যানজট আমাদের দেশে একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা। জনসংখ্যার চাপ, সেকেলে যোগাযোগ ব্যবস্থা, অপরিকল্পিত নগরায়ন, যানবাহনের সংখ্যাধিক্য ও মানহীনতা এর উল্লেখযোগ্য কারণ। বিশেষ করে আমাদের রাজধানী রূপসী নগরী এখন রীতিমত যানজটের নগরীতে পরিণত হয়েছে। যা নগরবাসীর জীবনযাত্রাকে রীতিমত দুর্বিষহ করে তুলেছে। ফলে রূপসী নগরী এখন রীতিমত বিবর্ণ।
সড়ক পথে যখন সড়ক ব্যবহারকারী যানবাহনের সংখ্যা সড়কের ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত বৃদ্ধি পায়, তখন যানবাহনগুলো স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে পারে না, এরকম অবস্থাকে যানজট বলা হয়। যানজটের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে গাড়ির স্বাভাবিকের তুলনায় ধীর গতি, দীর্ঘ যাত্রাকাল, যানবাহনের দীর্ঘ সারি, শব্দদূষণ ইত্যাদি। দুর্ঘটনা যানযটের একটি প্রধান কারণ। যানজটের কারণে শ্রমঘণ্টার অপচয় হয় এবং কিছু ক্ষেত্রে অপরাধের বৃদ্ধি ঘটে।
যখন সড়কে যানবাহনের সংখ্যা সড়কের স্বাভাবিক যানবাহন ধারণক্ষমতার সীমা থেকে অতিরিক্ত হয়ে যায়, তখন কোন যানই তার স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারে না। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সৃষ্টি হয় যানজটের। সড়কের মোড়ে একাধিক সড়ক থেকে অতিরিক্ত যানবাহন প্রবেশ করলে সকল যানেরই মোড় থেকে গন্তব্যে যেতে নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় এবং সড়ক প্রায় অচল হয়ে পড়ে। যানজটের সূচনা হিসাবে কিছু নির্দিষ্ট বিষয়কে চিহ্নিত করা যায়। কিছু ক্ষেত্রে সড়কের কোন নির্দিষ্ট অংশে বা নির্দিষ্ট দূরত্বে যানবাহন ধারণক্ষমতা হ্রাস পায়, আবার কিছু ক্ষেত্রে যানবাহনের সংখ্যা অতিরিক্ত বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশে যানজটের ক্ষেত্রে উন্মুক্ত সড়কে উন্নয়নকাজ চলার কারণে সড়কের ধারণক্ষমতা হ্রাস পাওয়া, বিদ্যালয় কিংবা কার্যক্ষেত্রে পৌঁছানো বা ছুটির সময়ে যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি, অদূরদর্শী যানচালনা, সড়কে অপরিকল্পিতভাবে মানুষের চলাচল ও দখল, বর্ষাকালীন জলাবদ্ধতা, এসব কারণকে দায়ী করা যায়। আর এসব সমস্যার কারণেই আমাদের তিলোত্তমা নগরী ঢাকা এখন রীতিমত যানজটের নগরীতে পরিণত হয়েছে। যা নগরজীবনে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
মূলত, ঢাকা শহর যেন প্রতিদিন এক অনন্ত অপেক্ষার প্রতীক। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যানজটের ধোঁয়া, হর্ণের তীব্রতা, ক্লান্ত মানুষের দীর্ঘশ্বাস সব মিলিয়ে এটি আজ বাংলাদেশের নগরজীবনের সবচেয়ে জটিল বাস্তবতা। রাজধানী ছাড়িয়ে চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জসহ অন্যান্য নগরেও এ সংকট প্রতিদিন আরও গভীর হচ্ছে। যানজট শুধু সময় নষ্ট করছে না, অর্থনীতির গতি মন্থর করছে, জনজীবনের মানও কমিয়ে দিচ্ছে।
বাংলাদেশ বিশ্বের ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর একটি। জাতিসংঘের তথ্যমতে, প্রতিবছর প্রায় ৬ লাখ মানুষ ঢাকায় যুক্ত হচ্ছে, যার বড় অংশই কাজের খোঁজে শহরমুখী। কিন্তু এ প্রবাহের জন্য আমাদের নগর পরিকল্পনা কখনো প্রস্তুত ছিল না; এখনও নয়। অপরিকল্পিত নগরায়ন, সরু রাস্তা, অপর্যাপ্ত পার্কিং ব্যবস্থা এবং যানবাহনের অপ্রতুল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সব মিলিয়ে শহর এক অনিয়ন্ত্রিত জটের ঘেরাটোপে বন্দি। রাজধানীর প্রধান সড়কগুলো (যেমন মিরপুর রোড, মালিবাগ-মগবাজার, বিমানবন্দর সড়ক, মতিঝিল-বনানী রুট) প্রায় প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা বন্ধ হয়ে থাকে। রাস্তার পাশে দোকান, অবৈধ পার্কিং, রিকশার আধিপত্য, বাস-ট্রাকের প্রতিযোগিতা -এই সব কারণ মিলেই যানজটকে স্থায়ী রূপ দিয়েছে।
