশিয়ার এ দেশটি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তার সাফল্যের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতার পরিমাণও কম নয়। একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে সহায় সম্পদের যেমন আমরা মালিক হয়েছি, ভোগ সমৃদ্ধি আমাদের অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি একই গতিতে আমাদের মানবিক গুণাবলী বিকশিত হয়নি । জাতীয় ঐক্য ও সংহতির সকল উপসর্গ মনে হচ্ছে যেন আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছে।

রাজনৈতিক মতভেদ রাজনৈতিক শত্রুতায় পর্যবসিত হচ্ছে এবং শিষ্টাচার সমাজ থেকে বিদায় নিচ্ছে। দেশ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে এবং এর সুযোগ নিচ্ছে স্বার্থপর আমলা, সমাজবিরোধী ব্যক্তি ও গোষ্ঠী এবং দেশের ভেতর বাইরের শত্রুরা। আমাদের বাকস্বাধীনতা, মতামতের স্বাধীনতা, মৌলিক মানবাধিকার এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রভৃতি পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না। হিংসা, বিদ্বেষ, হত্যা, গুম, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, ব্যভিচার, নারী নির্যাতন প্রভৃতি আমাদের সমাজ ব্যবস্থাকে এমনভাবে পর্যুদস্ত করে তুলেছে যে আমরা মাঝেমধ্যে আমাদের পরিচয় সম্পূর্ণভাবে ভুলে যাই, আমাদের মনেই হয় না যে, এ সমাজেই আমরা শান্তি ও সৌহার্দের সাথে বসবাস করেছিলাম এবং আমাদের মধ্যে রাজনৈতিক মতভেদ থাকলেও তা কখনো শিষ্টাচারকে লংঘন করেনি এবং একে অপরকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার মানসিকতা সৃষ্টি করেনি। আওয়ামী ফ্যাসিস্ট আমলে এমন দিন ছিল না যে দিন দেশের কোনো না কোনো স্থানে হত্যা, গুম, সন্ত্রাস, ব্যভিচার, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেনি। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ইদানিং নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছি। হামলা-মামলার কারণে বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীরা নিজ বাড়িতে থাকতে পারেনি। স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে চোরের মতো পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কাছে সকলেই ছিল অসহায়। এর সাথে যোগ হয়েছিল ধর্ম বহির্ভূত ও তথাকথিত ধর্মের নামে সন্ত্রাস। এ সন্ত্রাস সর্বত্র; হাটে মাঠে ঘাটে সমাজের অভিজাত এলাকায়। মদ, জুয়া, নাইট ক্লাবের অশ্লীল নৃত্য ও অনৈতিক কাজ যা আগে কখনো ছিল না। এ সময়ে তা এতোই মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল যে, তা বন্ধ করে সমাজকে দূষণমুক্ত করার জন্য উচ্চ আদালতকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নির্দেশনা জারি করতে হয়। দুর্নীতি আমাদের সমাজব্যবস্থার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো লুটপাটের আখড়ায় পরিণত হয়। সরকারি ব্যাংকগুলোর লাখ লাখ কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং লক্ষ-কোটি টাকার অধিক খেলাপী ঋণ আমাদের অর্থখাতের জন্য এক বিরাট কলঙ্ক। এর ওপর রাজ কোষের টাকা চুরির সাথে এবং ঘটনার সংশ্লিষ্টদের কারোর শাস্তি না হবার ঘটনা এটাই প্রমাণ করে যে, জাতীয়ভাবে নৈতিকতার দিক থেকে আমরা দেউলিয়া হয়ে পড়েছি। এ দেউলিয়াত্ব নিরসনের কোনো উদ্যোগ নেই, যারা উদ্যোগ নেন তারা স্বাধীনতা বিরোধী বলে চিহ্নিত হন। আমাদের সকল সুকুমার বৃত্তিগুলো যদি বিপক্ষ শক্তির হয় তাহলে পক্ষ শক্তির কি আছে? বিজয়ের ৫৪ বছর পূর্তি উপলক্ষে এই বিষয়গুলো আমাদের ভেবে দেখা দরকার। জুলাই অভ্যুত্থানের পর এখন দেশ গড়ার নতুন একটা সুযোগ আমরা পেয়েছি। ফ্যাসিস্টরা এখন পলাতক।

আজকের দিনে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় সমস্যা। দল-মত নির্বিশেষে গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনাই আজ বিজয়ের মাসে আমাদের প্রধান অঙ্গীকার হওয়া উচিত। আমি এর আগেও একাধিকবার বলেছি যে, গণতান্ত্রিক সমাজের ন্যূনতম পাঁচটি বৈশিষ্ট্য থাকে। এগুলো হচ্ছে :

