আসিফ আরসালান
গত ৯ জুন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস লন্ডনের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেছেন। ১০ জুন তিনি লন্ডন পৌঁছেন। লন্ডনে তার ৪ দিনের সফর। এ লেখাটি যখন প্রকাশিত হবে তখন তিনি বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন। এবারে তার ৪ দিনের লন্ডন সফরের মূল যে উদ্দেশ্য সেগুলো আমাদের মিডিয়ায় চাপা পড়ে গেছে। তার বদলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাথে তার বৈঠকের খবর বিগত ৩ দিন ধরে অত্যন্ত ফলাও করে ছাপা হয়েছে। অথচ তারেক রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য কিন্তু তিনি লন্ডন যাননি। প্রায় ৩ সপ্তাহ আগে তাঁর যখন লন্ডন সফর সম্পর্কে স্থির সিদ্ধান্ত হয় তখন উপদেষ্টা পরিষদের কেউ কেউ তাকে পরামর্শ দেন যে, যেহেতু তারেক রহমান বর্তমানে দেশের অত্যন্ত বড় একটি দল অর্থাৎ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত প্রধান তখন তার সাথে একটি বৈঠক হলে সেটি দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে। এরপর শুরু হয় ঐ প্রস্তাবিত বৈঠকের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। অবশেষে ঠিক হয় যে, ১৩ জুন শুক্রবার লন্ডন সময় সকাল ৯টা অর্থাৎ বাংলাদেশ সময় বিকেল ৩টায় এ বৈঠক শুরু হবে। শেষ হবে লন্ডন সময় ১১টায়। অর্থাৎ বাংলাদেশ সময় বিকেল ৫টায়। প্রাথমিকভাবে ঠিক করা হয়েছে যে, বৈঠকটি হবে ওয়ান টু ওয়ান। এর মধ্যে দু’শীর্ষ নেতা যদি মনে করেন তাহলে কোনো সাহায্যকারীকে ডেকেও নিতে পারেন। সে বৈঠক হয়ে গেছে। কিন্তু বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। আমি তাই ইউনূস-তারেক বৈঠক নিয়ে আজ কিছু বলবো না। বললে সেটি জল্পনা-কল্পনা বা গুজবের আকার ধারণ করবে।
ইতোমধ্যেই দেশের গণমাধ্যমে এবং সামাজিক মাধ্যমে ঐ বৈঠক নিয়ে অনেক কথা লেখা হয়েছে এবং অনেক জল্পনার জাল বোনা হয়েছে। কোথায় কী লেখা হয়েছে অথবা কোন ইউটিউবার এ সম্পর্কে কী বলেছেন সেগুলো সম্পর্কে আমি পূর্ণ ওয়াকেবহাল। তারপরেও আমি অফিসিয়ালি কোনো কিছু না বললে বা শুনলে আমি কিছু লিখবো না। লিখবো আসলে ড. ইউনূস ৪ দিনের সফরে কেনো ইংল্যান্ড গেলেন এবং এর মধ্যে সেখানে কি ঘটলো।
ড. ইউনূস লন্ডন গিয়েছিলেন প্রধানত দু’টি উদ্দেশ্যে। একটি হলো প্রিন্স তৃতীয় চার্লসের নিকট থেকে হারমনি এ্যাওয়ার্ড গ্রহণ করতে। আর দ্বিতীয় এবং প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো লন্ডনে পাচার করা শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের রুই কাতলাদের লুক্কায়িত ধনসম্পদ উদ্ধার। বলা হয়েছে যে, ড. ইউনূস একটি তালিকা নিয়ে লন্ডন যান। বাংলাদেশের শেখ হাসিনাসহ আর কারা কারা লন্ডনে পাচার করা অর্থ এবং অঘোষিত ধনসম্পদ রেখেছে তাদের নামধাম ঐ তালিকায় রয়েছে। ঐ তালিকায় টিউলিপ সিদ্দিকিরও নাম রয়েছে।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, প্রধান উপদেষ্টা লন্ডন যাওয়ার আগে টিউলিপ সিদ্দিকি ড. ইউনূসকে একটি পত্র দিয়েছিলেন। ঐ পত্রে তিনি ড. ইউনূসের সাথে অন্য কোনো স্থানে মিলিত হওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টাকে অনুরোধ করেছিলেন। তিনি নাকি সে বৈঠকে তার নির্দোষিতা প্রমাণ করবেন। ভাবতে অবাক লাগে যে, টিউলিপ সিদ্দিকি গণতন্ত্রের সুতিকাগার ইংল্যান্ডের মতো জায়গায় প্রথমে এমপিগিরি এবং তারপর মন্ত্রীগিরি করেও গণতন্ত্রের এ,বি,সি,ডিও শেখেননি। আবার ডিসেন্সি, ডেকোরাম এবং ম্যানারিজমও শেখেননি। ড. ইউনূস বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা বা প্রধানমন্ত্রী। আপনি তাকে পছন্দ করুন আর না করুন তার সাথে কথা বলতে চাইলে আপনাকে তার ইন্টারভিউ চাইতে হবে। তিনি যদি ইন্টারভিউ মঞ্জুর করেন তাহলে তার নির্ধারিত স্থানে (এখানে ড. ইউনূসের হোটেলে) দেখা করে আপনার আরজি পেশ করতে পারেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে তার সাথে কথা বলার জন্য অন্যত্র আসার অনুরোধ করে টিউলিপ সিদ্দিকি রীতিমতো বেয়াদবি করেছেন। তার খালা যেমন বেয়াদব, তেমনি ভাগিনীও তার এককাঠি সরেস।