একথা ঠিক যে, যানজটের দায় পুরোপুরি সরকারের নয়; সমাজেরও বড় ভূমিকা আছে। রাস্তা পারাপারে শৃঙ্খলার অভাব, ফুটপাত দখল, ট্রাফিক আইন না মানা, হর্ণ বাজানোর অসহ্য অভ্যাস এসবই নাগরিক দায়িত্বহীনতার প্রতিফলন। সচেতনতা গড়ে উঠতে পারলে অনেক সমস্যা সহজেই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। যেমন, ট্রাফিক আইন মেনে রাস্তা পার হওয়া, নির্দিষ্ট লেনে গাড়ি চালানো, হঠাৎ ইউ-টার্ন না নেওয়া -এগুলো ছোট কিন্তু বড় পরিবর্তন আনে। স্কুল-কলেজ পর্যায় থেকে ‘ট্রাফিক শিক্ষাকে’ বাধ্যতামূলক করা গেলে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে নিয়ম-শৃঙ্খলার বীজ বোনা সম্ভব। সমাজের ভূমিকা শুধু ভোগান্তি বর্ণনায় নয়, সমাধান সৃষ্টিতেও।
বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার যানজট বছরে প্রায় ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ উৎপাদনশীল সময় নষ্ট করছে। অফিস, ব্যবসা, রপ্তানি সব খাতে এর প্রভাব ভয়াবহ। একজন সাধারণ কর্মজীবী মানুষ প্রতিদিন গড়ে ২ থেকে ৩ ঘণ্টা শুধু যানজটে আটকে থাকেন। এ সময় যদি উৎপাদন বা পারিবারিক কাজে ব্যয় করা যেত, তাহলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উভয় মানেই ইতিবাচক পরিবর্তন আসত।
বিগত সরকার যানজট নিরসনে বেশ কিছু বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু প্রকল্পগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হওয়ায় এর পুরো সাফল্য আমরা পাইনি। কারণ, জনস্বার্থের কথা বলে এসব প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হলেও প্রকল্পগুলো দুর্নীতি ও লুটপাট মুক্ত ছিলো না। তারপরও এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও যানজট নিরসনে কিছুটা হলেও সহায়ক হয়েছে। প্রকল্পগুলো হচ্ছে-
মেট্রোরেল : রাজধানীতে মেট্রোরেল চালু হওয়ায় যানচাপ কিছুটা কমেছে। নতুন রুট যেমন উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ইতোমধ্যে চালু, ভবিষ্যতে কমলাপুর পর্যন্ত স¤প্রসারণের কাজ চলছে। পুরো প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে রূপসী নগরী ঢাকার যানজট নিরসনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু এ খাতে প্রভূত সংখ্যক অর্থ খরচ করলে এ থেকে আমরা কাক্সিক্ষত ফল পাইনি।
বিআরটি (Bus Rapid Transit): বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বিআরটি প্রকল্প সম্পন্ন হলে প্রায় ২০ লাখ মানুষের যাতায়াত সহজ হবে। যা রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থ’ায় মাইল ফলক হতে পারে। তাই এ প্রকল্পটি জরুরি ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা জরুরি।
এক্সপ্রেসওয়ে ও ফ্লাইওভার : এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, পদ্মা সেতুর সংযোগ মহাসড়ক, ঢাকার চারপাশে বাইপাস রোড এসব উদ্যোগ পরিবহন সময় অনেকাংশে কমাচ্ছে। গৃহীত প্রকল্পগুলো পুরোপুরি সমাপ্ত করা গেলে গণযোগাযোগ ব্যবস্থায় প্রভূত উন্নয়ন সাধিত হবে।
স্মার্ট ট্রাফিক সিগন্যাল : পরীক্ষামূলকভাবে কিছু এলাকায় সেন্সরনির্ভর ট্রাফিক লাইট চালু হয়েছে, যা ধীরে ধীরে বৃহত্তর শহরগুলোতে বিস্তৃত হবে এবং দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন ধারার সৃষ্টি হবে।
