বিজ্ঞাপনের ভাষায় এক সময় বলা হতো, ‘ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী’। আমার তো এখন বলতে ইচ্ছে করে ‘ছোট হয়ে আসছে পৃথিবীর মানুষ।’ প্রতিদিনই মানুষ ছোট হচ্ছে। তবে বড় মাপের মানুষদের ছোট হওয়ার মাত্রাটা বেশি। কোনো বিচার-বিবেচনা নেই, মাত্রাজ্ঞান নেই, তথ্য-উপাত্ত নেই, ইচ্ছে হলেই মানুষ এখন কথা বলে ফেলে-মানুষ এত বেপরোয়া হয় কেমন করে? আগে ‘জাহেলরা’ এমন আচরণ করতো, এখন ‘উজ্জ্বলরা’ এমন আচরণে যুক্ত হয়েছেন। বিষয়টিকে বর্তমান সভ্যতার নতুন বৈশিষ্ট্য হিসেবে অবিহিত করতে হয়। প্রসঙ্গত এখানে তুলসী গ্যাবার্ডের কথা উল্লেখ করা যায়। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন এবং ইসলামিক খিলাফতকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা প্রধান তুলসী গ্যাবার্ড ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। এর প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সরকার সোমবার এক বিবৃতিতে জানায়, ‘আমরা গভীর উদ্বেগ ও হতাশার সঙ্গে তুলসী গ্যাবার্ডের বক্তব্য লক্ষ্য করেছি, যেখানে তিনি বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ‘নিপীড়ন ও হত্যা” করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করে বলেছেন, ইসলাপন্থী সন্ত্রাসীদের হুমকি এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর তৎপরতা একই আদর্শ ও লক্ষ্য দ্বারা পরিচালিত হয়। সে আদর্শ ও লক্ষ্য হলো ইসলামপন্থী খিলাফতের মাধ্যমে শাসন করা।’ তুলসী গ্যাবার্ডের এমন মন্তব্য বিভ্রান্তিকর এবং বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও সুনামের জন্য ক্ষতিকর উল্লেখ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলেছে, ‘বাংলাদেশ ঐতিহ্যগতভাবে শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ইসলাম চর্চার জন্য সুপরিচিত এবং চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অসাধারণ অগ্রগতি অর্জন করেছে।’
গ্যাবার্ডের মন্তব্য কোনো নির্দিষ্ট প্রমাণ বা অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে করা হয়নি বলে ওই বিবৃতিতে দাবি করে বাংলাদেশ সরকার। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিবৃতিতে আরও উল্লেখ করে, তুলসী গ্যাবার্ডের বক্তব্যে পুরো বাংলাদেশকে অন্যায় ও অতিরঞ্জিতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সরকার দাবি করেছে, বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশও চরমপন্থার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। তবে এটি ধারাবাহিকভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অংশীদারিত্বে আইন-শৃঙ্খলা, সামাজিক সংস্কার এবং অন্যান্য সন্ত্রাসবিরোধী তৎপরতার মাধ্যমে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আসছে। বাংলাদেশকে ভিত্তিহীনভাবে ‘ইসলামিক খিলাফত’-এর সঙ্গে যুক্ত করার অর্থ হলো বাংলাদেেশর জনগণ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগীদের কঠোর পরিশ্রমকে খাটো করে দেখা; যারা শান্তি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ইসলামিক খিলাফত’ ধারণার সঙ্গে যুক্ত করার প্রচেষ্টাকে বাংলাদেশ কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করে। বাংলাদেশ সরকার আরও উল্লেখ করে, রাজনৈতিক নেতাদের ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের উচিত সংবেদনশীল বিষয়ে মন্তব্য করার আগে সে বিষয়ে সম্যক ধারণা রাখা এবং ক্ষতিকর গৎবাঁধা ধারণা ও ভীতি ছড়ানোর বা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা উসকে দেওয়ার মতো কোনো কিছু বলা থেকে বিরত থাকা। সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থার বিরুদ্ধে যৌথ বৈশ্বিক প্রচেষ্টাকে বাংলাদেশ সমর্থন করে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাস্তব তথ্য ও সব দেশের সার্বভৌমত্ব এবং নিরাপত্তার প্রতি শ্রদ্ধার ভিত্তিতে গঠনমূলক সংলাপে অংশগ্রহণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন এবং ইসলামিক খিলাফতকে কেন্দ্র