(দ্বিতীয় কিস্তি)
১৯২১ সাল থেকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের গতি বৃদ্ধি পায়। এ আন্দোলনে অন্যদের সঙ্গে সামনের সারিতে ছিলেন মহম্মদ আলি, শওকত আলি, আবুল কালাম আজাদ, হাকিম আজমল খাঁ প্রমুখ। ১৯২১ সালের ৮ জুলাই নিখিল ভারত খিলাফত সম্মেলন থেকে ইংরেজ শাসকের অধীনে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কর্মরত মুসলমান সৈনিকদের কর্মস্থল থেকে পদত্যাগের আহ্বান জানানো হয়। সরকার বিরোধী ঘোষণার জন্য ১৯২১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর মহম্মদ আলিকে গ্রেফতার করা হয়। অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নিয়ে আবুল কালাম আজাদ, শওকত আলি প্রমুখ গ্রেফতার হন। সত্যাগ্রহ আন্দোলন বিস্তারের লক্ষ্যে গান্ধী দেশের নানা অঞ্চলে ‘সত্যাগ্রহ সভা’র শাখা স্থাপন করেছিলেন। উত্তরপ্রদেশে সত্যাগ্রহ সভা চালান মহম্মদ আলি, শওকত আলি, আব্দুল কবি সৈয়দ হুসেন প্রমুখ নেতা। লাহোরে সত্যাগ্রহ সভা যাঁরা পরিচালনা করেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সৈফুদ্দিন কিচলু।
রাউলাট আইনের বিরুদ্ধে ভারতবাসী গর্জে উঠেছিলেন। রাউলাট বিল আইনে পরিণত হওয়ার প্রতিবাদে আইন পরিষদের সভ্যপদ থেকে জিন্নাহ, মাজহারউল হক প্রমুখ পদত্যাগ করেছিলেন। রাউলাট আইনের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে সভা, সমাবেশ হয়েছিল। সরকার সাইফুদ্দিন কিচলুসহ বেশ কয়েকজনের প্রকাশ্য জনসভায় বক্তৃতা বন্ধের আদেশ দিয়েছিল। ১৯১৯ সালের ১০ এপ্রিল সাইফুদ্দিন কিচলুকে অমৃতসর শহর থেকে বহিষ্কারের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে আব্দুল বারী একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। ১৯২০ সালের জুন মাসে লক্ষেèৗয়ে আব্দুল বারী এক ফতোয়া জারি করে বলেছিলেন, ভারত দার-উল-হরব বা যুদ্ধরত দেশ। ভারতের মুসলিমদের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য জেহাদ অর্থাৎ ধর্মযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত। এরা যদি ব্রিটিশ সরকারের মোকাবিলা না করতে পারে, তাহলে তারা যেন এদেশ থেকে হিজরত করে বাইরে চলে যায়। এরা যেন মুসলিম দেশগুলোর সহযোগিতায় ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াই করে। আব্দুল বারীর এ ফতোয়ায় ভারতের মুসলমানদের অনেকের মধ্যে প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছিল। এ ফতোয়াকে মান্যতা দিয়ে কেবলমাত্র সিন্ধু, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে দলে দলে মুসলমান স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেওয়ার জন্য দেশ থেকে হিজরত করে বাইরে চলে গিয়েছিলেন। আব্দুল গফফার খানও এ আন্দোলনে দেশ ছেড়ে কাবুলে চলে গিয়েছিলেন। মোপলা বিদ্রোহ আর এক বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের অধ্যায়। এ বিদ্রোহে কখনই সাম্প্রদায়িক উপাদান ছিল না। এটি ছিল ব্রিটিশ বিরোধী লড়াই।
