শিশু হলো পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্পাপ ফুল। এ ফুল যখন হাসে তখন সমাজজীবনে আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে। অথচ অসংখ্য শিশু সহিংসতা, নির্যাতন আর নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। পরিবার থেকে শুরু করে স্কুল কিংবা কর্মক্ষেত্র কোথাও তারা নিরাপদ নন। প্রাসঙ্গিকক্রমে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য এর কথা মনে পড়ে গেল। তিনি ছাড়পত্র কবিতায় লিখেছেনÑ“এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান/ জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তুপ-পিঠে/ চলে যেতে হবে আমাদের/ চলে যাব-তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ। প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল, এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি- নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’’ কবির এ অঙ্গীকার আজও বাস্তবায়িত হয়নি। শিশুর জন্য নিরাপদ পৃথিবী কোথাও গড়ে উঠেনি। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র জীবনের দিকে তাকালে শিশুর নরম দেহ ক্ষত-বিক্ষত হওয়ার নিষ্ঠুর চিত্র প্রায়ই পত্রিকার পাতায় দেখা যায়। অথচ যে সমাজ ও রাষ্ট্রে শিশুরা নিরাপদ থাকে না, সে সমাজ বেশিদূর এগুতে পারে না। যার ভুরি ভুরি উদাহারণ আছে। শিশু নির্যাতন আজ কেবল একটি সামাজিক সমস্যা নয়; এটি জাতীয় সংকটে পরিণত হয়েছে। শিশু নির্যাতন নানাভাবে হতে পারে যেমন : মারধর, গালিগালাজ, ভয়-ভীতি প্রদর্শন, বাল্যবিয়ে, জোর করে শ্রমে নিয়োগ, যৌন হয়রানি, খাবার-বস্ত্র থেকে বঞ্চিত রাখা, অশিক্ষা, দারিদ্র্য, সামাজিক অবক্ষয়, রূঢ় আচরণ, সচেতনতার অভাব এবং আইনের দুর্বল প্রয়োগ ইত্যাদি। এসব নির্যাতন শিশুদের শারীরিক বিকাশে বাধা দেয়, মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করে এবং ভবিষ্যতে তাদের আত্মবিশ্বাস ও মানসিক বিকাশকে ধ্বংস করে দেয়। এসব নির্যাতনের ক্ষত শিশুরা ভুলে যায়নি; বরং আজীবন মনে রাখে।
বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রতিনিয়ত শিশুরা নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বিপুলসংখ্যক শিশু সহিংসতা ও শোষণের শিকার। বিশেষ করে ফিলিস্তিনের শিশুদের কথা বলা যায়। তাদের অনেকে স্কুলে যাওয়ার পথে ইসরায়েলী সন্ত্রাসী বাহিনী দ্বারা শহীদ হচ্ছে। ২০২৩ সালে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে অদ্যাবধি পর্যন্ত কমপক্ষে ৬৪ হাজার ৩৬৮ জন ফিলিস্তিনী শহীদ হয়েছেন। গাজার সরকারি গণমাধ্যম দপ্তর এ তথ্য জানিয়েছে। গাজা উপত্যকাজুড়ে ইসরায়েলী হামলায় নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তত ১৮ হাজার ৮৮৫ জনই শিশু। গত ২৮ আগস্ট বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম (বিএসএএফ) ও বাংলাদেশ শিশু কল্যাণ পরিষদের যৌথ উদ্যোগে এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়Ñ চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে (জানুয়ারি-জুন ২০২৫) দেশে শিশু নির্যাতনে প্রায় ১ হাজার ৯৩৩ জনের মৃত্যু এবং ধর্ষণের শিকার হয়েছেন প্রায় ২ হাজার ৭৪৪ জন শিশু। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন আরও ২ হাজার ১৫৯ জন। এ সংখ্যাগুলো নিছক কোন সংখ্যা নয়; বরং প্রতিটি ঘটনা নিষ্ঠুর ও বেদনাদায়ক। শিশু খুন কিংবা নির্যাতন সংক্রান্ত মামলা প্রায় ১ লাখ ৫১ হাজার। এই মামলাগুলো এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। দেশের পাঁচটি জাতীয় দৈনিক থেকে প্রকাশিত খবর বিশ্লেষণ করে এ পরিসংখ্যান তৈরি করা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে আইন বাস্তবায়ন, সচেতনা বৃদ্ধি এবং একটি স্বতন্ত্র শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি তুলেছে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো।