করে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা প্রধান তুলসী গ্যাবার্ড যে মন্তব্য করেছেন, তার প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বলেছে তাঁর বক্তব্য তথ্যভিত্তিক নয়, বরং বিভ্রান্তিকর ও বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর। ভারতের মাটিতে বসে তুলসী গ্যাবার্ড তো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন মন্তব্য করলেন, কিন্তু ভারতের ঘটনাবলী কি তাঁর দৃষ্টির সীমানায় আসে না? সংখ্যালঘু মুসলিম ও খৃষ্টান জনগণের সাথে ভারত সরকার যে বৈষম্য ও নিবর্তনমূলক আচরণ করছে, বিজেপির উগ্র হিন্দুরা যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে, তাকি তুলসীর নজরে পড়ে না? তাঁর অবস্থানকালেই তো মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সমাধি সরানোর দাবিকে ঘিরে ভারতের মহারাষ্ট্রে নাগপুর শহর অশান্ত হয়ে উঠছে। শহরের বিভিন্ন এলাকায় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কারফিউ জারি করা হয়েছে। মোদি আমলের এসব সাম্প্রদায়িক উগ্রতা কি তেমন মন্দ কিছু নয়? এ ব্যাপারে আমরা তুলসীর মন্তব্য জানতে চাই। তিনি কি কিছু বলবেন? ভারতেতো মুসলমানদের মসজিদ-মাদরাসা ভাঙার সংস্কৃতি অব্যাহত রয়েছে। মাঝে মাঝেই মসজিদের নীচে মন্দির থাকার ভূতুরে দাবি জানিয়ে মামলা করা হয়। এসব শুনতে শুনতে তো আদালতের সম্মানিত বিচারকরা বিরক্ত হয়ে পড়েছেন, এ বিষয়ে তুলসী গ্যাবার্ডের উপলব্ধি কেমন?
তুলসী গ্যাবার্ড বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে কথা বলছেন, কিন্তু নিজ দেশের জুলুম-নির্যাতন নিয়ে তাঁর বয়ান কেমন হবে? ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় যুদ্ধবিরতি লংঘন করে ইসরাইল ভয়ংকর হামলা চালিয়েছে। হোয়াইট হাউস স্বীকার করেছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে পরামর্শ করেই এ হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। এ হামলায় কমপক্ষে ৪০৪ জন ফিলিস্তিনী নিহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে অধিকাংশই নারী, শিশু ও বয়স্ক মানুষ। আন্তর্জাতিক মহলের নিন্দার মধ্যেও ইসরাইল চরম নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। আর সে হত্যাযজ্ঞে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন। এভাবেই ইসরাইলী যুদ্ধাপরাধের সাথে জড়িয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্র। সে প্রশাসনেরই গোয়েন্দা প্রধান তুলসী গ্যাবার্ড। তার কাছে ভালো কিছু আশা করা যায় কি?
দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ট্রাম্প যেন এক দানবীয় রূপে আবিভূত হতে যাচ্ছেন। অনেক বন্ধু রাষ্ট্রের সাথে তার আচরণ এখন শত্রুর মতো। প্রতিবেশী যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে নজিরবিহীন হুমকির মুখে পড়েছে কানাডার অর্থনীতি ও সার্বভৌমত্ব। এমন অবস্থায় পুরোনো বন্ধু ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে চাইছে কানাডা। এরই অংশ হিসেবে দেশটির নতুন প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি লন্ডন ও প্যারিস সফর করছেন। দায়িত্ব নেয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই ত্রিমুখী চ্যালেঞ্জে মুখে পড়েছেন কার্নি। সেগুলো হলো- ওয়শিংটনের বাণিজ্যযুদ্ধ, কানাডাকে একিভূত করার ব্যাপারে ট্রাম্পের হুমকি এবং আসন্ন জাতীয় নির্বাচন। ট্রাম্প তো এখন হুমকি-ধমকির মধ্যেই আছেন। আজ বলছেন, আমার এ খাল দরকার, কাল বলছেন আমার ওই দ্বীপটা প্রয়োজন। এক মহাঅস্থিরতার মধ্যে আছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। মানুষ দাম্ভিক হলে কি এমন রোগে আক্রান্ত হন? এদিকে আবার সবাইকে অবাক করে দিয়ে আমেরিকার চিরশত্রু পুতিনকে বুকে জড়িয়ে নিলেন ট্রাম্প। নতুন যাত্রায় ট্রাম্প যেন চমক সৃষ্টিতে মশগুল। কিন্তু প্রশ্ন হলো, চমকের মধ্যে কি সংকটের সমাধান থাকে? ইতিহাসতো বলে, সংকটের সমাধান রয়েছে সত্য এবং ন্যায়ে। এর বিপরীতে গেলে শুধুই অমঙ্গল। বিষয়টি নিয়ে ট্রাম্প ভাবতে পারেন, ভাবতে পারেন তুলসী গ্যাবার্ডও।