১৯২১-র অসহযোগ আন্দোলনে আব্দুল হালিম যোগ দিয়েছিলেন। তিনি কয়েক বছর আন্দামানে দ্বীপান্তরিত হয়েছিলেন। হিজলি বন্দি শিবিরেও তিনি কাটিয়েছিলেন। ১৯২২ সালে পাঞ্জাবে অনুষ্ঠিত মহিলা সম্মেলনে ভাষণ দেওয়ার অপরাধে বাই আম্মান মীরাটে গ্রেফতার হয়ে দু’বছর কারাবাস করেছিলেন। ১৯২১ সালের নভেম্বর মাসে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত জমিয়াত-উল-উলেমার সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেছিলেন শেখ উল হিন্দ মাহমুদ আল হাসান। তিনি তাঁর সমাপ্তি ভাষণে ভারতের স্বাধীনতা লাভের জন্য নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
১৯২২ সালে চৌরিচৌরার ঘটনায় মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত শহীদদের মধ্যে ছিলেন আবদুল্লা ও লাল মহম্মদ। মৌলানা শওকত আলি ও মৌলানা মহম্মদ আলি মহাত্মাজির আহ্বানে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন ও উচ্চবেতনের চাকরি ত্যাগ করেছিলেন। অসহযোগ আন্দোলনের ব্যর্থতার কিছুদিন পর থেকেই ব্রিটিশ বিরোধী তৎপরতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিপ্লবীদের কাজ চালানোর জন্য প্রয়োজন হয় অর্থের। ১৯২৫ সালের ৯ আগস্ট কাকোরি ও আলম নগরের মাঝামাঝি স্থানে ট্রেন ডাকাতি হয়। ১৯২৬ সালের ৪ জানুয়ারি ২৫ জন ধরা পড়েন। ২৩ জনের নামে মামলা ওঠে ১৯২৬-র ১৬ এপ্রিল। যাঁদের নামে মামলা হয়েছিল তাঁদের মধ্যে অন্যতম আসফাকুল্লাহ খান ছিলেন (সাহারানপুর)-১৯২৭ সালের ৬ এপ্রিল। মৃত্যুদণ্ডে যাঁরা দণ্ডিত হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আসফাকুল্লাহ। ১৯ ডিসেম্বর ফৈজাবাদ জেলে আসফাকুল্লাহর ফাঁসি হয়। তিনি ছিলেন সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বিরুদ্ধে। তাই তিনি বিভেদের বিরুদ্ধে ডাক দিয়ে বলেছিলেন, ‘এই বিবাদ পিছনে ফেলে এসো, আরও কাছাকাছি হও। হিন্দু ও মুসলিম অচেনা লাগে তোমাদের এই ভেদাভেদ।’
জাতীয় মুক্তির আন্দোলনে ওবায়দুল্লাহ সিন্ধি একটি উল্লেখযোগ্য নাম। তিনি মাহমুদ আল হাসানের কাছ থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজমন্ত্র গ্রহণ করেছিলেন। ওবায়দুল্লাহ ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের কাবুল কমিটির সভাপতি ছিলেন। ১৯২৫ সালে স্বাধীন ভারতের একটি খসড়া গঠনতন্ত্র প্রকাশ করেন।
ভারতীয় উপমহাদেশে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে আলেম সমাজও অসামান্য অবদান রেখেছিলেন। সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থান্বেষী মহলের মুখোশ উন্মোচন করে জাতিকে সর্বদা সচেতন রাখতে অতন্দ্র প্রহরীর মতো সোচ্চার সংগ্রামী আলেম সমাজ। স্বাধীনতার জন্য তারা নির্দিধায় জীবন বিসর্জন দিতেও দিধাবোধ করেন নি। কখনো সংকোচ, সংশয়বোধ করেন নি কারাবরণ কিংবা শত্রুর দুরভিসন্ধিতে। যদি আলেম সমাজ স্বাধীনতা সংগ্রামে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন না করত, তাহলে ভারত বর্ষের স্বাধীনতা এত সহজে আসতো না। কারণ, আলেম সমাজের শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত আছে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের তাজা খুন। অন্যায়-অবিচার, যুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে মূর্ত আতঙ্ক আলেম সমাজ। আমরা দেখতে পাই ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আলেম সমাজের দৃঢ় চেতনা ও দুর্বার গতি। দীপ্ত মশাল জ্বালিয়ে অন্যায়, যুলুম ও অবিচারের বিরুদ্ধে মর্দে মুজাহিদের মতো রুখে দাঁড়ান আলেমসমাজই। সময়ের দাবিতে আলেম সমাজ কখনো বিপ্লবী বক্তব্য, ক্ষুরধার লেখনী, সভা-সেমিনার