শিশু নির্যাতনের ভয়াবহতা কিছুতেই থামছে না। অথচ প্রতিবছর ৩০ এপ্রিল পালিত হয় আন্তর্জাতিক শারীরিক শাস্তি বিলোপ দিবস (International Day to End Corporal Punishment) যা শিশুদের উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন বন্ধে সচেতনতা তৈরির জন্য বিশ্বজুড়ে পালিত হয়। শিশুদের প্রতি সব ধরনের নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলাই দিবসটির লক্ষ্য। কিন্তু শিশু নির্যাতন বন্ধ হয়নি। বেসরকারি বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেস (বিইউএইচএস) প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে মুদ্রিত হয়েছে যে, ৮৮ শতাংশ শিশু কমপক্ষে একবার এবং ৫৫ শতাংশ শিশু একাধিকবার শারীরিক (মারধর,চড়, লাথি, চুল টানা, কান মলা, হাত মোচড়ানো) মানসিক (বকাঝকা, চিৎকার, গালি, অন্য শিশুর সঙ্গে তুলনা, অপমান) ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। পরিবারের কাছে ৫৮ শতাংশ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৫৬ শতাংশ, খেলার মাঠে ৬৫ শতাংশ শিশু শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। ইউনিসেফের ২০২২ সালের এক জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রায় ৮২% শিশু ঘরে শারীরিক শাস্তির শিকার হয়। স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ৬ জনের ৫ জনই মানসিক বা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ভাষ্যনুসারে ২০২৩ সালে ১২০০ শিশু খুন এবং ৭০০ শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার তথ্যমতে দেশে প্রায় ৪৮ লাখ শিশু শ্রমে নিয়োজিত। যাদের অনেকেই প্রতিদিন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের মুখোমুখি হচ্ছে। এ পরিসংখ্যান শিশু নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্রই প্রমাণ করে।
শিশুদের নিরাপত্তার জন্য শিশু আইন ২০১৩, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)ও শ্রম আইন ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৮) রয়েছে। শিশু আইন ২০১৩ ( (Children Act, 2013) ,অনুসারে কোনো শিশুকে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করলে ৫ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড অথবা অর্থদন্ড, অথবা উভয় দন্ডের বিধান আছে। কিন্তু প্রয়োগ দৃশ্যমান নয়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩) অনুসারে শিশু ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের জন্য সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। শ্রম আইন ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৮) অনুসারে ১৪ বছরের নিচে কোনো শিশুকে কাজে লাগালে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ অনুসারে অনলাইনে শিশু পর্নোগ্রাফি বা শিশু নির্যাতনমূলক কনটেন্ট ছড়ালে ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড। অর্থাৎ শিশু নির্যাতনের ধরন অনুসারে শাস্তি ৫ বছর কারাদণ্ড থেকে শুরু করে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। আইন থাকার পরও কেন নির্যাতন বন্ধ হচ্ছে না সে বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
শিশু নির্যাতন বন্ধে করণীয় হচ্ছে শিশুর প্রতি ভালোবাসা ও সহমর্মিতার পরশ ঢেলে দেয়া, ধৈর্য্যরে সাথে লালন এবং পালন করা। দুষ্টুমি করলে শাস্তি দিতে হবে। তার মানে এ নয় যে, হাত, পা চোখ উপড়ে ফেলতে হবে। তবে শারীরিক শাস্তি দেয়ার আগে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন। যেন শিশু অভিভাবককে আপন ভাবেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সকল শিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি কাউন্সেলিং ও শিশু অধিকার রক্ষা করার নীতি বাস্তবায়ন করা জরুরী। শিশু শ্রম নিয়ন্ত্রণে আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রয়োজন প্রতিবেশী ও সমাজের মান্যগণ্য বক্তিবর্গের সাথে শিশু নির্যাতন বন্ধে করণীয় বিষয়টি তুলে ধরা এবং সোচ্চার ভূমিকা রাখার ব্যাপারে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করা। রাষ্ট্রীয়ভাবে শিশু সেবা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র বাড়ানো এবং আশ্রয়কেন্দ্র, চিকিৎসা ও মানসিক সহায়তা নিশ্চিত করা দরকার। সবারই মনে রাখা দরকার- শিশুর মুখে হাসি ফুটাতে না পারলে সমাজ কখনো উন্নত হতে পারে না। আজকের শিশুরাই আগামী দিনের বাংলাদেশ। তাদের কেউ কেউ শেরে বাংলা কিংবা নজরুল হবে। সুতরাং শিশুদের ওপর কোন প্রকার জুলুম অত্যাচার করবেন না। শিশুদের আদর করুন, ভালোবাসতে শিখুন। প্রেক্ষিত ও প্রেক্ষাপটের আলোকে শাসনের রকমফের ঘটতে পারে। তবে শাসন হবে মৃদু ও পরিমিত। শাসন যেন অতিশাসন বা অপশাসনে পর্যবসিত না হয়। শাসনের পাশেই অনিবার্যভাবে আদর থাকা প্রয়োজন। তাদের সুস্থ, সুন্দর ও নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করা আমাদের নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব। দেশের একটি শিশু ও যেন কোনো ধরনের শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার না হয়Ñ তাহলে আমরা পাব মানবিক, আলোকিত, উন্নত সমাজ ও রাষ্ট্র, যেখানে শিশুরা থাকবে সুরক্ষিত ও নিরাপদ।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও আইনজীবী।