॥ জিবলু রহমান ॥

জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপিং ইকোনমিসের নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট মায়ুমি মুরায়ামা বলেছিলেন-‘১৯৯৬ সালে হাসিনা প্রথম যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখন তাঁকে একজন কর্তৃত্ববাদী রাজনীতিক হিসেবে প্রাথমিকভাবে আমার মনে হয়নি।’ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় ফেরার পর তিনি কর্তৃত্ববাদের দিকে ঝুঁকে পড়তে থাকেন বলে ইঙ্গিত দেন মায়ুমি। জরুরি অবস্থা জারির পর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে জয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। সে নির্বাচনে লেবেল প্লেয়িং ফিন্ড ছিল না বলে বিরোধীদল বিএনপি-জামায়াতসহ অনেক জোটের অভিযোগ ছিল। এরপর ২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচন হয় একতরফা, যেখানে বিরোধী দলগুলো অংশ নেয়নি। পাতানো নির্বাচন নিয়ে দেশে চলে সহিংসতা। অগ্নিদগ্ধ, সহিংসতা, পুলিশের গুলীতে প্রতিদিন প্রাণ হারায় মানুষ। নির্বাচন প্রতিহতে অবরোধ কর্মসূচি পালন করে বিরোধীদলগুলো। অবরোধ-হরতাল চলে।

হাতেগোনা কয়েকটি দল ছাড়া প্রায় সব দলই নির্বাচন বর্জন করে। দেশের সর্বমহল এবং আন্তর্জাতিক মহল সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের জন্য সরকার ও বিরোধী দলকে চাপ দেয়। এ নিয়ে সংলাপ হয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং দেশের বুদ্ধিজীবীদের প্রচেষ্টার প্রতি সম্মান দেখিয়ে বিরোধীদল কিছুটা নমনীয় হলেও শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রিত্ব না ছাড়ার সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন। জনগণকে ভয়ভীতি দেখিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ইচ্ছায় সহিংসতার মধ্যেও নির্বাচন কমিশন ভূয়া এমপি বানানোর সকল আয়োজনের দিকে এগিয়ে যায়। সে জন্য আরপিওকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জনগণের ভোটের অধিকার হরণ করে কৌশলে ১৫৪ জনকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত করা হয়। নির্বাচন কমিশন ভোটারদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ১৫৪ আসনে বিনা ভোটে এমপি করে গণতন্ত্র এবং জনগণের ভোটের অধিকারে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছিল।

নির্বাচন ও চলমান সহিংসতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন দেশের বিশিষ্টজন ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। তারা এ অবস্থায় নির্বাচন স্থগিত করে সবদলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের দাবি করেছিলেন। অথচ সরকারের ইচ্ছাপূরণে আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন এসবে ভ্রƒক্ষেপ করেনি। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকারের সময় প্রশাসনের নির্বাহী ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের হাতে ছিল। ২০১৩ সালের শেষের দিকে ও ২০১৪ সালের প্রথম দিকে সহিংসতায় মানুষের মৃত্যুর দায় নির্বাচন কমিশন এড়াতে পারবে না।

পদ্মাসেতুর দুর্নীতি নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছিল মহাজোট সরকার। জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব বান কি মুনের প্রস্তাবকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে শেখ হাসিনা দেশকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ‘একঘরে’ এবং ‘নানামুখী বিধিনিষেধের বেড়াজালে’ আটকানোর রাস্তায় নিয়ে যান। বান কি মুন আর তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির দু দফায় টেলিফোন এবং চিঠি, জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিবের প্রতিনিধি অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর একাধিকবার ঢাকা সফর করে সংকট সমাধানের চেষ্টা, বান কি মুনের প্রস্তাব কোনো কিছুই গ্রাহ্য করেননি শেখ হাসিনা।

তৎকালীন পরিস্থিতিতে নির্বাচন করে হত্যা-অরাজকতার দায় নিতে হয়েছে কমিশনকে। এ জন্য তাদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড়াতে হচ্ছে এখন। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিশনের তৎকালীন প্রধান নাভি পিল্লাই দেশের মানুষ খুন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভয়াবহতা দেখে এসব ঘটনার বিচার আন্তর্জাতিক আদালতে হতে পারে বলে মতামত দিয়েছিলেন। অথচ তৎকালীন সিইসি কাজী রকিবউদ্দিন আহমদ দাবি করেন-‘দেশের চলমান সহিংসতার সঙ্গে নির্বাচনের সম্পর্ক নেই। এর দায় কমিশন নেবে না।’

তখন সংবিধান অনুযায়ী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকলেও প্রশাসনের নির্বাহী ক্ষমতা ছিল নির্বাচন কমিশনের হাতে। তখনও প্রশ্ন ছিল, ‘পাতানো নির্বাচন বন্ধের দাবির আন্দোলনের যেভাবে মানুষ মারা যায় তা কি নির্বাচন সংশ্লিষ্ট নয়? নির্বাচনকালীন সময়ে নির্বাহী ক্ষমতার দায়িত্বরত ইসি এ দায় এড়াবে কীভাবে?’

তফসিল ঘোষণা পর দেশব্যাপী রক্তপাত, সহিংসতা ও পুলিশের গুলীতে মানুষ হত্যার দায় অবশ্যই নির্বাচন কমিশন এড়াতে পারে না।

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘প্রধানমন্ত্রিত্বের চেয়ার না ছাড়ার’ গোয়ার্তুমি আর ভোটের পরিবেশ না থাকার পরও নির্বাচন করার সিইসির গোয়ার্তুমির মধ্যে পার্থক্য কী আছে?