বিভিন্ন প্রকাশনা ও পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ইতিহাসের পাঠকমাত্রই উপলব্ধি করতে পারেন, উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের মহানায়ক আল্লামা শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিছ দেহলবী রহিমাহুল্লাহ সম্পর্কে। ব্রিটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে পাহাড়সম দৃঢ়চেতা আর দুর্বার সাহসের এক মূর্ত প্রতীক ছিলেন শায়খুল হিন্দ শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিছ দেহলবী রহিমাহুল্লাহ। ব্রিটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে তার ফৎওয়া ছিল সারা দুনিয়াজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী। ফলে মানুষ তার ফতওয়ায় আকৃষ্ট হয়ে ব্রিটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ চালায়। ব্রিটিশ শাসন ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে জন্ম নেয় জিহাদী আন্দোলন। ইতিহাসে আবির্ভাব হয় শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুজাহিদ শাহ ইসমাঈল শহীদ রহিমাহুল্লাহ। ১৮৩১ সালে বালাকোট প্রাঙ্গণে শাহ ইসমাঈল শহীদ জীবন উৎসর্গ করে পৃথিবীর এক নতুন অধ্যায় রচনা করেন। শাহ সাহেবের এ আপসহীনতার প্রভাব বাংলায় পড়ার কারণে বাংলার ইতিহাসেও জন্ম নেয় বীর সন্তান মাওলানা হাজী শরীয়ত উল্লাহ, নিসার আলী তিতুমীর, টিপু সুলতানসহ অনেকে। যাদের একেকটি নাম একেকটি জীবন্ত ইতিহাস। একেকটি গর্ব ও অহংকারের বিজয়ী নাম। স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য আলেমগণ গর্জে ওঠায় বৃটিশ বেনিয়ারা আতঙ্কিত হয়। ফলে মুজাহিদদের এ উত্তাল তরঙ্গমালাকে স্তিমিত করার জন্য বৃটিশ বেনিয়ারা চালায় অসহনীয় নির্যাতনের স্টিম রোলার, জেল আর যুলুম। অনেককে ঝুলায় ফাঁসিকাষ্ঠে । তবুও আপসহীন এ আলেম সমাজ তাদের সাথে আপস করেননি বরং তারা হাসিমুখে শহীদী মর্যাদা লাভের আশায় আল্লাহর রাহে জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। মূলত ১৭৫৭ সালের পলাশীর ট্রাজেডিতে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয় মীর জাফরদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে। পলাশীর ঐ ট্রাজেডির পর যখন ইংরেজরা উপমহাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করল, তখন এর তীব্র প্রতিবাদ করেন আল্লামা শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলবী রহিমাহুল্লাহ ও তার ছেলে শাহ আব্দুল আযীয দেহলবী রহিমাহুল্লাহ। ইতিহাসের পাতা লক্ষ আলেমের লাল রক্তে রঞ্জিত হয়ে আছে। খোদ দিল্লিতেই ৫শ আলেমকে ফাঁসি দেয় ইংরেজরা।
১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে ২ লক্ষ মুসলিম শহীদ হন। ১৮৩১ সালের বালাকোটের যুদ্ধে শাহ ইসমাঈল শহীদের শাহাদাতবরণের পর আবির্ভাব হয় ইতিহাসখ্যাত জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মাওলানা এনায়েত আলী ও মাওলানা বেলায়েত আলীর। ইতিহাস খুব গৌরব অর্জন করেছে এ সকল মর্দে মুজাহিদের নাম লিপিবদ্ধ করে। ভারতীয় উপমহাদেশের বুক থেকে ইংরেজদের চিরতরে বিদায় দেয়ার জন্য বাংলার সুযোগ্য সন্তান ও বীর মুজাহিদ টিপু সুলতানও কিন্তু কম প্রচেষ্টা চালাননি। মাওলানা হাজী শরীয়ত উল্লাহ ফরায়েজীর আহ্বানে যাত্রা হয় ফরায়েজী