১) সরকার পরিচালনায় ব্যক্তির সক্রিয় অংশগ্রহণ । আইনসভা, বিধানসভা অথবা সংসদ অথবা স্থানীয় পরিষদ যে প্লাটফর্মই হোক না কেন তাতে প্রতিটি নাগরিকের প্রতিনিধি প্রেরণের অধিকার রয়েছে। সমাজের উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির ব্যাপারে প্রত্যেক ভোটারের একটা দায়বদ্ধতা থাকে। সরকার ব্যবস্থায় তার অবস্থান এমন পর্যায়ে থাকা বাঞ্ছনীয় যা তার ভূমিকা পালনে তাকে ফলপ্রসূভাবে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। অভিজ্ঞতা এবং অতীতের ভুলভ্রান্তি থেকে শিক্ষাগ্রহণ গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য।

২) গণতন্ত্র এমন একটি সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করে যেখানে প্রত্যেকটি মানুষ তার কল্যাণ ও সন্তুষ্টির জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ পায়। এখানে একজনের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আরেকজনের অধিকার হরণ অথবা তার ভোগ বাধাগ্রস্ত করা যায় না ।

৩) গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতা অথবা নেতৃত্ব প্রত্যভিযোজনের মাধ্যমে ভাগাভাগি করে দেয়া হয়। নেতৃত্বের ধরন, প্রকৃতি ও উদ্দেশ্যাবলী নির্বাচকমন্ডলীই নির্ণয় করেন। গণতান্ত্রিক সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠের সরকার। নির্বাচিত নেতা-নেত্রীরা ব্যক্তির তথা ভোটারদের উদ্যোগকে শক্তিশালী করার জন্য দায়বদ্ধ থাকবেন। যারা এটা না করে নিজেদের হাতকে শক্তিশালী করে ক্ষমতার স্বাদ ভোগ করতে চান তারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অভ্যন্তরেই ফ্যাসিবাদ কায়েম করেন ।

আর ‘বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়ে যদি তারা দেশ শাসন করেন তাহলে তো ফ্যাসিবাদ আরো মাত্রা ছাড়িয়ে যায়! মানুষের তৎপরতা ও চিন্তা-চেতনার বিভাজন ও নিয়ন্ত্রণ যেমন গণবিরোধিতায় রূপ নেয় তেমনি কর্তব্যের কথা বিবেচনা না করে দলীয় নেতা-নেত্রীর ক্ষমতা বৃদ্ধি সংখ্যালঘিষ্ঠের শাসনকে ডেকে আনে যা গণতন্ত্রের জন্য কখনো শুভ হয় না। এ ব্যাপারে আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে।

৪) গণতন্ত্রে নেতৃত্ব হচ্ছে একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে অথবা সর্বজন স্বীকৃত কোনো লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য মানুষকে দিকনির্দেশনা দেয়ার ক্ষমতার নাম। পরিস্থিতি মোকাবেলা, গণদাবি নস্যাৎ, স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা কিংবা লক্ষ্য অর্জনের পরিপন্থী কোনো গন্তব্যে নেয়ার অধিকার কোনো নেতৃত্বের নেই। দেশ ও জাতিকে বিভক্ত করা অথবা মানুষের ভাবাবেগকে কাজে লাগিয়ে এমন কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি করা. যা জাতি ও দেশের জন্য ভয়ঙ্কর পরিণতি ডেকে আনে তাও এখানে কাম্য নয়। এখানে মেজোরিটি ও মাইনোরিটি সমান অধিকার ভোগ করে ।

৫) গণতান্ত্রিক সমাজে নিয়ন্ত্রণ নৈর্ব্যক্তিক এবং আইনের মাধ্যমে তা প্রয়োগ করা হয় । বিক্ষুব্ধরা এর প্রতিবাদ করতে পারেন এবং তাদের এ প্রতিবাদ গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বাধীনতার চেতনা থেকে উৎসারিত হয়। সরকার ও বিরোধী উভয়পক্ষকে এই বিষয়টি মেনে নিতে হয়। যারা নেতা বা নেত্রী তারা সংকীর্ণ হতে পারেন না।

গণতান্ত্রিক সমাজের উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো আমাদের দেশে অনুপস্থিত । ফলে যে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের স্বপ্ন নিয়ে আমরা দেশের স্বাধীনতা এনেছি তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে। এ অবস্থায় প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি পর্যালোচনা করে সঠিক পথ নির্ণয় করা জরুরী হয়ে পড়েছে বলে আমার বিশ্বাস।

সর্বশেষ একটা কথা জরুরী বলে মনে করি। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের সিডিউল ঘোষণা আমাদের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে সন্দেহ নেই। তবে গত শুক্রবার বাদ জুমা ইনকিলার মঞ্চের মুখপত্র ও ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী শরীফ ওসমান হাদির উপর গুলি বর্ষণ পুরো জাতিকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। প্রশ্ন উঠেছে আদৌ কি আমরা শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করতে পারবো? পতিত আওয়ামী লীগ একটি বিদেশী শক্তির সহায়তায় ইতোমধ্যে আমীরে জামায়াত ডা. শফিকসহ ৫০ জনের একটি হিট লিষ্ট তৈরি করেছে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর সর্বোচ্চ সতর্কতা প্রয়োজন। নির্বাচনের আগে সন্ত্রাসীদের দমন ও দেশব্যাপী অস্ত্র উদ্ধার অভিযান পরিচালনা জরুরী।