লন্ডনে বাঙালি পাড়ায় একথা ব্যাপকভাবে সার্কুলেট করেছে যে, বাংলাদেশে টিউলিপের খালা শেখ হাসিনা এবং তার মা শেখ রেহানা যে লক্ষ-কোটি টাকা লুট করেছেন সে লুণ্ঠিত অর্থের একাংশ দিয়ে তিনি ব্রিটেনের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী স্টারমারের নির্বাচনী খরচ বহন করেছেন। আর প্রতিদান হিসাবে তিনি মন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশের তরফ থেকে যখন টিউলিপ সিদ্দিকির বিরুদ্ধে বেপরোয়া দুর্নীতির অকাট্য প্রমাণ হাজির করা হয় তখন স্টারমার টিউলিপকে মন্ত্রীত্ব থেকে বাদ দিতে বাধ্য হন। উচিত ছিলো টিউলিপের বিরুদ্ধে লন্ডনে নিরপেক্ষ তদন্ত করার। দোষী সাব্যস্ত হলে তার এমপিগিরিও খারিজ করতে হতো।
প্রবল ব্রিটিশ জনমতের চাপে স্টারমার তাকে মন্ত্রীত্ব থেকে সরিয়ে দিলেও ঋণ পরিশোধের জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য পদ থেকে আইনের মাধ্যমে টিউলিপকে খারিজ করেননি।
যখন ড. ইউনূসের তরফ থেকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্টারমারের এ্যাপয়েন্টমেন্ট চাওয়া হয় তখন স্টারমার দোটানায় পড়েন। তার অবস্থা অনেকটা শ্যাম রাখি, নাকি কুল রাখি। অবশেষে ইউনূসের মুখোমুখি হতে তিনি ভয় পান এবং দু’সরকার প্রধানের (স্টারমার এবং ইউনূস) বৈঠক এড়িয়ে যান। আমার ভাবতে অবাক লাগে যে, বাংলাদেশে এমন এক শ্রেণির মানুষও আছেন, অবশ্যই ওরা আওয়ামী ঘরানার, যারা তাদের দেশের সরকার প্রধানের সাথে ব্রিটিশ সরকার প্রধান দেখা না করলে খুশি হন। সামাজিক মাধ্যমে এ শ্রেণীর জীবদের উল্লাস লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু ড. ইউনূস দমে যাওয়ার পাত্র নন। এসম্পর্কে লন্ডনের বিখ্যাত পত্রিকা ‘ফিনান্সিয়াল টাইমস’ লিখেছে, Yunus named Canada, Singapore, the Caribbean and the Middle East as other destinations for allegedly misappropriated assets. He said the trip to the UK was “just the beginning” and he was planning further visits. His administration was looking to get support from “all directions” in the UK, including businesses, financial institutions, the police and all intelligence agencies, he added. অর্থাৎ- দেশের লুণ্ঠিত অর্থ যেসব দেশে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেসব দেশের নাম বলেন ড. ইউনূস। সে নামগুলি হলো কানাডা, সিঙ্গাপুর, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ এবং মধ্যপ্রাচ্য। তিনি বলেন এসব লুণ্ঠিত অর্থের খোঁজে তিনি দুনিয়াজোড়া সফর করবেন। ব্রিটেনে আগমন সে সফরের সবে মাত্র শুরু। তিনি চাচ্ছেন লুণ্ঠিত অর্থ পুনরুদ্ধারে তার এই প্রচেষ্টাকে যুক্তরাজ্যের সমস্ত মহল সমর্থন করুক। তিনি চান ইংল্যান্ডের ব্যবসায়ী, আথিক প্রতিষ্ঠান, পুলিশ এবং গোয়েন্দা বিভাগ তাকে সমর্থন করুক।
গত বুধবার ব্রিটিশ গণমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস বলেন, আগের সরকারের আমলে চুরি যাওয়া অর্থ উদ্ধারে বাংলাদেশের নতুন সরকারকে সহায়তা করার বিষয়ে যুক্তরাজ্যের নৈতিক দায়বদ্ধতা অনুভব করা উচিত। কারণ এ অর্থের বড় একটি অংশ এখন যুক্তরাজ্যেই রয়েছে। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের বিষয়ে ড. ইউনূস বলেছেন স্টারমার এখনো তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে রাজি হননি। অবশ্য স্টারমারের সঙ্গে তার সরাসরি কথা হয়নি।