আন্দোলন। মূলত এ আন্দোলনের কারণ হলো ইংরেজদের ইসলামবিদ্বেষী রীতি-রেওয়াজ ও ধর্ম পালনে হস্তক্ষেপ। হাজী শরীয়তুল্লাহর নেতৃত্ব ইতিহাসের পাতায় রচিত হয় আরেকটি নতুন অধ্যায়। জন্ম নেয় বাঁশের কেল্লা খ্যাত মর্দে মুজাহিদ, স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক সাইয়েদ নেসার আলী তিতুমীর। জিহাদী আন্দোলনের তিতুমীর বাংলার প্রথম শহীদ। আবির্ভূত হন মাওলানা আকরাম খাঁ, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মাওলানা আব্দুল্লাহেল কাফী আল-কোরায়শী রহিমাহুমুল্লাহসহ অনেকে। তাদের নিরলস ত্যাগ-তীতিক্ষা, কুরবানি ও আপসহীন সংগ্রামী চেতনায় ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়। অবসান ঘটে ১৯০ বছরের গোলামীর।
ঔপনিবেশিক শাসকরা মুসলমানদের হাত থেকেই ক্ষমতা কেড়ে ছিলো। তাই তারা ইংরেজদের কাছ থেকে অধিক জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। সঙ্গত কারণেই মুসলমানরাই বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে অগ্রসৈনিকের ভূমিকা পালন করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে ‘Indian Musalmans’ গ্রন্থে উইলিয়াম হান্টার লিখেছেন, ‘মুসলিম বিপ্লবীদের লড়াই ভারতের আদিমতম এবং সব থেকে দীর্ঘস্থায়ী ও অধিক ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইগুলির মধ্য অন্যতম’।
আর নির্মম গণহত্যায় ব্রিটিশদের মূল টার্গেট ছিল মূলত মুসলিমরাই। কারণ বহু ব্রিটিশ মনে করত যে, মূলত ইসলামী জিহাদ এবং মুসলিমরাই সকল বিদ্রোহের নায়ক। এ প্রসঙ্গে ব্রিটিশ লেখক হেনরি মিডের বক্তব্য হলো ‘This rebellion, in its present phase, cannot be called a sepoy Mutiny. It did begin with the sepoys, but soon its true nature was revealed. It was an Islamic revolt.
’ জনৈক সমসাময়িক ঐতিহাসিক মুসলিমদের সংগ্রাম বিষয়ে লেখেন, ‘প্রতিটি ইংরেজের অভ্যাসই হয়ে গিয়েছিল যে, তাঁরা প্রত্যেক মুসলিমকেই বিদ্রোহী মনে করত। প্রত্যেক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করত সে হিন্দু না মুসলিম। উত্তরে মুসলিম শুনলেই গুলী চালাত’। কিন্তু এতো ত্যাগ ও কুরবানির পরও মুসলিমরা ভারতীয় হয়ে উঠতে পারেন নি বরং তারা এখন ভারতবর্ষে নিপীড়িত, নিগৃহীত ও অত্যাচারিত। ভারতের অনেকেই মুসলমান আর সন্ত্রাসবাদকে একাকার করে ফেলেছে।
ভারতে উগ্রবাদীদের উত্থানে মুসলিম শাসকদের নিয়ে নানাবিধ বিষোদগার করা হয়ে থাকে। কিন্তু ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় ভারতে মুসলিম শাসন ছিলো ইতিহাসের স্বর্ণযুগ। মূলত অষ্টম শতাব্দীতে (৭১২ খ্রীঃ) ইমাদ উদ্দীন মুহাম্মদ বিন কাশিমের নেতৃত্বে মুসলমানদের সিন্ধু বিজয়ের পর ভারতে ইসলামী সাম্রাজ্য শুরু হয়। ইসলামী সভ্যতা ভারতীয় উপমহাদেশের বেলুচিস্তান এবং সিন্ধু অঞ্চলে উপস্থিত হয়। মুসলিম সভ্যতা আসার পর দশম থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত দিল্লী সুলতান ও মুঘল সাম্রাজ্য উত্তর ভারত শাসন করে। মূলত, ৭১৫-৭৪২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী মুসলিম সরকার ছিল না। মাঝখানে ২৫০ বছর পর যেসব মুসলিম ভারতে আসেন তারা আরব নন বরং তারা নবদীক্ষিত তুর্কী মুসলিম। গজনী বংশের আলপ্তগীন-এর শাসন ৯৬২-৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। সবুক্তগীন-এর