সাদিয়া ইসলাম কাসফিয়া

বাংলার কুটির শিল্প একসময় ছিল গ্রামীণ জীবনের প্রেরণা, আত্মনির্ভরতার প্রতীক এবং সংস্কৃতির ধারক। এ শিল্প শুধু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নয়, বরং বাংলার ঐতিহ্য, চর্চা ও কৃষ্টির জীবন্ত নিদর্শন। কিন্তু আজ এ শিল্প ধ্বংসের পথে। আধুনিকতা, যান্ত্রিক শিল্প, বিশ্বায়ন ও প্রাতিষ্ঠানিক অবহেলার ফলে বাংলার শতাব্দীপ্রাচীন কুটির শিল্প আজ নিঃশব্দে বিলীন।

এক সময় বাংলার কুটির শিল্প শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও সুনাম অর্জন করেছিল। ঢাকার মসলিন, নারায়ণগঞ্জের জামদানি, বগুড়ার নকশিকাঁথা, কুমিল্লার খয়রাতি তাঁত -এসব ছিল বাংলার আত্মপরিচয়ের অংশ। মুঘল আমলে এবং তারও আগে, এ শিল্প পৃষ্ঠপোষকতা পেত নবাব, জমিদার ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর। ১৮ শতকে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীরা কুটির শিল্প ধ্বংসে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাঁরা কলকাতাভিত্তিক মেশিননির্ভর মিল চালু করে কুটির শিল্পের ওপর আরোপ করে অতিরিক্ত কর, পণ্যের আমদানিতে ছাড় এবং স্থানীয় শিল্পীদের উপর নানান নিষেধাজ্ঞা। এর ফলে মুসলিন শিল্প ধীরে ধীরে মুছে যায় ইতিহাস থেকে।

অতীতের কুটির শিল্পবর্তমানের কুটির শিল্পের সামাজিক মর্যাদা ছিল সম্মানিত, পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। কিন্তু এ শিল্প আজ সমাজে অবহেলিত ও বিপণ্ন। কুটির শিল্প বাংলার প্রাণের শিল্প-এই শিল্পে আছে শ্রম, কৌশল, ঐতিহ্য ও শিল্পীর আত্মা। এর মৃত্যু মানে শুধু শিল্পের নয়, বরং একটি জাতির শিকড়চ্যুত হওয়া। আজকের প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বেও এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব যদি সদিচ্ছা, সুনীতিমালা ও জনসচেতনতা একত্রে কাজ করে। তাই এখনই সময়, কুটির শিল্পকে ধ্বংসের পথ থেকে পুনরুত্থানের পথে নিয়ে যাওয়া। বৈচিত্র্যপূর্ণ পণ্য এ কুটিরশিল্প বর্তমানে আধুনিক যন্ত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারছে না। পূর্বে রপ্তানি ও বিপণন সরাসরি ব্যবসায়ী ও দরবারে বিক্রি হতো। এখন মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য রপ্তানি সীমিত। এর উৎপাদন পদ্ধতি দক্ষ হাতে তৈরি ও সময়সাপেক্ষ হলেও মানসম্পন্ন। তবে বর্তমানে মান ও পরিমাণ দু’ক্ষেত্রেই পিছিয়ে পড়ছে। পূর্বে এ শিল্প উন্নয়নের গতিগ্রামীণ অর্থনীতির চালিকা শক্তি ছিল যা এখন বন্ধ হয়ে গেছে বা ক্ষতিগ্রস্ত।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা (BSCIC) -এর ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত এক দশকে কুটির শিল্পে কর্মরত মানুষের সংখ্যা ৩০% কমেছে। বর্তমানে দেশের মোট শ্রমশক্তির মাত্র ৪.৮% কুটির শিল্পে নিযুক্ত, যেখানে ১৯৮০-এর দশকে এ সংখ্যা ছিল ১৩%। এক জরিপ অনুযায়ী, ৬০% হস্তশিল্পী মনে করেন-তাদের সন্তানরা এ পেশায় আসতে চান না। বাংলাদেশে বর্তমানে ৮৩ লক্ষ কুটির শিল্প ইউনিট, যেখানে ২ কোটি ৯০ লক্ষ শ্রমিক নিয়োজিত এবং যার উৎপাদনমূল্য প্রায় ৩৯৫ বিলিয়ন টাকা, মূল্য সংযোজন প্রায় ৩১৪.৮৬ বিলিয়ন টাকা (The Financial Express) । এর ফলেও বর্তমানে এ শিল্প যেন হারিয়ে যাচ্ছে।

অনেকে মনে করেন, কুটির শিল্পের পণ্য এখনো অনন্য, কিন্তু দামে বেশি এবং সহজে পাওয়া যায় না। ফলে এ যেন এক সোনার হরিণ। শহরের মানুষের কাছে এ শিল্পের প্রতি আগ্রহ থাকলেও তথ্য, প্রচার ও সুলভ মূল্য না থাকায় চাহিদা গড়ে ওঠে না। কুটির শিল্প ধ্বংসের পথে হলেও তা পুনরুজ্জীবনের সুযোগ এখনো রয়েছে।

বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে কিছু সম্ভাবনাময় কুটির শিল্প রয়েছে, যেগুলো সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা পেলে দেশের অর্থনীতি, কর্মসংস্থান এবং রপ্তানি খাতে বড় অবদান রাখতে পারে। সম্ভাবনাময় কুটির শিল্পগুলো হলো: প্রথমত, হস্তশিল্প যেমন: নকশিকাঁথা, পাটজাত পণ্য, মৃৎশিল্প, বাঁশ ও বেতের তৈরি সামগ্রী। এসব পণ্যের স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে রয়েছে প্রচুর চাহিদা। ফলে কম পুঁজি, নারী উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ এর মাধ্যমে এ শিল্প বেশ এগিয়ে যেতে পারে।তারপর রয়েছে পাটজাত পণ্য তৈরি যেমন: ব্যাগ, টেবিল ম্যাট, রাগ, শোপিস।এসব পণ্য পরিবেশবান্ধব হওয়াতে ‘জুট ফর গ্রীন’ ট্রেন্ডে বাড়ছে চাহিদা। এছাড়া রয়েছে প্রাকৃতিক প্রসাধনী ও সাবান তৈরি যেমন : হ্যান্ডমেড সাবান, হেনা, হারবাল ফেসপ্যাক। বর্তমানে শহরাঞ্চলে বেড়ে উঠছে এসব অর্গানিক পণ্যের চাহিদা। ঘরোয়া প্রক্রিয়াজাতকরণ পণ্য যেমন :ঘরোয়া আচার, মোরব্বা, চানাচুর, পিঠা, কেক চকলেট ইত্যাদি অনলাইন ফুড ডেলিভারি, ই-কমার্সে বিক্রির মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের অগ্রগতির রয়েছে উচ্চ সম্ভাবনা। চামড়াশিল্প বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের অন্যতম। ফলে ওয়ালেট, বেল্ট, ছোট ব্যাগ তৈরি করে তা বাজারজাত করণের মাধ্যমেও বাংলাদেশের কুটিরশিল্প পৌছাতে পারে সম্ভাবনার উচ্চশিখরে।তরুণ প্রজন্ম, ফ্যাশন সচেতন নারীদের বিভিন্ন হস্ত নির্মিত গহনার প্রতি বাড়ছে ঝোঁক। ফলে কঞ্চি, মাটি, কাঠ, পুঁতি, কাপড়, সুতা র মতো সামান্য কাচামাল ব্যাবহার করেও এ শিল্পের উন্নতি করা যায়। মাটির তৈরি বিভিন্ন পণ্য যেমন ফুলদানি, মাটির হাড়িপাতিল, শোপিস এদেশের ঐতিহ্যকে বহন করে। ফলে এসব কুটির শিল্প দেশি-বিদেশি পর্যটক, এক্সপোর্ট ফেয়ার এ এক বিশাল সম্ভাবনা । সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, নওগাঁ অঞ্চলে দেখা যায় উল, সুতা ও তাঁতের কাজের শাড়ি, গামছা, লুঙ্গি, চাদর তৈরি করত। এগুলো ঐতিহ্য ও গ্রামীণ পরিচয়ের বাহক। সবশেষে রয়েছে বর্তমান আধুনিক যুগের ডিজিটাল কুটির শিল্প যেমন: ডিজিটাল আর্ট, গ্রাফিক ডিজাইন, কার্টুন, প্রিন্টেবল পণ্য (ঞ-ংযরৎঃ, মগ) এগুলো অনলাইন এ বিক্রির মাধ্যমে কুটির শিল্পকে বিলুপ্তির পথ থেকে পুনরজ্জীবিত করা যেতে পারে। যা রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, নারী ও যুবকদের কর্মসংস্থান, গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতি আনা ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের বিকাশের মাধ্যমে এক তরুণ প্রজন্মকে বেকারত্বের অভিসাপ থেকে মুক্তি দিয়ে এ শিল্পের উন্নতি সাধন করতে পারে।

যদি উপযুক্ত নীতিমালা ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, তাহলে এ শিল্প হতে পারে নারী স্বনির্ভরতা বৃদ্ধির মাধ্যম, গ্রামীণ কর্মসংস্থানের বিকল্প, দেশীয় সংস্কৃতির বিশ্বায়নের বাহক, পরিবেশবান্ধব ও টেকসই অর্থনীতির মডেল। এক্ষেত্রে নানাভাবেই এ শিল্পকে পুনরুজ্জীব করা যায় যেমন: সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ ও ডিজাইন ইনোভেশন, অনলাইন মার্কেটিং ও রপ্তানি খাত শক্তিশালীকরণ, স্কুল পর্যায়ে কুটির শিল্প বিষয়ে শিক্ষা অন্তর্ভুক্তি, গ্রামীণ হস্তশিল্প হাব গড়ে তোলা ইত্যাদি।

কুটির শিল্প বাংলার প্রাণের শিল্প-এ শিল্পে আছে শ্রম, কৌশল, ঐতিহ্য ও শিল্পীর আত্মা। এর মৃত্যু মানে শুধু শিল্পের নয়, বরং একটি জাতির শিকড়চ্যুত হওয়া। আজকের প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বেও এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব-যদি সদিচ্ছা, সুনীতিমালা ও জনসচেতনতা একত্রে কাজ করে। তাই এখনই সময়, কুটির শিল্পকে ধ্বংসের পথ থেকে পুনরুত্থানের পথে নিয়ে যাওয়া।

লেখক : শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ জগন্নাথ বিদ্যালয়।