তবে, এসব প্রকল্পের সফলতা নির্ভর করছে বাস্তবায়ন ও রক্ষণাবেক্ষণের ওপর। রাস্তা স¤প্রসারণ বা নতুন অবকাঠামো তৈরি করলেই সমাধান আসবে না, বরং সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করাই আসল চ্যালেঞ্জ।
একথা অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ কিন্তু আমরা জলপথকে ভুলে গেছি। অথচ জলজ পরিবহন হতে পারে সবচেয়ে কার্যকর ও পরিবেশবান্ধব বিকল্প। ঢাকা শহরের অভ্যন্তরে তুরাগ, বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদীর ধারে নৌরুট চালু করা গেলে যানচাপ অনেকটা কমানো সম্ভব। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা-সদরঘাট-তুরাগ নৌরুট ইতিমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়েছে, কিন্তু এটিকে আধুনিক, নিরাপদ ও সময়নির্ভর করতে হবে। জলজ যান যেমন ‘ওয়াটার বাস’ বা ‘ফেরি সার্ভিস’ নিয়মিত চালু হলে নগরের দক্ষিণাঞ্চল থেকে উত্তরে সহজ সংযোগ তৈরি হতে পারে। এতে শুধু যানজটই নয়, জ্বালানি খরচ ও বায়ু দূষণও কমবে।
আমাদের দেশে যানজটের অন্যতম প্রধান কারণ হলো সেকেলে পরিবহন ব্যবস্থা। যোগাযোগ ক্ষেত্রে আমরা এখনো আধুনিক প্রযুক্তির সংযোজন নিশ্চিত করতে পারি নি। তাই আমাদের দেশের পরিবহন ব্যবস্থা আজও সেকেলেই রয়ে গেছে। তাই রাজধানী সহ সারাদেশে যানজট কমাতে প্রযুক্তিনির্ভর সমাধানই হতে পারে পরবর্তী ধাপ। যা আমাদের দেশের পরিবহন ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন এনে দিতে পারে। সম্ভাব্য প্রযুক্তিগুলো হলো-
১। ইন্টেলিজেন্ট ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম (ITS) : ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে সেন্সর, ক্যামেরা ও রিয়েল-টাইম ডাটা ব্যবহারে সিগন্যাল স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে। যা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখতে পারে।
২। স্মার্ট টিকিটিং ও ই-পাস : গণপরিবহনে ই-পেমেন্ট ব্যবস্থা চালু করলে সময় ও বিশৃঙ্খলা উভয়ই কমবে। তাই বিষয়টি জরুরি ভিত্তিতে বিবেচনা করা জরুরি।
৩। পার্কিং ব্যবস্থাপনা : মাল্টিস্টোরি পার্কিং ও ডিজিটাল পার্কিং ম্যাপ তৈরি করা জরুরি, যাতে রাস্তার পাশে গাড়ি রাখার প্রবণতা কমে।
৪। বৈদ্যুতিক যানবাহন : ইলেকট্রিক বাস, অটো ও মাইক্রোবাসে ভর্তুকি দিলে জ্বালানি সাশ্রয় ও পরিবেশ সুরক্ষা—দুটিই সম্ভব।
এছাড়াও প্রতিটি নতুন সড়ক বা ফ্লাইওভার প্রকল্পের আগে ট্রাফিক ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট বাধ্যতামূলক করা উচিত। উন্নয়ন মানেই শুধু কংক্রিট নয়, কার্যকারিতাও নিশ্চিত করতে হবে। যানজটের সমাধান শুধু রাস্তা বাড়িয়ে বা নতুন প্রকল্পে সম্ভব নয়; মূল চাবিকাঠি হলো মানুষের অংশগ্রহণ। স্থানীয় প্রশাসন, ট্রাফিক বিভাগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে সচেতনতা বাড়াতে।
যানজট আজ শুধু ট্রাফিক সমস্যা নয় এটি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মানসিক এক দুর্যোগে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হলে নগর চলাচলকে স্বস্তিদায়ক, নিরাপদ ও টেকসই করতে হবে। অপরিকল্পিত নগরায়ন নিয়ন্ত্রণ, জলপথের পুনর্জাগরণ, প্রযুক্তিনির্ভর সড়ক ব্যবস্থাপনা এবং নাগরিক সচেতনতা এ চার স্তম্ভেই নিহিত ভবিষ্যতের পথ। সমস্যা আমাদের সামনে স্পষ্ট, সমাধানও অসম্ভব নয়। প্রয়োজন শুধু সমন্বিত ইচ্ছাশক্তি ও বাস্তবায়নের সাহস। তাহলেই হয়তো একদিন দেখা যাবে ঢাকা শহর যানজট মুক্ত হয়ে চলমান জীবনের প্রতীকে পরিণত হয়েছে।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক।