জাফর আহমাদ
ইসলামে “আমানত” এর মাস’আলা অত্যন্ত ব্যাপক ও মারাত্মক। আপাতত আমরা আমানতকে অর্থাৎ মালামাল ও টাকা-পয়সা অন্যের কাছে গচ্ছিত রাখাকে “আমানত” বলে থাকি। কিন্তু আমানত বস্তুগত ও অবস্তুগতও হতে পারে। যেমন: আপনার জানমাল, শক্তি-সামর্থ, যোগ্যতা, ওয়াদা ও কথাবার্তাও এক প্রকার আমানত। এমনিভাবে ভোটও একটি আমানত। যেহেতু মহান আল্লাহ আপনাকে বেহেশত দিবেন বলে, আপনার জানমাল ক্রয় করে নিয়েছেন এবং সে জানমাল আপনার কাছে আমানত হিসাবে রেখে দিয়েছেন। সেহেতু এ আমানত যেনতেন ভাবে তার হুকুমের বাইরে খরচ করলে আপনি একজন খিয়ানতকারী হিসাবে চিহ্নিত হবেন। আপনার সকল কার্যক্রম হতে হবে আল্লাহর নির্দেশিত ও রাসুলুল্লাহ (সা:) এর প্রদর্শিত পথে। তাহলে কেবল আপনাকে একজন সৎ আমানতদার বলা যেতে পারে।
সুতরাং যেকোন পদের নির্বাচনে নির্বাচনকারী তথা ভোটারদের অত্যন্ত কঠিন একটি দায়িত্ব বর্তায়। আপনার একটি ভোটের মূল্য অনেক অনেক বেশি। ভোটার হিসেবে আপনার দায়িত্ব হলো, একজন সৎ, যোগ্য, আমানতদার ও আল্লাহভিরু লোককে নির্বাচিত করা। অন্যথায় আপনার একটি ভোটের জন্য আল্লাহর দরবারে দাঁড়াতে হবে। আমাদের দেশে এ ভোট নিয়ে বৈচিত্রময় অভিজ্ঞতা, ইতিহাস ও হাস্যরসের কাহিনী রয়েছে। বিশেষত ভোটটিকে একান্তই দায়িত্ব জ্ঞানহীন, অনুভূতিহীন ও মামুলী বিষয় হিসাবে গণ্য করা হয়। সাধারণ একটি চা বা সামান্য অর্থের বিনিময়ে ভোট বিক্রির ইতিহাসও আমাদের রয়েছে। যা পৃথিবীর অন্যত্র তেমন একটা লক্ষ্য করা যায় না। দেশের জাতীয় নির্বাচন খুব কাছাকাছি। এ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে দেশের ভাগ্য। ৫৪ বছর আমরা ভালো শাসক পাইনি। ফলে দেশের ভাগ্যের উন্নয়ন হয়নি। বরং যাদেরকে নির্বাচিত করা হয়েছে তাদেরই ভাগ্যের উন্নয়ন হয়েছে। সুতরাং আবারও বলছি আপনার মূল্যবান ভোটটি সৎ, যোগ্য, আমানতদার ও আল্লাহভিরু লোককে প্রদান করুন। তিনি নির্বাচিত হোক আর না হোক তাতে আপনার কিছু যায় আসে না। আপনার দায়িত্ব হলো, সৎপাত্রে ভোটটি প্রয়োগ করা।
“আমার ভোট আমি দিবো, যাকে খুশি তাকে দিবো” প্রথম অংশ অর্থাৎ ‘আমার ভোট আমি দিবো’ এতটুকু কথা ঠিক আছে, কিন্তু আপত্তি হলো, ‘যাকে খুশি তাকে দিব’ বাক্যটি নিয়ে। যাকে খুশি তাকে দেয়ার অধিকার আল্লাহ আপনাকে দেননি । কারণ মহান আল্লাহ তা’আলা আপনাকে একটি বিবেক দিয়েছেন। ভালো-মন্দ যাচাই ও বাঁচাই করার ক্ষমতাও দিয়েছেন। আপনার বিবেক বলে, ভোট একটি পবিত্র আমানত, ভোট একটি সুপারিশ, ভোট একটি দায়িত্ব প্রদানের মাধ্যম ও ভোট একটি সাক্ষ্য। সুতরাং এ আমানত, সুপারিশ, সাক্ষ্য বা দায়িত্ব কোথায়, কার হাতে দিবেন তা ইসলাম প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বলেও দিয়েছে। আপনাকে অবশ্যই ইসলামের নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে।
আল্লাহ তা’আলা বলেন, “যে ব্যক্তি কল্যাণ ও সৎকাজের সুপারিশ করবে, সে তা থেকে অংশ পাবে এবং যে ব্যক্তি অকল্যাণ ও অসৎকাজের সুপারিশ করবে, সে তা থেকে অংশ পাবে। আর আল্লাহ সব জিনিসের প্রতি নজর রাখেন।” (সূরা নিসা : ৮৫) অর্থাৎ এটা যার যেমন পছন্দ এবং যার যেমন ভাগ্য। কেউ আল্লাহর পথে প্রচেষ্টা চালাবার এবং সত্যের শির উঁচু রাখার জন্য লোকদের উৎসাহিত করে-এর পুরস্কারও সে পায়। আবার কেউ মানুষকে বিভ্রান্তিতে ফেলার, তাদেরকে নিবীর্য ও সাহসহীন করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে-এর শাস্তিও সে পায়। নিচের উদাহরণ থেকে ভোটের মূল্য কতটুকু তা সহজেই অনুমান করতে পারবেন।
“দু’জন ব্যক্তি, যাদের একজন অন্ধ, অন্যজন ল্যাংড়া। একজনের দু’টো পা নেই কিন্তু দু’টো চক্ষু আছে, অন্যজনের দু’টো চক্ষু নেই কিন্তু দু’টো পা আছে। এ দু’জনকে একত্র করলে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষের রূপ পাওয়া যায়। ল্যাংড়া দু’টো চক্ষু দ্বারা পৃথিবীকে দেখতে পারে। কিন্তু দু’টো পায়ের অভাবে সে পৃথিবীর অনেক কিছুর ভোগ ব্যবহার বা মনের স্বাদ-আহলাদ চরিতার্থ করতে পারে না। চোখের সামনে নাগালের প্রায় কাছাকাছি একজনের গাছে আম ঝুলে আছে। কিন্তু আপসোস, দু’টো পায়ের অভাবে খেতে পারছি না। দুটো পা থাকলে তো চুরি করে আম খেতে পারতো। এমন সময় এক অন্ধ তার সামনে দিয়ে পথ চলছে। দুষ্টু ল্যাংড়ার মনে উদয় হলো যে, আমি আর অন্ধ দু’জন মিলে গেলেই তো আম খেতে পারি। অন্ধকে প্রস্তাব পেশ করলো, ভাই অন্ধ আম খাবি?
ভাই! আমি একজন অন্ধ মানুষ, আম পাবো কোথায়? পৃথিবীটার কোথায় কি আছে তা তো আমি দেখতে পাই না। ল্যাংড়া বললো, আমি একজন ল্যাংড়া, পায়ের অভাবে একজনের গাছে আম ঝুলে আছে, খেতে পারছি না। তুমি আমাকে তোমার কাঁধে নিয়ে চলো আমি তোমাকে পথ দেখাবো। যেই কথা সেই কাজ।
মালিকের কাছে ধরা পড়লো, মালিক আমসহ ল্যাংড়াকে প্রহার শুরু করলো। ল্যাংড়া বলছে, বাপুরে! আমার কি দোষ ? আমি একজন ল্যাংড়া, আমার দু’টো পা নেই, আমার কি কোন সাধ্য ছিল আম পারার? ব্যাটা অন্ধ তার কাঁধে করে আমাকে নিয়ে এসেছে। মালিক, তাই তো। পেটা ব্যাটা অন্ধকে। এবার অন্ধ বলছে বাপুরে! আমি একজন জন্মান্ধ, আমার দু’টো চক্ষু নাই, আমি কি জানি কোথায় আম গাছ বা কোথায় কাঠাল গাছ? ব্যাটা ল্যাংড়া আমাকে প্রস্তাব করেছে তাই তাকে কাঁধে তুলে এখানে নিয়ে এসেছি, মালিক দেখলো, তাই তো। মালিক পড়লো বিপাকে। কিন্তু পরক্ষণেই মনের মধ্যে উদয় হলো, দোষ তো দূ’জনেরই সমান। মালিক দু’জনকেই সাইজ করলো।
আমরা জনগণ অন্ধ আর আমাদের নেতৃত্ব হলো ল্যাংড়া। আমরা তাদেরকে কাঁধে করে মানে ভোট দিয়ে ক্ষমতার ঐ চেয়ারটায় বসাই। মনে রাখবেন, ঐ চেয়ারে বসে যতগুলো অকাজ, কু’কাজ ও অবৈধ উপার্জন সে করবে তার ভাগ অন্ধ (জনগণ) : ল্যাংড়া (নেতৃত্ব) এর মধ্যে সমান অনুপাতিক হারে ভাগ হবে। কুরআন ও সাধারণ যুক্তি তো তাই বলে। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “নেকী ও আল্লাহভীতির সমস্ত কাজে সবার সাথে সহযোগীতা করো এবং গুনাহ ও সীমালংঘনের কাজে কাউকে সহযোগীতা করোনা। আল্লাহকে ভয় করো। তাঁর শাস্তি বড়ই কঠোর।” (সুরা মায়েদা : ২)
কিয়ামতের দিন আপনার আমলনামা আপনাকে পড়তে দেয়া হবে। “পড়ো, নিজের আমলনামা,আজ নিজের হিসেব করার জন্য তুমি নিজেই যতেষ্ট।” (বণী ইসরাইল : ১৪) আপনি লক্ষ্য করলেন যে, আপনার আমল নামায় গম চুরি অথবা যেনা-ব্যভিচারের গুনাহ লেখা রয়েছে। আপনি আশ্চর্য হয়ে মহান বিচারক আল্লাহকে আরয করবেন, হে আল্লাহ আমি তো কোনদিন মেম্বার, চেয়ারম্যান বা এমপি ছিলাম না, গম চুরির গুনাহ কোত্থেকে এলো। তাছাড়া আমি কোন দিন নিজের স্ত্রী ছাড়া আর কোথাও গমন করিনি তাহলে যেনার গুনাহ কোত্থেকে এলো? আল্লাহ বলবেন, তুমি এগুলো করোনি বটে কিন্তু তোমার ভোটে মেম্বার, চেয়ারম্যান বা এমপি নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতা পেয়ে অমুক এ গুলো করেছে, তার আনুপাতিক হার তোমার আমলনামায় লেখা হয়েছে।
সুতরাং এ কথা বলা ঠিক নয়, ‘যাকে খুশি তাকে দেবো’। যেনতেন ভাবে ভোট দেয়ার মানে হলো, অসৎ, লম্পট, চোর-বাটপার নামক ল্যাংড়াকে কাঁধে করে ক্ষমতার চেয়ারে বসানো। তার ক্ষমতা ছিল না ঐ চেয়াটায় বসার। কারণ সে ল্যাংড়া। আপনি ভোট দিয়েছেন মানে কাঁধে করে সেখানে বসিয়েছেন। ক্ষমতা পেয়ে সে যতগুলো আকাম-কুকাম করবে তার ভাগ অবশ্যই আপনাকে নিতে হবে। পক্ষান্তরে বিবেক খাটিয়ে সৎ, যোগ্য ও আমানতদারকে ভোট দিবেন। এরপরও যদি সে আকাম বা কুকাজ করে তার দায়-দায়িত্ব আপনার ওপর বর্তাবে না কারণ আপনি ব্যক্তিকে ভোট দেননি বরং আপনি ভোট দিয়েছেন যোগ্যতাকে। তার দায়িত্ব সে নেতৃত্ব নিজে ভোগ করবে। তাই সকলের কাছে সবিনয় অনুরোধ আপনার মূল্যবান ভোটটা সৎ, যোগ্য, আমানতদার ও আল্লাহভীরু ব্যক্তিকে প্রদান করুন।
লেখক : ব্যাংকার।