শাসন ৯৭৭-৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। সুলতান মাহমুদ ৯৯৭-১০৩০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। গজনী বংশের শাসনকাল ছিল ১১৮৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। মোট শাসক সংখ্যা ছিল ১৬ জন। গজনী বংশের সর্বশেষ শাসক মালিক খসরু। শিহাবুদ্দীন মুহাম্মাদ ঘুরী ১১৮৬ খ্রিষ্টাব্দে সর্বশেষ শাসক মালিক খসরু ঘুরী-এর নিকট আত্মসমর্পণ করেন। পরে গজনীর সিংহাসনে বসেন। ১১৭৩ খ্রিষ্টাব্দে গজনী ঘোরের শাসনাধীনে আসে। ১২০৩ খ্রিষ্টাব্দে গিয়াস উদ্দীন-এর মৃত্যুর পর সিংহাসনে আরোহণ করেন মুঈজ উদ্দীন মুহাম্মাদ ঘুরী। ভারতবর্ষে তিনিই মুহাম্মাদ ঘুরী নামে পরিচিত।
১১৯২ খ্রিষ্টাব্দে তরাইনে দ্বিতীয় যুদ্ধের মাধ্যমে ভারতে স্থায়ী মুসলিম শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। এ বংশে ৫ জন শাসক ছিলেন ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। দাস বংশ শাসন করেন ১২০৬-১২৯০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত, ৮৪ বছর। কুতুব উদ্দীন আইবেক ১২০৬-১২১০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। আরাম শাহ ১২১০-১২১১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। ইলতুৎমিশ ১২১১-১২৩৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। রুকন উদ্দীন ফিরোজ শাহ ১২৩৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। সুলতানা রাজিয়া ১২৩৭-১২৪০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত, ৩ বছর। বাহরাম শাহ ১২৪০-১২৪২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত, ২ বছর। মাসুদ শাহ ১২৪২-১২৪৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। নাসির উদ্দীন বলবন ১২৪৬-১২৬৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। গিয়াস উদ্দীন বলবন ১২৬৬-১২৮৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। কায়কোবাদ ১২৮৭-১২৮৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। এ বংশে মোট ১২ জন শাসক ছিলেন। খিলজী বংশ ১২৯০-১৩২০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত, ৩০ বছর। তুঘলক বংশ ১৩২০-১৪১৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত, ১০৭ বছর। মোট শাসক ৮ জন। সৈয়দ বংশের শাসন ১৪১৪-১৪৫১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। সৈয়দ বংশের শাসক সংখ্যা ৪ জন। লোদী বংশের শাসন ১৪৫১-১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত, শাসক সংখ্যা ৩ জন। মুঘল শাসন ১৫২৬-১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের মাধ্যমে মূলত মুঘল শাসনের যবনিকাপাত শুরু হলেও নামমাত্র শাসক ছিলেন মুঘল বংশের। সর্বশেষ মুঘল শাসক দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফর।