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্টারমার ড. ইউনূসের সাথে লজ্জায় দেখা করুন বা না করুন, ব্রিটিশ প্রশাসন কিন্তু শেখ পরিবারের এ অবৈধ অর্থ উদ্ধারে বাংলাদেশ সরকারকে সাহায্য করছে। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি শেখ হাসিনার ক্ষমতার সাথে সম্পৃক্ত বাংলাদেশের দু’ব্যক্তির ৯০ মিলিয়ন পাউন্ডের বিলাসবহুল সম্পত্তি জব্দ করেছে। ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্যা গার্ডিয়ানের এক খবরে বলা হয়েছে, ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের ছেলে শায়ান এফ রহমানের লন্ডনে থাকা দুটি সম্পত্তি জব্দের আদেশ পেয়েছে এনসিএ।
এ আদেশের ফলে আহমেদ শায়ান রহমানের এবং তার চাচাতো ভাই আহমেদ শাহরিয়ার রহমান লন্ডনের গ্রোসভেনর স্কয়ারে অ্যাপার্টমেন্টসহ কোনো সম্পত্তি বিক্রি করতে পারবেন না। বাংলাদেশের প্রাক্তন স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনার মিত্রদের মালিকানাধীন যুক্তরাজ্যের সম্পদের বিষয়ে গার্ডিয়ানের তদন্তে তাদের নাম উঠে আসে।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, দুর্নীতি ও হত্যা মামলায় বাংলাদেশের ধনকুবের সালমান রহমান এখন বাংলাদেশের কারাগারে। তার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই চার্জশিট দাখিলের যাবতীয় কাজ সমাপ্ত হয়েছে। সালমান রহমান ছাড়াও শেখ হাসিনার আরেকজন মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীরও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয়েছে। বিশ্ববিখ্যাত টেলিভিশন কেন্দ্র আল জাজিরার খবরে প্রকাশ যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সম্পদ জব্দ করেছে দেশটির ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ)। বাংলাদেশী কর্তৃপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে সাইফুজ্জামানের বিরুদ্ধে এ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। সাইফুজ্জামান চৌধুরী বাংলাদেশে ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক মিত্র। সাইফুজ্জামানের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ তদন্ত করছে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো।
সম্পত্তি জব্দের আদেশের ফলে কার্যত সাইফুজ্জামান চৌধুরী এখন সেগুলো আর বিক্রি করতে পারবেন না। এমন সময় ব্রিটেনের এফবিআই হিসেবে পরিচিত পুলিশি সংস্থাটি এই পদক্ষেপ নিয়েছে, যখন বাংলাদেশের অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস লন্ডন সফর করছেন।
গত বছর আলজাজিরার এক প্রামাণ্যচিত্রে বলা হয়েছিলো, ৫৬ বছর বয়সী সাইফুজ্জামান যুক্তরাজ্যে ৩৫০ টির বেশি সম্পদের (বাড়ি ও ফ্ল্যাট) মালিক। এর মধ্যে ঠিক কতগুলোর বিষয়ে এনসিএ পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে আই-ইউনিট এতটুকু জানাতে পারছে যে, লন্ডনের সেন্ট জনস উডে সাইফুজ্জামানের বিলাসবহুল বাড়িটি জব্দের তালিকায় রয়েছে।
ড. ইউনূসের উপদেষ্টা পরিষদ বসে নেই। একদিকে তারা যেমন গণহত্যার বিচার করছেন, অন্যদিকে তেমনি লুন্ঠিত লক্ষ কোটি টাকা পুনরুদ্ধারের আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন। সরকারের কাছে খবর আছে যে, যুক্তরাজ্যে লুন্ঠিত ও পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্যরে শ্বেতপত্র মোতাবেক বিগত ১৫ বছরে লুটপাট করা হয়েছে ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সে লুন্ঠিত অর্থ ফেরত নেওয়ার জন্যই বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর এবং দুদকের চেয়ারম্যানকে যুক্তরাজ্য সফরের সময় ড. ইউনূস তার সফরসঙ্গী করেছেন। স্টারমার ড. ইউনূসকে এড়িয়ে যেতে পারেন। কিন্তু তার প্রশাসন বাংলাদেশের লুটেরাদেরকে খাতির করছে না।
এর মধ্যে যদি লন্ডনে অনুষ্ঠিত ইউনূস তারেক বৈঠকের নির্ভরযোগ্য ও বিস্তারিত খবর পাওয়া যায় তাহলে আগামী সপ্তাহে সে বিষয়ে লেখার ইচ্ছা রাখি।