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দু সাপ্তাহ পরও প্রার্থীরা এলাকায় যেতে পারেন নি, এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন সংবাদপত্রগুলো প্রকাশ করেছিল। বিক্ষুব্ধ জনতার ভয়ে তারা ঘরে বসে ছিলেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছিল। ঢাকা থেকে প্রায় অধিকাংশ জেলাই বিচ্ছিন্ন ছিল। বেশ কয়েকটি জেলা ছিল যেখানে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণেই ছিল না।

মানুষের জীবন, গণতন্ত্র, জনগণের ভোটের অধিকার নিয়ে নির্বাচন কমিশন চরম হটকারী আচরণ করেছে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হওয়ার পরও কমিশন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের ভূমিকায় নেমেছিল। গোটা দেশ কার্যত গৃহযুদ্ধের মুখোমুখি করেছে। বিদেশী সংবাদ মাধ্যম গার্ডিয়ানে লেখা হয়েছেÑ‘দ্য প্রিজন দ্যাট ইজ বাংলাদেশ।’

আলজাজিরায় খবর বেরিয়েছেÑ ‘বাংলাদেশে সিলেক্টেড কিলিং শুরু হতে পারে, জাতিসংঘ বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।’

রক্তাক্ত দেশে-সহিংসতায় পাতানো নির্বাচন থেকে সরে না আসায় বিদেশি পর্যবেক্ষকরা নির্বাচন পর্যবেক্ষণে আসেননি। রাজনৈতিক সহিংসতায় নির্বাচনে দেশীয় পর্যবেক্ষক পাঠানো অনিশ্চিত বলে জানিয়েছিলেন দেশীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা ডেমোক্রেসি ওয়াচের নির্বাহী পরিচালক তালেয়া রহমান। ২০১৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে সিইসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জানানÑ‘আমরা কমিশনকে বলেছি বর্তমান অবস্থা বজায় থাকলে পর্যবেক্ষক পাঠানো কঠিন হয়ে যাবে। পর্যবেক্ষকবিহীন নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা কোথাও থাকবে না। অথচ ইসি সেদিকেই ছুটছে।’

টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথুরিয়া গোটা দেশ জ্বলেছে আগুনে। প্রতিদিন জেলায় জেলায় সংঘাত সংঘর্ষে মানুষ মারা যায়। নির্বাচন প্রতিহতের চেষ্টায় জনগণ রাস্তায় নামে। অথচ নির্বিকার ছিল নির্বাচন কমিশন। সিইসি কাজী রকিবউদ্দিন আহমদের চোখে যেন কিছুই ধরা পড়েনি। নির্বাচন-সংক্রান্ত আরপিওর অধিকাংশ আচরণবিধি তিনি নিজেই ভঙ করেছেন।

সংঘাত-সহিংসতা, পুলিশের গুলী এবং আগুনে নিত্যদিন ৮/১০ জন মানুষকে প্রাণ হারানোর ঘটনাকে অনেকেই গণহত্যা হিসেবে অবিহিত করেছিলেন। পুলিশের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয়ভাবে সন্ত্রাসকে পৃষ্ঠপোষকতা করায় মানুষ ঘর থেকে বের হয়নি। কোনো কিছুকে তোয়াক্কা না করে নির্বাচন করার পথে হাটেন কাজী রকিবউদ্দিন আহমদ। আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানোর চেষ্টায় নির্বাচন অনুষ্ঠানকে তৎকালীন সময়ে ‘সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা’ বলা হলেও একই কারণে খুন, গুম, ছাত্রলীগ-যুবলীগের তা-ব, সহিংসতা, জ্বালাও-পোড়াও, পুলিশের গুলীতে প্রাণহানির দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে দমন-পীড়নের মাধ্যমে জনগণকে ‘দমন’ করে রেখে আওয়ামী লীগ নীলনকশার নির্বাচন করেছে। ইসি জনগণকে সেনাবাহিনীর ভয় দেখিয়েছে। ভারতের খুঁটির জোরে জনগণকে ভয়ভীতি দেখিয়ে নির্বাচন করার জন্য যৌথ অভিযান শুরু করা হয়। এ অভিযানে র‌্যাব-পুলিশ-বিজিবির সঙ্গে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা থাকবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্র্র প্রতিমন্ত্রী সামসুল হক টুকু।

এরই মধ্যে গ্রেফতারের নামে দেশব্যাপী ভীতি ছড়ানো হয়। ৫ জানুয়ারির আগে জনমনে গ্রেফতার আতঙ্ক ছড়িয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেষ্টা চলে। এটা করতে গিয়ে আন্দোলনকারীদের গণগ্রেফতার করা হয়। সাতক্ষীরায় হিন্দু বাড়িতে আগুন দিতে গিয়ে ছাত্রলীগ নেতা ধরা পড়ায় ভ্রাম্যমাণ আদালতে কারাদ- দেয়া হয়। নোয়াখালীতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারপতির বাসায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটাতে গিয়ে ছাত্রলীগের তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। আওয়ামী লীগ নেতা পঙ্কজ দেবনাথের গাড়িতে বার বার আগুন দেয়ার ঘটনা কেন ঘটেছে তার অনুসন্ধান হয় নি? অথচ অগ্নিসংযোগের ঘটনায় বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের নামে পাইকারী হারে মামলা দায়ের করা হয়। মামলার আসামিদের ধরিয়ে দিতে পারলে এক লাখ টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু অগ্নিদগ্ধদের দেয়া হয়েছে মাত্র ১০ হাজার টাকা।

অবশেষে দেশ-বিদেশের সব প্রস্তাব-অনুরোধ, মধ্যস্থতার চেষ্টাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ৫ জানুয়ারি পাতানো দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন করেছিল সরকার ও রকিব কমিশন। লেখক : প্রাবন্ধিক