মুঘলদের মধ্য থেকে পর্যায়ক্রমে শাসক ছিলেন জহিরউদ্দীন মুহাম্মাদ বাবর (১৫২৬-১৫৩০ খ্রিষ্টাব্দ), নাসির উদ্দীন মুহাম্মাদ হুমায়ূন (১৫৩০-১৫৪০), শেরশাহ (১৫৪০-১৫৫৫ খ্রিষ্টাব্দ), হুমায়ূন ১৫৪০ সালে শেরশাহ কর্তৃক সিংহাসনচ্যুত হন। ১৫৫৫ সালের ২২ জুন সেরহিন্দের যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে তিনি আবার সিংহাসন পুনরুদ্ধার করেন), হুমায়ূন (১৫৫৬-১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ, ২য় মেয়াদ), জালালুদ্দীন মুহাম্মাদ আকবর (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দ), নূরুদ্দীন মুহাম্মাদ সেলিম জাহাঙ্গীর (১৬০৫-১৬২৭), শাহাবুদ্দীন মুহাম্মাদ খুররাম শাহজাহান (১৬২৭-১৬৫৮ খ্রিষ্টাব্দ), মহিউদ্দীন মুহাম্মাদ আওরঙ্গজেব (১৬৫৮-১৭০৭ খ্রিষ্টাব্দ), কুতুব উদ্দীন মুহাম্মাদ মোয়াজ্জেম শাহ আলম বা প্রথম বাহাদুর শাহ (১৭০৭-১৭১২ খ্রিষ্টাব্দ), মাজউদ্দীন জাহান্দার শাহ বাহাদুর (১৭১২-১৭১৩ খ্রিষ্টাব্দ), ফররুখ শিয়ার (১৭১৩-১৭১৯ খ্রিষ্টাব্দ), রফী-উদ-দারাজাত (১৭১৯ খ্রিষ্টাব্দ), রফী-উদ-দৌলা দ্বিতীয় শাহজাহান (১৭১৯ খ্রিষ্টাব্দ), রওশান আকতার বাহাদুর মুহাম্মাদ শাহ (১৭১৯-১৭৪৮ খ্রিষ্টাব্দ), আহমদ শাহ বাহাদুর (১৭৪৮-১৭৫৪ খ্রিষ্টাব্দ), আযীযুদ্দীন (১৭৫৪-১৭৫৯ খ্রিষ্টাব্দ), মহী-উল-মিল্লাত (১৭৫৯-১৭৬০), দ্বিতীয় শাহ আলম আলী গওহর (১৭৬০-১৮০৬ খ্রিষ্টাব্দ), দ্বিতীয় আকবর শাহ (১৮০৬-১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দ) এবং দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফর (১৮৩৭-১৮৫৭/১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দ)।
মুসলিম শাসকরা দীর্ঘ পরিসরে ভারত শাসন করলেও তাদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার কোন অভিযোগ ছিলো না বরং তারা ছিলেন নিজ ধর্মে বিশ্বাসী, পরধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও অসাম্প্রদায়িক শাসক। মুসলিম শাসনামলে ভারতীয় সমাজ থেকে ধর্মান্ধতা, সংকীর্ণতা ও কুসংস্কার দূর করা হয়েছিলো। রহিত করা হয়েছিলো অমানবিক ও মানবতাবিরোধী সতীদাহ প্রথাও। মুসলিম শাসকদের বহিরাগত দাবি করা হলেও অধিকাংশ মোঘল সম্রাটই ভারতীয় ছিলেন। ভারতের উগ্রবাদী রাজনীতি ও ধর্মান্ধতার উত্থানে মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে। এমনকি মৃত ব্যক্তির ওপর প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার মহড়াও তারা প্রদর্শন করতে কুন্ঠাবোধ করছে না। সে ধারাবাহিকতায় ভারতের আওরঙ্গবাদে সম্রাট আওরঙ্গজেবের সমাধি ধ্বংসের আবদারও তুলেছে উগ্রবাদীরা। অথচ এ মোঘল সম্রাটের আমলেই ভারতবর্ষের অর্থনীতি মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। পরিসংখ্যান অনুযায়ী সে সময় ভারতের মোট জিডিপি ছিলো পুরো বিশ্বের জিডিপির এক-চতুর্থাংশ। মূলত, মুসলিম শাসকরাই ভারত বর্ষকে অনিন্দসুন্দর করে গড়ে তুলে সুশাসন উপহার দিতে পেরেছিলেন। মূলত, ভারতের মুসলিম শাসকরা ছিলেন অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মপ্রাণ। মুসলিম শাসকরা সাম্প্রদায়িক বা হিন্দু বিদ্বেষী হলে ভারতবর্ষে হিন্দুদের কোন অস্তিত্বই থাকতো না।
এছাড়াও ভারত উপমহাদেশে ৮শ বছরের ইতিহাসে মুসলিমদের গৌরবদীপ্ত অবদান রয়েছে। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকাচার ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবনধারায় মুসলিমদের প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। উপমহাদেশের জাতীয় উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ক্রমবিকাশ ধারায় মুসলিমদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও দেশমাতৃকার মুক্তি সংগ্রামে তাঁদের নজিরবিহীন আত্মদান ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যদিও মুসলিম-বিদ্বেষীরা প্রচার করে থাকে মুসলিমরা আগ্রাসী, লুটেরা, হত্যাকারী ইত্যাদি। কিন্তু এ অভিযোগ কাল্পনিক ও সংকীর্ণ মানসিকতা প্রণোদিত। এসবের কোন ঐতিহাসিক সত্যতা নেই।
ভারতবর্ষ ৮শ বছর মুসলিম শাসনাধীন ছিলো। তারা ভারতবর্ষে সুশাসন উপহার দিয়েছেন। তখন ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার কোন স্থান ছিলো না। শাসকরা নিজেরা ধার্মিক হলেও পরধর্মের প্রতি ছিলেন অনেক সহনশীল। মুসলিম শাসকরা হিন্দুদের মন্দির স্থাপনসহ বিভিন্ন ধর্মের উপাসনালয় স্থাপনে সার্বিক সহযোগিতা দিয়েছেন। এমনকি মুসলিম শাসকরা নিজ নিজ ধর্ম পালনে ভারতীয়দের উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে গেছেন। কিন্তু মুসলমানরা ক্ষমতা হারানোর পর পুরো দৃশ্যপটই পাল্টে গেছে। ঔপনিবেশিক শাসন চক্র হিন্দু-মুসলিমদের মুখোমুখি দাঁড় করানোর জন্যই বিভিন্ন কল্পকাহিনী রচনা করেছে। তারপর হিন্দু-মুসলিম ঐক্যবদ্ধ হয়ে বৃটিশ শাসনকে বিতাড়িত করেছে।
মূলত, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলমানরাই অগ্রসৈনিকের ভূমিকা পালন করেছে। দেশ বিভাগের পর মুসলমানরা ভারতেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এক্ষেত্রে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। মিসাইলম্যান খ্যাত পরমাণু বিজ্ঞানী এ জি জে আব্দুল কালাম ভারতকে পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত করেছেন। তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতির পদও অলঙ্কৃত করেছিলেন। এছাড়াও জাকির হুসেইন, মুহাম্মদ হিদায়াতউল্লাহ ও ফখরুদ্দীন আলী আহমেদ প্রমুখ ছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি। আব্দুল হামিদ আনসারীও ভারতে উপরাষ্ট্রপতির পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন। এছাড়াও মুহাম্মদ হিদায়াতুল্লাহ, মির্জা হামিদুল্লাহ বেগ, আজিজ মুসাব্বের আহমাদি ও আলতামাস কবির প্রমুখ মুসলিমরা ভারতের প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করে।
মূলত, ভারতীয় মুসলমানরা দেশ ও জাতির জন্য অসামান্য অবদান রাখলেও উগ্রবাদীরা তাদের অবদানকে কোনভাবেই স্বীকার করেনি বরং সাম্প্রদায়িক মানসিকতা, ধর্মান্ধতা ও ঘৃণার রাজনীতির কারণে তাদের যাবতীয় অবদানকে অস্বীকার করেছে ধর্মের নামে। কিন্তু তারা যা করছে সেসবের সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই বরং পুরোটাই অধর্ম। তারা ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক ভারতে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার জন্য মুসলমানদেরকে বলির পাঁঠা বানিয়েছে। তাই কর্নেল সোফিয়া কোরেশী, ঝন্টু শেখ আর ইমতিয়াজরা দেশের জন্য যতই প্রাণপাত করুন না কেন তারা কখনোই ভারতীয় হতে পারবেন না বরং দিন শেষে তারা অনুপ্রবেশকারী, আগ্রাসী ও সন্ত্রাসী! ভারতের উগ্রবাদী রাজনীতিতে এটাই বাস্তবতা! তাই ভারতকে ঐক্যবদ্ধ ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সুরক্ষিত রাখতে হলে সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতান্ত্রিক আদর্শকে আঁকড়ে ধরে অসাম্প্রতিক ভারত বিনির্মাণ করতে হবে। অন্যথায় ভারতীয় জাতিসত্তা অস্তিত্ব সংকটে পড়তে পারে। ‘সমাপ্ত’।